আমার আজকের এ লেখার একটা বিশদ পটভূমি আছে। শিরোনামের বিষয়বস্তু যেমন আপনাদের মনে কৌতূহল জাগাতে পারে, তেমনি আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিবন্ধটা কেন লিখছি তার কারণ জানার ব্যাপারেও আপনাদের আগ্রহ থাকা অসম্ভব নয়। পটভূমির শুরুতে একটু রাজনীতির ছোঁয়া থাকলেও বিষয়টি আসলে রাজনৈতিক নয়। ঘটনাটা এবার খুলেই বলি। বেশ কয়েক বছর আগে ‘হিলারির মমতা দর্শন’ নামে আমার একটা লেখা ঢাকার এক দৈনিক কাগজে ছাপা হয়েছিল। লেখাটা পড়ে একজন সমঝদার পাঠক আবেগমাখা মন নিয়ে একটা লম্বা চিঠি টাইপ করে তার স্ক্যান কপি ই-মেইলে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। এ কাজে তিনি যে পরিমাণ সময়, মেধা ও শ্রম দিয়েছিলেন তাতে মনে হয় তার কাছে বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণই ছিল। চিঠিটা পড়ে আমি যত দূর বুঝেছি তার মূল বক্তব্য ছিল এ রকম-বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে একটা সরকারকে নির্বাচিত করার পরে সরকারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বস্তুতপক্ষে ষোলআনাই হারিয়ে ফেলে। আবার কিছু দিন যেতে না যেতে, একইভাবে সরকারও তার বশংবদ পেয়ারা বান্দাদের কোনো কথাই শোনাতে পারে না। তার ওপর সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের সমস্যার কথা ভুলে গিয়ে কমিশন বাণিজ্য এবং দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, অর্থাৎ জনগণ সরকারের ওপর শুধু আস্থাই হারায় না; বরং রীতিমতো ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী নির্বাচনে অন্য দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে আবার দেয়ালে মাথা মারার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে! বাংলাদেশ না হয় একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশ, সুতরাং এখানে এটা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায়ও কেন এমন দেখা যায়? তারা তো উন্নত, ধনী এবং তাদের রয়েছে শত শত বছরে গড়ে ওঠা মজবুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তারা কেন এমন করে? অর্থাৎ তাদের সরকারগুলো যখন অযৌক্তিক কারণে বিদেশের মাটিতে গিয়ে বছরের পর বছর যুদ্ধ করে, মানুষ মারে, ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, সমাজ, সভ্যতা এবং অর্থনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করে তখন তাদের জনগণের বিবেক কোথায় যায়? তারা কেন প্রতিবাদ করে না? তারা কেন তাদের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোকে এ ধরনের অনৈতিক ও অমানবিক কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না? সমস্যাটা কোথায়?
সম্মানিত পাঠকের চিঠি পাওয়ার পর অনেক দিন ধরে আমার মাথায় তার প্রশ্নটা ঘুরপাক খেয়েছে। আমি ভেবেছিও, কিন্তু কোনো যুতসই উত্তর খুঁজে পাইনি, আর তাই তার চিঠির জবাবও দেয়া হয়নি। এমন অবস্থায় গতানুগতিক ধারায় ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে হঠাৎ সে দিন দেখি একটা বইয়ের বিজ্ঞাপন ভেসে উঠেছে আমার মনিটরের পর্দায়। One Hundred Great Inventions that Changed the World অর্থাৎ ১০০টা মহা-আবিষ্কার যা কিনা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। কারসার ঘুরিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদের ওপরে, আশপাশে, ডানে-বাঁয়ে মাউস ক্লিক করলাম অনেকবার, কিন্তু বইটি খুলতে পারলাম না। তাই জানা হলো না ওই মহা-আবিষ্কারগুলো কী কী। অন্ধের মতো আরো কিছুক্ষণ পর্দায় ঘোরাঘুরির পর ঢুকে পড়লাম অন্য এক ওয়েবসাইটে, যার নাম www.independent.co.uk। সেখানে পেলাম ১০১টা মহাআবিষ্কারের আরেকটা দীর্ঘ তালিকা, যেখানে আমাদের আদিপিতা আদম আ: থেকে শুরু করে বিল গেটস পর্যন্ত সবার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলো যত্নসহকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ তালিকাটা বিশেষ বিশেষ আবিষ্কারের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব এবং তাদের আর্থিক তাৎপর্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি। এতে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে সেসব উদ্ভাবন, যেগুলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় এবং যা কিনা যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনকে করে তুলেছে সহজ, সহনীয় ও আরামদায়ক। এসব আবিষ্কার ছাড়া আজকালকার জীবন একেবারেই অচল। এখানে দেখতে পেলাম অনেক সুন্দর সুন্দর নাম, অবাক করা তথ্য-উপাত্ত, যা পড়লে আমার বিশ্বাস আপনারাও মজা পাবেন, না পেলেও অন্তত একঘেঁয়েমিতে ভুগবেন না। যদি কেউ ভুগেই থাকেন, তার জন্য আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
এই ১০১ আবিষ্কারের মধ্যে সাতটা একেবারে প্রাগৈতিহাসিক যুগের। কবে, কোথায়, কোন দেশে, কে বা কারা এগুলো উদ্ভাবন করেছে তার কোনো হদিস নেই। এ আদি সাত-এ আছে- আগুন, তীর-ধনুক, বড়শি, ছোটখাটো যন্ত্রপাতি (হাঁড়িপাতিল, দা, কুড়াল, ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি), চাকা, দাঁড়িপাল্লা ও তালাচাবি। এখানে ভেবে দেখুন, আধুনিক যুগের বিচারে এর কোনোটাই খুব একটা বিশাল জটিল, কঠিন কিংবা চমকপ্রদ কিছু নয়। কিন্তু এগুলো ছাড়া কি এক দিনের জন্যও মানবজীবন চিন্তা করা যায়? আজকালকার বিবেচনায় অত্যন্ত মামুলি হলেও প্রাগৈতিহাসিক যুগে এ তালিকার প্রতিটা উদ্ভাবন ছিল একেকটা মহাবিপ্লবের সূচনা, সভ্যতার প্রবহমান গতিপথে একেকটা তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক, আর সে আঁকাবাঁকা পথ ধরেই আজ আমরা সুপার কম্পিউটার ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছি। এ অগ্রগতির ধারাবাহিকতায়, আগামী দিনে মানবজাতি কখন, কিভাবে, কোন উচ্চতায় গিয়ে উঠবে আল্লাহ মালুম! আগুন যদিও আবিষ্কার হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে, কিন্তু সহজে এবং নিরাপদে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালানো শুরু হয়েছে ১৮২৭ সালে। দিয়াশলাই অবিষ্কার করেছিলেন একজন ব্রিটিশ ফার্মাসিস্ট। আজকের উল্লেখযোগ্য তালিকায় আগুন এবং দিয়াশলাইকে আলাদা করে দেখানোতে মোট আবিষ্কারের সংখ্যা ১০০-এর বদলে হয়েছে ১০১। এই ১০১-এর মধ্য থেকে সাতটা চলে গেলে বাকি থাকে ৯৪।
এ ৯৪-এর মধ্যে একেবারে সাধারণ জিনিস যেমন- লাঙল, ঢাকঢোল, ছাতা, চায়ের কেতলি, বোতাম, জিপার, ভেলক্রো, কাগজ, পোস্ট-ইট-নোট, লেড পেন্সিল, ইরেজার, রাবার ব্যান্ড, মহিলাদের বক্ষবন্ধনী, পেপার ক্লিপ, সেলোটেপ, বলপয়েন্ট কলম, টুথব্রাশ ও ফ্লাশিং টয়লেট ইত্যাদি থেকে শুরু করে বারুদ, বন্দুক, যান্ত্রিক ঘড়ি, ক্যামেরা, ক্যামকর্ডার, নিনটেন্ডো গেম, বারকোড, ব্ল্যাকবেরি, মোবাইল ফোন, রিমোট কন্ট্রোল, মাউস, পিসি ও ল্যাপটপ ইত্যাদি সবই আছে। এর মধ্যে দেখা যাক জাতি হিসেবে কার অবদান কী। কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের আছে একটা করে উদ্ভাবন। কানাডার অবদান রিসার্চ-ইন-মোশন কোম্পানির আবিষ্কার অত্যাধুনিক ব্ল্যাকবেরি, কোরিয়ানদের গৌরব জেনিথ ইলেকট্রনিকস কোম্পানির অবদান টিভি রিমোট কন্ট্রোল এবং ইরানিরা বানিয়েছে ফ্রিজ। (বর্তমানে আমরা যে ফ্রিজ ব্যবহার করি তার গৌরবের সমান দাবিদার স্কটিশ, জার্মান ও আমেরিকান প্রকৌশলীরা। কিন্তু, এর সবচেয়ে মৌলিক উপাদন রেফ্রিজারেটেড কোয়েল, যা সর্বপ্রথম তৈরি করেন পার্সি বিজ্ঞানী ইবনে সিনা)। ইরাকের নিজস্ব আছে দুটো অবদান- লাঙল ও ঢাকঢোল। এ ছাড়াও তারা রোবট এবং কন্ডম আবিষ্কার করেছে মিসর ও ইতালির সাথে শরিক হয়ে। জাপানিদের গৌরব দুটো- তারা বের করেছে নিনটেন্ডো গেমবয় এবং ক্যামকর্ডার। মিসরীয়দের আছে ছয়টি আবিষ্কার। তার মধ্যে দুটো তাদের একক কৃতিত্ব যেমন- ক্লক ওয়ার্ক রেডিও এবং পকেট ক্যালকুলেটর। বাকি যে চারটিতে আছে তাদের শরিকি অবদান, সেগুলো হলো- কন্ডম ও রোবট (ইতালি ও ইরাকের সাথে), সিরিঞ্জ (আইরিশদের সাথে), থার্মোমিটার (যৌথভাবে ইতালি ও ফ্রান্সের সাথে)। চীনের আবিষ্কারের সংখ্যা দশ। তার মধ্যে আটটি তাদের নিজস্ব যেমন- অ্যাবাকাস, কম্পাস, কাগজ, বারুদ, বন্দুক, পর্যান বা স্যাডল, টুথব্রাশ ও জিপার। বাকি দুটো শরিকি যেমন- ছাতা (যৌথভাবে মেসোপটামিয়া, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের সাথে), যান্ত্রিক ঘড়ি (ইউরোপের সাথে)।
এখানে কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইরাক, জাপান, মিসর ও চীন মিলে চলে গেল আরো ২৫। ৯৪ থেকে ২৫ গেলে বাকি রইল ৬৯। এ ৬৯-এর মধ্যে ২০টি আবিষ্কারের একক দাবিদার আমেরিকা এবং অবশিষ্ট ৪৯টি ইউরোপের। এখানে দেখা যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ১০০১ আবিষ্কারের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই একা ইউরোপ-আমেরিকার মাথা থেকে বেরিয়েছে। আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এ ভৌগোলিক এবং র্যাশিয়াল বায়াস বা নরগোষ্ঠীগত পক্ষপাত দুষ্টতা কেন? তা আমার জানা নেই। ফলে ইউরোপ আমেরিকার মানুষের মন-মগজে স্বাভাবিকভাবে একটা অহংবোধ বা আত্মম্ভরিতা জন্ম নিতে পারে, হয়তো বা নিয়েছেও। ওই অঞ্চলের লোকজন মনে করতে পারে তারা পৃথিবীর অন্য সব জাতির তুলনায় বিদ্যাবুদ্ধি ও সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ববোধের কারণে তাদের পক্ষে অন্যান্য জাতির ব্যাপারে একটু উদাসীন এবং গাফেল হওয়া অসম্ভব নয়। তারা নিজেদের মতো অন্যদের হয়তো বা সমান মর্যাদার সাথে দেখেন না, দেখতে চান না।
এ মানসিকতার সমর্থনে এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যায়, আমাদের সবারই জানা; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির প্রাক্কালে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুটো পারমাণবিক বোমা ফেলে হাজার হাজার জাপানিকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, জাপানকে শিগগির আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান এক বিশাল ধাপ্পাবাজি চাল দেন, তিনি জাপানিদের মধ্যে এমন একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হন যে, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত আমেরিকা জাপানে একটার পর একটা শহরে এ জাতীয় বোমা ছুড়তে থাকবে। অথচ সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রাগারে পারমাণবিক বোমা ছিল মাত্র দুটো এবং সেগুলো সঠিক নিশানায় ফেলাও হয়ে গেছে। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কোনো এক আমেরিকানকে পাবলিক মিডিয়ায়, ‘It saved lots of lives!’ বলে জায়েজ করার চেষ্টা করতে শুনেছি। অর্থাৎ তাদের লাইফ, অন্যদেরটা লাইফ নয়! সব আমেরিকান যে এক রকম ভাবে তা ঠিক নয়, তবে কেউ কেউ তো ভাবছেনই। এ ধরনের মনোভাবের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার সেনাবাহিনী যখন তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে গিয়ে হানা দেয় তখন আক্রমণকারী দেশের জনগণ নিশ্চুপ থাকতেই পছন্দ করে, কোনো ধরনের স্পর্শকাতরতা বা সংবেদনশীলতা দেখায় না। এ ব্যাখ্যা একান্তই আমার নিজস্ব, এর সাথে আপনারা সহমত পোষণ করতে পারেন আবার না-ও পারেন। আমার একজন বোদ্ধা ও কৌতূহলী পাঠকের যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম আমার ব্যাখ্যা হতে পারে তারই একটা সাদাসিধে এবং আংশিক উত্তর। তবে এ ব্যাপারে আরো গভীর, তাত্ত্বিক এবং নিরীক্ষাধর্মী গবেষণার আগে কোনো চূড়ান্ত উপসংহারে আসা উচিত নয়।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন