বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উনিশ শ’ সত্তর দশকের গোড়ার দিকে উপমহাদেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক অধ্যাপক নিহার রঞ্জন রায় কোনো এক সেমিনার উপলক্ষে কলকাতা থেকে ঢাকা এসেছিলেন। ওইবার তিনি ঢাকায় বেশ কয়েকটা বক্তৃতা দেন। বাংলা একাডেমির সামনে, তার একটা বক্তৃতা অন্য অনেক শ্রোতার সাথে আমারও শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। বক্তৃতার একপর্যায়ে ভারতবর্ষের গ্রামগুলো গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমাদের উপমহাদেশে দুই ধরনের গ্রাম দেখা যায়Ñ লিনিয়ার ও কংলোমারেট। লিনিয়ার গ্রাম গড়ে ওঠে নদীর পাড়ে, রাস্তার ধারে অথবা পাহাড়ের পাদদেশে লম্বাভাবে। বাড়িগুলো একটার পর একটা পাশাপাশি একই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পক্ষান্তরে কংলোমারেট গ্রাম বৃত্তাকারে চার দিকে গড়ে ওঠে কোনো বড় প্রাচীন গাছ, মসজিদ, মন্দির, গির্জা অথবা হাটবাজার কেন্দ্র করে। দুই রকমের থাকলেও উপমহাদেশের বেশির ভাগ গ্রামই লিনিয়ার। এখানে কংলোমারেট গ্রাম খুব একটা দেখা যায় না। লিনিয়ার ও কংলোমারেট ছাড়া সময়ের প্রয়োজনে এখানকার গ্রামগুলো যে ভার্টিক্যালি ওপরের দিকেও উঠতে পারে, এ ব্যাপারে অধ্যাপক রায় তখন কোনো ইঙ্গিত দেননি।
আজকের বাংলাদেশে জমির পরিমাণ, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং যে হারে প্রতি বছর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে, তাতে মনে হয় সময় এসে গেছে ভার্টিক্যাল ভিলেজের কথা জরুরিভিত্তিতে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার। ছোট ছোট আটটি টুরিস্ট রিসোর্ট এবং সিটি স্টেট (ম্যাকাও, মনাকো, সিঙ্গাপুর, হংকং, জিব্রাল্টার, ভ্যাটিকান, মাল্টা ও বারমিউদা) বাদ দিলে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে (জলভাগসহ) এগারো শতাধিক লোক বাস করে। যেখানে সমপরিমাণ জায়গায় গোটা পৃথিবীতে জনবসতির গড় ঘনত্ব মাত্র ১৩ জন। বাংলাদেশে জমির পারমাণ এক লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। তার মধ্যে স্থলভাগ এক লাখ ৩০ এবং জলভাগ ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত পরিবেষ্টিত ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার ছাড়া, স্থলভাগের অবশিষ্ট থাকে এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। তা থেকে আবার বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবসায় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং হাটবাজার বিয়োগ করলে আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র এক কোটি ৭৩ লাখ হেক্টর। সামান্য এ জমিটুকুই বাংলাদেশের সোনা। এখানে ফলে সোনার ফসল, যা খেয়ে বেঁচে আছে ১৬ কোটি মানুষ। কিন্তু সমস্যা হলো এই এক কোটি ৭৩ লাখ হেক্টর আবাদি জমি বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারছে না; কিছু আবাদি জমি প্রতি বছর নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও নগরায়নের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুল আবাদি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত হচ্ছে।
নদীভাঙনে যে জমি নষ্ট হয়, তার কিছুটা অন্তত চর উঠলে ফিরে পাওয়া যায়। তা ছাড়া নদীভাঙন রোধে তেমন কোনো কার্যকর প্রযুক্তি আপাতত বাংলাদেশের হাতে নেই; কিন্তু বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও নগরায়নের জন্য যেটুকু কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে তা ঠেকানোর উপায় আছে এবং এটাই এ নিবন্ধের আসল উদ্দেশ্য।
পাবনার আটঘরিয়া কলেজের অধ্যাপক জাফর সাদেক তার এক সাম্প্রতিক গবেষণায় উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৭১-৮৭ এ ১৬ বছরে বাংলাদেশ তার মূল্যবান আবাদি জমি হারিয়েছে ১৪ লাখ হেক্টর। জাফর সাদেকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ওই সময়ে গড়ে প্রতি বছর সাড়ে ৮৭ হাজার হেক্টর করে আবাদি জমি কৃষকদের হাতছাড়া হয়েছে। তারই আরেক হিসাব মতে, নদীভাঙন বাদ দিলে বর্তমানে বসতবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তাঘাট ও শিল্পকারখানাজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন ২১৩ হেক্টর কৃষিজমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই হারে বছরে হারিয়ে যাওয়া কৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৭৭ হাজার হেক্টরের ওপরে। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের এক রিপোর্টে এটা ৮০ হজার হেক্টর ধরা হয়েছে। এ দুই হিসাবে একটু গরমিল থাকলেও খুব একটা ফারাক নেই। দুটোর গড় ধরলে পরিমাণটা দাঁড়াচ্ছে সাড়ে ৭৮ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ প্রতি বছর এ পরিমাণ জমি কৃষি খাত থেকে চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। এ ধারা জারি থাকলে আগামী শতাব্দীর কোনো একসময় বাংলাদেশে আবাদ করার মতো কোনো ফসলি জমি অবশিষ্ট থাকবে না। তত দিনে লোকসংখ্যা হয়তো ৩০ কোটিতে গিয়ে স্থিতিশীল হবে। বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের ষোলো আনাই তখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। চিত্রটি বস্তুতই ভয়াবহ! তাই সময় নষ্ট না করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাবত বছর বছর যে বিপুল জমি কৃষি খাত থেকে অকৃষিতে চলে যাচ্ছে, তা কার্যকরভাবে দ্রুত কমিয়ে আনা উচিত।
কাজটি যত গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি, তত ব্যয়বহুল, কঠিন ও বিরাট। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৭০ হাজার গ্রামকে ক্রমান্বয়ে ভার্টিক্যাল ভিলেজে রূপান্তরিত করে শুধু জমি সংরক্ষণই নয় বরং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কৃষি জমি বাড়ানোও সম্ভব। ভার্টিক্যাল ভিলেজের উদ্দেশ্য- প্রতিটা গ্রামে এক বা একাধিক হাইরাইজ টাওয়ার বানিয়ে ছড়িয়ে থাকা আলাদা আলাদা বাড়ি থেকে গ্রামের সব পরিবারকে হাইরাইজ টাওয়ারের ছোট ছোট ফ্ল্যাটে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তুলে দেয়া। এভাবে যুগ যুগ ধরে ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত জমি, কৃষিকাজের জন্য সহজেই মুক্ত করে আনা যায়। এ ছাড়া আবাদি জমি নষ্ট করে যারা নতুন ঘরবাড়ি বানাতে চায়, তাদের জন্যও হাইরাইজ টাওয়ারে ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত রেখে তাও বন্ধ করা যায়। জাফর সাদেকের গবেষণায় আরো দেখা যায়, যে গ্রামে ১০০টা পরিবার বাস করে, সে গ্রামে শুধু বসতবাটির জন্য মানুষ ব্যবহার করছে ১৩০ হেক্টরের মতো জমি; কিন্তু মাত্র ৩ হেক্টর জমি ব্যবহার করে ভার্টিক্যাল ভিলেজের অধীনে সহজেই গ্রামের ১০০টা পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। এতে ১২৭ হেক্টর অনাবাদি জমি মুক্ত হয়ে যায়। যদি বছরে ১,০০০ গ্রামকে ভার্টিক্যাল ভিলেজে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে প্রতি বছর এক লাখ ৩৭ হাজার হেক্টর অনাবাদি জমি আবাদি জমিতে পরিণত হবে। এখন শুরু করে এ হারে কাজ করতে পারলে আগামী সত্তর বছরে বাংলাদেশে আর কোনো লিনিয়ার বা কংলোমারেট গ্রাম থাকবে না। সবই পরিণত হবে ভার্টিক্যাল ভিলেজে। একজন ব্যক্তির জীবনে সত্তর বছর অনেক লম্বা সময় হলেও একটা জাতির জীবনে এটা কিছুই নয়। এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয়া আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য চীন, শত্রু সীমান্তে যে ঐতিহাসিক প্রাচীর তুলেছিল, তা বানাতে তাদের সময় লেগেছিল দুই হাজার বছর।
এখন প্রশ্ন হলো ভার্টিক্যাল ভিলেজের কাজটা কিভাবে শুরু করা যায়। এটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। তবে কাজটা আরম্ভ করা উচিত একটি পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে। পাইলট প্রজেক্টের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে ব্র্যাক বা এ ধরনের কোনো এনজিও। পাইলট পিরিওড পরে যদি দেখা যায়, ভার্টিক্যাল ভিলেজের ফলে ওই গ্রামে বা তার আশপাশ অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই, তাহলে সারা দেশে জোরেশোরে পুরো উদ্যমে ভার্টিক্যাল ভিলেজের কাজ শুরু করা যেতে পারে। পরের প্রশ্ন, টাকা কোত্থেকে আসবে? টাকার জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও দাতা দেশ থেকে গ্র্যান্ট এবং ঋণ সাহায্যের চেষ্টা করা যেতে পারে। এ ছাড়া দেশীয় সম্পদের ওপর নির্ভর করে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) অধীনে, বাংলাদেশ অল্প অল্প করে তার সনাতনী লিনিয়ার ও কংলোমারেট ভিলেজগুলোকে ভার্টিক্যাল ভিলেজে রূপান্তরিত করতে পারে।
কৃষিজমি সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণ ছাড়াও ভার্টিক্যাল ভিলেজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা কমাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। রাশিয়ার সরকার তাদের দেশে জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি এক বিরাট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। ওই প্রজেক্টের অধীনে তারা আলাদা আলাদা বাড়ি বানিয়ে লাখ লাখ রুশ পরিবারকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাড়িতে তুলে দিচ্ছে। রাশিয়ান থিওরি হলো, অ্যাপার্টমেন্টের স্বল্পপরিসর ও বন্ধ পরিবেশ ছেড়ে বৃহৎ খোলামেলা পরিবেশে আলাদা আলাদা বাড়িতে বসবাস করলে শিশু জন্মের হার বাড়ে। রাশিয়ান থিওরি যদি বাংলাদেশের জন্য সঠিক হয় তাহলে দেশের সব লিনিয়ার ও কংলোমারেট ভিলেজকে ভার্টিক্যাল ভিলেজে পরিণত করে বাংলাদেশ তার জনসংখ্যাকেও যৌক্তিক জায়গায় রাখতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন