আমার বয়স যতই বাড়ছে ততই আমি পেছনের দিকে ঘন ঘন ফিরে তাকাই, ছোটবেলাকার কথা মনে করি, নস্টালজিয়ায় ভোগি, উপভোগ করি, তৃপ্তি পাই। কেন এমন হয়? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো মনস্তত্ত্ববিদ আমি নই, তথাপি বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করতে পারি না।
অবশ্য ওই তৃপ্তির মানে এই নয়, আমার শৈশবকালীন সব স্মৃতিই আনন্দের। সে সময় অনেক ঘটনা আমি ঘটিয়েছি, অনেক দুর্ঘটনার নিরপরাধ শিকারও হয়েছি, যা দুঃখ-বেদনায় ভরা; কিন্তু এই বুড়ো বয়সে স্মৃতি রোমন্থনের সময় সবকিছুই যেন আমার কাছে সমানভাবে এসে ধরা দেয়। আপনাদের এমন হয় কি না জানি না, তবে আমার হয়। কোনো অবসর সময়ে যখন একা একা বসে হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা যখন স্মরণ করি তখন মন চলে যায় গ্রামের বাড়িতে, সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকে, আর আমি গভীর আবেগে আপ্লুত হই, তন্ময় হয়ে ভাবি, কখনো হাসি, কখনো বা কাঁদি। এ জাতীয় কান্না-হাসি দুটোই আমাকে সমানভাবে স্বস্তি দেয়, প্রশান্তি দেয়। এরও কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমার জানা নেই। জানা নেই তার নামও, যার কাহিনী আর আমার কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে তৈরি করেছে আজকের এ গল্প। এবার শুনুন গল্পখানা। আজ ক’দিন ধরে শৈশবের স্মৃতিময় সবার কথা বারবার মনে পড়ছে। যে দিনের কথা বলছি, সে এক বৃষ্টিভেজা আষাঢ়ে সকাল। রান্নাঘরে চুলা জ্বলেনি, দাদীর ঘরে বসে তিনজন জোয়ান কাজের লোক ঠাণ্ডা-বাসি ভাত তরকারি খাচ্ছেন। খেয়েই তারা লাঙল-জোয়াল ও হালের বলদ নিয়ে মাঠে যাবেন।
ফসল ফলানোর জন্য সময়টা ছিল খুবই উপযোগী, কর্মচঞ্চল ও ব্যস্ততায় ভরপুর। কাজের লোকজন চলে গেলেই মা আসেন রান্নাঘরে। ঢুকেই তিনি একদিকে চুলা জ্বালিয়ে সকালের চায়ের পানি বসান, আরেক দিকে আমাকে পাটি বিছিয়ে বই দিয়ে বসান, সকালের পাঠ বুঝিয়ে দেন। চা-পর্ব শেষ হলে মা তিন চুলায় একসাথে ভাত, ডিম সিদ্ধ ও ডাল বসান। তারপর এক সময় দাদী এসে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দিয়ে আবার তার ঘরে চলে যান। তারপর মায়ের আসল রান্না শুরু হয়, সাথে দু’জন জোগালি নারীকর্মী। একজন শিলনোড়ায় মসলা পিষছে, আরেকজন চুলার পাশে মা-রাঁধুনীর সহকারী হিসেবে কাজ করছে। রান্না এবং আমার পাঠদান দুটোই মা সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন। ৯টার দিকে খেয়ে আব্বা স্কুলে যান।
তিনি বাড়ি থেকে বেরোনোর আগ পর্যন্ত মা যেমন কাজের চাপে থাকেন, তেমনি থাকেন মানসিক চাপেও। একান্নবর্তী পরিবার; কাজের লোক, অতিথি, মুসাফির, স্কুলের মাস্টার, মসজিদের ইমামসহ তখন তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন মানুষের রান্নাবান্না, খাওয়া ও সেসবের তদারকি, তাও কম কথা নয়! বস্তুত একাই মাকে সব সামলাতে হয়, কারণ কাজের লোকজন অহরহ অকাজ করে উল্টো তার জন্য বাড়তি ঝামেলার জন্ম দেয়। এত চাপ ও ব্যস্ততার মধ্যে মায়ের মেজাজ প্রায়ই তেতিয়ে থাকে। এ সব ঝামেলার মধ্যে আমি এক সময় বই বন্ধ করে খাওয়ার বায়না ধরি, আমাকে ভাত বেড়ে দেয়ার জন্য মাকে পিড়াপিড়ি করতে থাকি। মা বলছেন, ‘বাবা, ভাত হতে আরেকটু সময় লাগবে, তুমি পড়।’ সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে, আব্বার স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে, অথচ রান্না তখনো শেষ হয়নি, এতে মায়ের মেজাজ এমনিতেই তুঙ্গে উঠে আছে, এতসব তো আর আমি বুঝিনি। আমি ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছি। মা ধৈর্যহারা হয়ে একসময় কানমলা দিয়ে কষে আমার গালে বসিয়ে দিলেন এক চড়। চড় খেয়েই আমি উচ্চস্বরে শুরু করেছি কান্না। কিছুক্ষণ কেঁদেছি ব্যথায়, ক্ষোভে, রাগে ও অভিমানে। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কান্না, আসল কান্না। এ কান্না শেষ হওয়ার পর সচেতনভাবে আমি শুরু করি অন্য মাত্রার নতুন এক কান্না, যা কি না জেদের কান্না, মেকি কান্না।
এক সময় মা আমার সামনে এক প্লেট ভাত দিয়ে গেলেন, আমি খাব না বলে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়ে আরো জোরে কান্না শুরু করে দিলাম। এর পর থেকে থেমে থেমে চলছে আমার কান্না উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মতো, তার সুর ও লয় কখনো ওঠে, কখনো নামে। ক্লান্ত হয়ে গেলে একটুকক্ষণ থেমে থাকি, তারপর আবার কান্না ধরি। এর মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার সামনে রান্নাঘরের মেঝেতে ব্যাচের পর ব্যাচ খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাচ্ছে। দাদীর ঘরে আলাদা চৌকির ওপর বড়দের খাবার দেয়া হয়েছে। ডাল এবং ডিমের ঝোল, সকালবেলা এমন মেনু সচরাচর হয় না। ডাল ও ডিমের কম্বিনেশন আমার খুব প্রিয়। কিন্তু হলে কী হবে? ছোটবেলায় কোনো দিনই তৃপ্তির সাথে খেতে পারিনি। কারণ এত মানুষের সংসার, একটা সিদ্ধ ডিমকে কেটে চার টুকরা করে রান্না করা হতো এবং তার মাত্র এক টুকরো আমাদের ভাগে পড়ত। বড়রা পেত অর্ধেকটা। খাওয়ার সময় অন্য তরকারি দিয়ে ভাত খেতাম এবং ডিমের চতুর্থাংশ প্লেটের কোণায় সাজিয়ে রাখতাম সবার শেষে অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাব বলে। অর্থাৎ ডিমের সুস্বাদের রেশ নিয়েই খাওয়া শেষ করতে চাইতাম। কোনো কোনো সময় খাওয়া শেষ করে মহামূল্যবান ডিমের টুকরোখানা হাতে করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম।
এক দিকে জেদের কান্না চালিয়ে যাচ্ছি, আরেক দিকে আফসোস করছি, গোস্সা করে তো আজ ফেঁসে গেলাম! ডিমের ভাগটা তো আর খাওয়া হবে না, আবার কবে ডিম রান্না হবে আর খাব, কে জানে! এভাবে দেখতে দেখতে সবার খাওয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে। মা ব্যস্ত, আমার দিকে তার ফিরে তাকানোরও সময় নেই। দাদীও আসছেন না আর আমাকেও কেউ সাধছে না। খাই কী করে? বারবার আফসোস করছি আর ভাবছি ‘আরেকবার সাধিলেই খাইব!’ কিন্তু ওদিকে সাধাসাধির কোনো খবরই নেই, আর এদিকে ক্ষিধায় আমার পেট জ্বলছে! সবার খাওয়া শেষ হলে মা কাজের মেয়েদের পাতে ভাত-তরকারি বেড়ে দিয়ে, দাদীকে ডাকতে গেলেন। দাদী এবং মা সবার শেষে খাবেন, তাদের খাওয়া শেষ হলেই সকালবেলার মতো রান্নাঘরের সব কর্মতৎপরতা চুকে যাবে। এটাই বাড়ির নিয়ম। আমি সমূহ বিপদের সম্ভাবনায় প্রায় দিশেহারা! এমন সময় মা দাদীকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন, আর আমি দাদীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যতটা সম্ভব দরদ দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার কৌশল কাজে লাগল। দাদী কান্না শুনে ছুটে এলেন আমার কাছে, মাকে তিরস্কারের স্বরে বললেন, ‘আমার নাতি কান্দে কেন?’ ‘তিনি গোস্সা করছেন,’ বললেন মা।
দাদী খেতে না বসে আমার জন্য প্লেটে ভাত নিলেন একে একে হাঁড়ির সরা তুলে ডিমের হাঁড়িতে পেলেন বেঁচে যাওয়া একটা আস্ত ডিম। ততক্ষণে ডাল শেষ হয়ে গেছে। পাতে আস্ত ডিম দেখে তো আমি খুশি, মহাখুশি! সবুরে তাহলে আজ মেওয়া ফলেছে। ভগ্নাংশের বদলে পুরো ডিম! বাহ! কী মজা! দাদী ডিম-ভাত মেখে মুখে তুলে আমাকে খাওয়ালেন, বললেন, ‘পেট ভরেছে?’ আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম, না। ভাবলাম, দেখি এবার দাদী কী করেন, কারণ খাবার তো সব শেষ। দাদী মিটসেফে গিয়ে পাতিল থেকে দুধ ঢেলে আমার জন্য নিয়ে এলেন সাথে পাতে তুলে দিলেন আরো কিছু ভাত। আমি এবার দুধভাত দিয়ে পেট ভরে খেলাম। মা আপত্তি করেছিলেন, ‘ওটা তো চায়ের দুধ।’ দাদীর হুকুম, ‘আজ সবাই দুধ ছাড়াই চা খাবে!’ আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাব তখন মা চুলা থেকে তিন-চারটা পোড়া আলু তুললেন, কাঁচা মরিচ দিয়ে ভর্তা করে বউ-শাশুড়ি সেদিন সকালের আহার সারলেন। আমি খুশি মনে নাচতে নাচতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। তার আগে অবশ্য দাদী আমাকে মৃদু হুমকি দিয়ে বলেছিলেন ‘আরেকদিন যদি গোস্সা করিস তো উপোস থাকবি।’ আরেক দিন এমন ঘটনা ঘটেছিল বটে, দাদীর কথা ফলেওছিল। আমাকে অনেকক্ষণ ধরে উপোস করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে সেদিন রান্নাঘরে সৃষ্টি হয়েছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের! সেদিন দাদী বাড়িতে ছিলেন না। সবার খাওয়া শেষ, খাবারও শেষ, তরি-তরকারি তো ছিলই না, এমন কি ভাতও অবশিষ্ট ছিল না। মাও খাননি, আর আমি তো গোস্সা করে জেদের কান্না কাঁদছি। কিন্তু মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আসল কান্নাই কাঁদছেন। আহাজারি করছেন আর বলছেন, ‘কেন আমি মারতে গেলাম, আমার ছেলেটা আজ উপোস রইল!’ কাঁদতে কাঁদতে মা ডাল আর চাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসালেন। একদিকে চুলায় আগুন জ্বলছে, আরেক দিকে মা অন্তরজ্বালায় পুড়ছেন আর অঝোরে কেঁদে চলেছেন।
নিজের খিদের ভাবনা নেই, ভাবছেন সন্তানের কথা আর আফসোস করছেন। মায়ের মন যত সহজে গলে চোখ দিয়ে পানি হয়ে ঝরছে, খিচুড়ির চাল-ডাল তত সহজে গলেনি আর আমার কান্নাও সহজে থামেনি। অবশেষে খিচুড়ি হলো, মা আমাকে চামচ দিয়ে মুখে তুলে তুলে খিচুড়ি খাওয়ালেন। আমার পেট ভরল, খাওয়া শেষ হলো কিন্তু তার চোখের ধারা সহসাই থামল না। এই বয়সে, আজ এত বছর পরে যখন সেদিনকার কথা মনে পড়ে তখন আমারও আঁখি দুটো আপনা-আপনি ভিজে আসে। আমি কাঁদি আমার ক্ষিধার কষ্টের কথা মনে করে নয়, বরং মায়ের অশ্রুঝরা মুখখানা যখন মনের আয়নায় ভেসে ওঠে তখন আমার চোখের পানি বাঁধ মানে না। নীরবে কাঁদি, কেঁদে কেঁদে স্বস্তি পাই, প্রশান্তি পাই। কান্নায়ও যে তৃপ্তি আছে তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি, গভীরভাবে উপলব্ধি করি, এ আমার এক অদ্ভুত নস্টালজিক আনন্দ!
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভেলাপিং এরিয়াজ
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন