শুক্রবার ১৭ মার্চ ১৭। সমগ্র বাঙালী জাতির অসাধারণ গৌরবের একটি দিন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮তম জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু দিবস উদযাপন করার জন্য পুরো জাতি যখন উদ্বেলিত, যখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেয়া হয়েছে, যখন টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুলের তোড়া শোভা পাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, তখন খবর পাওয়া গেল যে ঢাকার আশকোনায় হাজী ক্যাম্পের পাশে বেলা একটা দশ মিনিটে র্যাব সদর দফতরের নির্ধারিত জায়গায় ২৫ বছরের এক যুবক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমি রাতে যখন এই কলামটি লিখছি তখনও এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। লেখাটি যখন পাঠক-পাঠিকাদের হাতে যাবে তখন হয়ত সবাই সঠিক ও বিস্তারিত তথ্যাদি পেয়ে যাবেন। তবে যতটা জানা গেছে সেটি হলো, র্যাব সদর দফতরে বোমাবহনকারী নিজে দেয়াল টপকে র্যাবের এলাকায় প্রবেশ করে এবং র্যাবের সদস্যদের চ্যালেঞ্জের মুখে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। বিশ্লেষকরা বোঝার চেষ্টা করছেন যে, এটি কাদের দ্বারা ঘটানো হয়েছে এবং আগে পিছে কে কোথায় কিভাবে যুক্ত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, পাকিস্তানী কায়দায় মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা করার উদ্দেশ্য নিয়ে হামলাকারী ওজু করতে র্যাবের অফিসে ঢুকেছিলো। যদি তেমনটি হতো তবে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সম্প্রসারণে আমরা মসজিদ ও আত্মঘাতী দুটি স্তরেই একবারেই পা দিতাম। সময় যেতে যেতে আরও অনেক তথ্য প্রকাশিত হবে। যুবকটির পরিচয়সহ তার মুরুব্বিদের পরিচয়ও হয়ত আমরা পাব। তবে এই নিবন্ধ লেখার জন্য এই ঘটনার বিস্তারিত তথ্যটা জরুরী নয়। এটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। আত্মঘাতী বলে এর একটি নতুন মাত্রা আছে বটে, তবে এটিও বাংলাদেশে প্রবহমান জঙ্গীবাদের ধারাবাহিকতারই সর্বশেষ প্রান্ত। নানা কারণে সর্বশেষ এই ঘটনাটি কতগুলো মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরেছে।
আমার জানা মতে, বাংলাদেশে এ ধরনের আত্মঘাতী বোমা হামলা তেমন প্রবল কোন ঘটনা ছিল না। শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি- জামায়াত জোটের সহায়তায় প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটে। বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেরাই সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী ছিল এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর পথে চলতে পারছিল বলে তাদের কোন সঙ্কট ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার সময়কালে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের পাশাপাশি তাদের আমলে জন্ম নেয়া জেএমবি ও অন্যসব জঙ্গীবাদী সংগঠনের মাধ্যমে এসব ঘটনার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে সন্ত্রাস ও হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে আসছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিদেশীদের ওপর হামলা এবং ব্লগার-প্রকাশকদের হত্যার ঘটনা ঘটে। ধারণা করার যুক্তসঙ্গত কারণ রয়েছে যে, এসব ঘটনার সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদ বা আইএস-এর জড়িত থাকার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। আমি নিজে নিশ্চিত ছিলাম যে, পাকিস্তান এইসব জঙ্গীবাদের সাথে যুক্ত। পাকিস্তান একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য দেশীয় পাকিস্তানপন্থীদের সহায়তার জন্য আইএসআই এবং এমনকি খোদ তারেক রহমান এসব কাজের সাথে যুক্ত তেমন অভিযোগ আমরা পেয়ে আসছি।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বদলা নিতে বা ঠেকাতে এসব ঘটনা ঘটছে, সেটি আমরা আরও নিশ্চিত হয়েছি যখন পাকিস্তান সরকার, সংসদ ও রাজনৈতিক দলসমূহ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করেছে। আমি দৃঢ়তার সাথে এটি বলতে পারি যে, পাকিস্তান বাংলাদেশবিরোধী সেই ভূমিকা থেকে এক চুলও সরে দাঁড়ায়নি। আমাদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ যে, পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পেছনে সবচেয়ে সহায়ক শক্তি হচ্ছে আমাদের দেশীয় শক্তিও। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির বিকাশ ঘটানোর যে প্রয়াস জিয়াউর রহমান শুরু করেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাকে আরও এক পা সামনে নেন। বাংলাদেশের জন্মের অঙ্গীকারকে মুছে ফেলার চেষ্টায় সংবিধানকে ছিন্ন ভিন্ন করা হয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানের অংশ করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপন্থী রাষ্ট্রে পরিণত করার সকল চেষ্টা করা হয়। এরই ফলশ্রুতিতে এমনকি শেখ হাসিনার শাসনকালেও হেফাজতের হুমকির কাছে নরম সুরে কথা বলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
১৭ মার্চের ঘটনাটিকে আমি একটু ভিন্ন মাত্রার ঘটনা মনে করছি বেশ কটি কারণে। এই ঘটনার মাত্র এক দিন আগে সীতাকু-ের ঘটনাটি বাদ দিলে অন্য কোন আত্মঘাতী ঘটনার কথা সহজে স্মরণ করতে পারছি না। পরপর দুদিন দুটি আত্মঘাতী ঘটনা ঘটার ফলে বাংলাদেশের জন্য একটি অশনি সংকেত, সেটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা সাম্প্রতিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করছেন তারা জানেন যে জঙ্গীবাদের চূড়ান্ত সঙ্কটের জায়গাটির নাম আত্মঘাতী হামলা। দুনিয়ার খবর যারা রাখেন তারা এটিও স্মরণ করতে পারবেন যে, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশে এই আত্মঘাতী হামলা প্রচ- আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এই আতঙ্কের যতটা বাইরে ছিল মনে হচ্ছে সেই দূরত্বটা আর নেই। উদ্বেগের বিষয় যে এর পরিণতি কি সেটি এখনই আন্দাজ করে বলা সম্ভব নয়।
এটিও পর্যবেক্ষণ করার মতো ঘটনা যে, ঘটনাটি ঘটেছে র্যাবের মতো একটি এলিট বাহিনীর ঠিকানায়। এমন হতে পারে যে, ১৭ মার্চকে কেন্দ্র করে একটি বড় ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ছিল। র্যাব ছাড়াও শহরের বা দেশের আরও বহু জায়গাতে হয়ত এরকম আত্মঘাতী হামলা হতো। সীতাকু-ে যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা নাকি এখন পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। সীতাকু-ের ঘটনা, আশকোনার আগের ঘটনা ও আরও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো একসাথে যুক্ত থাকতেই পারে। জঙ্গী দমনে সরকারের অসাধারণ সক্ষমতার প্রেক্ষিতে পুলিশ-র্যাবকে আতঙ্কিত করার হীন প্রচেষ্টাও এর পেছনে থাকতে পারে। আমরা জানি সরকারকে আরও নানা প্রসঙ্গ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
সরকারের ভেতরেও যে পাকিস্তানপন্থীরা আছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিককালে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাকেও জঙ্গীবাদ ছাড়া আর কিছু বলা যায়, না। যে দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিতকে ধ্বংস করে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা শিশুদের জন্য প্রয়োগ করা যায় সেই দেশে এমন বোমা হামলা তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই বিবেচিত হতে পারে। আত্মঘাতী বোমা হামলার চাইতে হেফাজতের দাবির প্রভাব সামান্যতম কম নয়। আমি মনে করি, আমরা এই মার্চ মাসে স্বাধীনতার ইশতেহার, এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণা বা ৭২-এর সংবিধানের সকল কিছুকে পাশ কাটিয়ে রেখে এই রাষ্ট্রকে সামনে নেবার তথাকথিত চেষ্টা করছি। বস্তুতপক্ষে আত্মঘাতী বোমা হামলা হোক, সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদের কথাই বলি, এই পথকে পাল্টে দেবার জন্য আদর্শিক লড়াইটা না করলে কোনভাবেই বাংলাদেশ তার জন্মের ঠিকানায় থাকতে পারবে না।
কিছুটা অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, স্বাধীনতার পক্ষের দাবিদার নিজেদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা নীতিমালাকে সঠিকভাবে ধারণ করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ বা নীতিকে জানেই না। এমনকি ধারণা করা হচ্ছে যে, রাজনীতিবিদদের মতে, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করলে নির্বাচনে জেতা যাবে না? এটিও কি ভাবা হচ্ছে যে, স্বাধীনতার পক্ষশক্তি যদি ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে চলে তবে একদল মানুষ পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের করায়ত্ত হয়ে যাবে?
আমাদের বোধহয় সময় হয়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক বিষয়গুলো মূল্যায়ন করার। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, সারা দুনিয়াতে জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাস থাকলেও, বাংলাদেশের এই প্রসঙ্গটি তার জন্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ৭০ সালের নির্বাচনে দেশের শতকরা ২৮ ভাগ লোক নৌকার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। তারা বাংলাদেশ নয় পাকিস্তানই চেয়েছিল। ৭১ সালে এদেরই অংশ বিশেষ সশস্ত্রভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে লড়াই করেছে। এখন নৌকার বিপক্ষে ভোট শতকরা প্রায় ৩৮ ভাগ। এর অর্থটা হচ্ছে, ৭৫ থেকে ৯১ এবং ২০০১-০৮ সময়কালে শতকরা ২৮ সংখ্যাটি ৩৮ হয়েছে। এটি আমাদের স্পষ্ট বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশবিরোদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই চলতে হবে। স্মরণ করুন তো, বঙ্গবন্ধু সেই মহামানব যিনি পাকিস্তান আমলে আওয়ামী মুসলিমকে আওয়ামী লীগে রূপান্তর করতে পেরেছিলেন। আসুন তার সেই অসাম্প্রদায়িক নীতিতে অটল থাকি। তিনি পাকিস্তান, চীন ও আমেরিকার বিপক্ষে নিরস্ত্র বাঙালীকে নিয়ে যুদ্ধে জিতেছিলেন।
তিনি সবার ওপরে বাঙালী জাতয়ীতাবাদকে স্থাপন করেছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সর্বস্তরে একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেই মহামানবের উত্তরসূরি হয়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এমনকি রাষ্ট্রভাষাকে কেন বাদ দিতে হবে? আমরা কি এখন তার সেই নীতি ও আদর্শকে মেনে চলি? আমরা কি তার আদর্শ বাস্তবায়ন করি? কেন আমরা নিজেদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বা জীবনধারাকে হেফাজতের কাছে নত করাচ্ছি? কেন আমরা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম প্রত্যাহার করতে পারিনা? কেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারি না? কেন আমাদের রাষ্ট্রভাষা হারিয়ে যাচ্ছে? বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে কেবল একমুখী নয়, প্রাথমিক শ্রেণী পর্যন্ত এক ভাষা বাংলা করেছিলেন। কেন আমাদের নানামুখী ও ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা চালু করতে হয়েছে? প্রচ- ভয় হয়ত কাজ করে যে, দেশটা আবার স্থিতিশীলতা হারিয়ে ফেলবে!
আসুন না, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হয়ে তার পথটাতেই চলি। আমি খুব অবাক হয়েছি এবার পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন দেখে যে, নুরুল ইসলাম নাহিদের মতো একজন শিক্ষামন্ত্রী থাকার পরেও তার মন্ত্রণালয় হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যবই তৈরি করেছে!
এমনকি পাকিস্তান আমলেও যেরকম সাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়নি, তার চাইতেও জঘন্য পাঠ্যপুস্তক শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের অবৈধ অঙ্গ সংগঠন ওলামা লীগও হেফাজতের মতোই কথা বলছে। তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত যদি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পালন করা হয় তবেই আত্মঘাতী বোমা হামলা বা জঙ্গীবাদী সন্ত্রাস থেকে আমরা বাঁচতে পারব।
ঢাকা, ১৭ মার্চ, ১৭ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা
উৎসঃ জনকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন