বাংলাকে বিপন্ন হতে দেব না লড়াই চলছে, চলবে
12 February 2017, Sunday
প্রতি বছরের মতো এবারও ফেব্রুয়ারি মাস এসেছে। প্রতি বছরই আসে আবার মাত্র ২৮/২৯ দিনে সেটি পারও হয়ে যায়। এরই মাঝে পত্র-পত্রিকা-টিভি ও অন্যান্য মিডিয়াতে ভাষা শহীদদের নিয়ে মাতম শুরু হয়েছে। প্রায় সবাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চায় ব্যস্ত। অথচ ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষা ও হরফ যে বিপন্ন সেটি কাউকে বলতে শোনা যায় না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে তেমন কোন আলোচনাও হচ্ছে না। তবে প্রতিবারের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার শহীদ মিনারে রাজনীতিবিদদের ঢল নামবে। দেশের অন্য শহীদ মিনারে প্রধানত ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হয়ে প্রভাতফেরি করে ফুল দেবে। ঢাকার বইমেলা শেষ হবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন এবং তারপরের দিন ১ মার্চ থেকে সেই মাতমের ছিটেফোঁটাও আমরা কোথাও পাব না।
খোলামেলাভাবে বলতে গেলে বাঙালী তার বাংলা ভাষা বর্জনের স্থানটিকে খুব স্পষ্টভাবেই চিহ্নিত করে ফেলেছে। এক কথায় যদি বলা হয় তবে এখন শহুরে বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালীর ঘরোয়া মুখের ভাষা বাংলা হলেও তার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা বা দৈনন্দিন জীবনের আনুষ্ঠানিকতা, এমনকি লেখাপড়ার ভাষাও বাংলা নয়। ভাষার জন্য রক্ত দানকারী জাতির এমন ভিমরতি কেন হয়েছে তা গবেষকরা খুঁজে দেখবেন। তবে আমি খুব সহজেই অনুভব করতে পারি যে, পুঁজির বিকাশের ফলে একশ্রেণীর বাঙালীর কাক হয়ে ময়ূরের পুচ্ছ ধারণ করার প্রবণতা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তারা ইংরেজ হতে চাচ্ছে এবং তাতেই তাদের জীবনের মুক্তি বলে মনে করছে। অন্যদিকে অক্ষম বা ক্ষমতাহীন বাঙালীর ভাষার নাম বাংলা। এই জনগোষ্ঠী বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা জানে না। ভুল ইংরেজীও বলতে বা লিখতে পারে না। বাংলা ছাড়া তার কোন গতি নেই। সাংবিধানিকভাবে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হলেও এই রাষ্ট্রযন্ত্র, বিশেষত আমলাতন্ত্র নানা কৌশলে বাংলা বর্জনের চরম পথে পা বাড়িয়েছে। এর মাঝে ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব¡ বিপন্ন করাটাই আমার নিজের কাছে চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আমার বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার চ্যালেঞ্জের জন্য কি এই ভাষাটির ব্যবহার হ্রাস পাবার কোন যৌক্তিক কারণ আছে? এখন আমার মনে হচ্ছে যে, একটি সময় আসবে যখন ডিজিটাল প্রযুক্তির নামে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও ৩৫ কোটি লোকের ভাষা বা তার চাইতেও বেশি মানুষের হরফ হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবুও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে কমছে। বিশেষ করে ডিজিটাল যুগের আগে আমরা বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যতটা সচেতন ছিলাম এখন সেটি নেই।
আমি তাই মনে করি বাঙালী জাতির মাতৃভাষার সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে এর উৎপত্তি, বিকাশ, রূপান্তর ও সমৃদ্ধির পথ চলায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এর ডিজিটাল যাত্রা। সেই ১৭৭৮ সালে বাংলা হরফের মুদ্রণ বা ৭২ সালে এর বাংলাদেশের বাংলা টাইপরাইটারে যাত্রা, আশির দশকে ফটোসেটারের উদ্ভব, ৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ থেকে এই সময়ে ডিজিটাল উপায়ে বাংলার ব্যবহারের মাঝে রয়েছে প্রযুক্তিগত বিবর্তনের-উদ্ভাবনের অসম সাহসী ইতিহাস। অন্যদিকে ১৭ সালে বাংলা ভাষা ও তার লিপি ডিজিটাল যাত্রার এক অসাধারণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথমবার বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার পথে সবচেয়ে বড় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার লগ্ন উপস্থিত হয়েছে। সরকার ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে তার সহায়তায় বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার সহায়ক ১৬টি টুল উন্নয়নের কাজ করার পরিকল্পনা করছে। কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের তিরিশ বছর পূর্তির সময়ে আমরা বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার ডিজিটাল যাত্রাকে একটু ভাল করে ব্যাখ্যা করে দেখতে চাই। আমার তিরিশ বছরের লড়াইয়ে এমন একটি সময় এর আগে আর কখনও আসেনি বলেই আমি মনে করছি। এখনই সময় পুরো প্রেক্ষিতটি পর্যালোচনা করার।
গত শতাব্দীতে বাংলাদেশের বাংলা ভাষার জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ছিল কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন। যদিও আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের নাগরিকদের দ্বারাই এই কাজটি শুরু হয়, তথাপি এটি কার্যত এক নতুন মাইলফলক হিসেবে আবির্ভূত হয় ১৯৮৭ সালের ১৬ মে, আমার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে কম্পিউটার প্রয়োগের সূচনা দিয়ে। এরপর কম্পিউটারে বাংলা ভাষার বড় ঘটনাটি হচ্ছে ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় কীবোর্ডের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। এই শতকে এসে এটি আরও সম্প্রসারিত হয় এবং সকল প্রকারের ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলার প্রয়োগ ঘটতে থাকে।
বস্তুত, ১৯৮৭ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তেই বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রায় কোন না কোন উন্নয়ন হয়েছে। একটি নতুন ফন্টের ডিজাইন, মাউস দিয়ে বাংলা লেখার সুযোগ তৈরি, বাংলায় ইমেইল প্রচলন, বাংলা অভিধান, ইউনিকোডে বাংলা, নতুন নতুন কীবোর্ডের জন্ম, কীবোর্ড প্রমিতকরণ, বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ প্রণয়ন বা বিডিএস ১৮৩৪ : ২০১১ প্রণয়ন, মোবাইলের জন্য বাংলা বাধ্যতামূলক করা বা একটি নতুন সফটওয়্যারে বাংলা লেখার সুযোগ তৈরি হওয়া- এসব চলেই আসছে। এরই মাঝে আমরা ডট বাংলা ডমেইন চালু করেছি। সবচেয়ে বড় কথা ২০১৭ সালে সরকার ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলা ভাষার জন্য ১৬টি টুলস উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব কর্মকা- প্রমাণ করে যে, বাংলা একটি জীবন্ত ভাষা এবং বাংলা ভাষাভাষীরা অসাধারণ মেধাসম্পন্ন জাতি। এতে প্রমাণ হয় যে, বাঙালী জাতি বাংলা ভাষা ও হরফকে পুরোই ভুলে যায়নি। এতে প্রমাণ হয় যে, কিছু লোক বাংলাবিদ্বেষী হলেও আমরা এখন নিজেদের ততোটা অসহায় বিবেচনা করতে পারি না।
তবে এই বিষয়টিও আমরা এখন অনুভব করছি যে, স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষার যতটা উন্নয়ন হতে পারত তা আমরা করতে পারিনি। বিশ্বের উন্নত ভাষাসমূহের সঙ্গে তুলনা করার মতো সমন্বিত উদ্যোগ আমাদের এর আগে ছিল না। এবার সম্ভবত সেই দুঃস্বপ্নকে অতিক্রম করার সময় হয়েছে।
আমি ৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল কম্পিউটারের বোতাম স্পর্শ করা থেকে এই লেখা সম্পাদনার মুহূর্ত পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলার স্রোতধারায় একীভূত হয়ে মিশে আছি। আমার রক্তের প্রতি ফোঁটায় বাংলা ভাষা ও তার হরফ বিরাজ করে। ফলে আমার সঙ্গে যেমনি আছে ডিজিটাল বাংলার ইতিহাস, তেমনি আছে এর সমস্যা, সঙ্কট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। বিভিন্ন সময় আমি এসব বিষয় নিয়ে লিখেছি। যেমনি করে নিজের সকল শক্তি দিয়ে ডিজিটাল বাংলার যাত্রাপথ সুগম করেছি তেমনি এই যাত্রাপথে যখনই কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তখনই তাকে সরানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। জাতিগতভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে নীরব থাকার মানুষ নই আমরা। সেই ৪৭ সালে যখন পাকিস্তানের মোহ এই জনপদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তখনও আমরা বাংলার সামান্য অবমূল্যায়নও সহ্য করিনি। এর আগেও যখন বাংলা ভাষা রক্তচক্ষুর চাপে পড়েছে তখনও বাঙালীরা প্রাণের ভয় করেনি।
কিন্তু একটি চরম সত্য কথা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলা ভাষার যেসব চ্যালেঞ্জ ছিল এখন তেমনটি আর নেই। পাকিস্তান আমলে আমাদের লড়াই ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। রক্ত দিয়ে সেই লড়াইটা আমরা করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রথম লড়াইটা ছিল অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন করা। অতীতে কোনদিন যে ভাষা অফিস বা আদালতের ভাষা হতে পারেনি সেই ভাষাকে বঙ্গবন্ধু সরকারী ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করেন। তিনি যান্ত্রিক সঙ্কটও দূর করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারীভাবে বাংলাকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করা হয়। সামরিক শাসকরা মজ্জাগতভাবে ইংরেজদের দাস হওয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু সরকারী অফিসে বাংলা ব্যবহারের যে বাধ্যবাধকতা চালু করেছিলেন তাকে শিথিল করা হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহারের জন্য আইন করলেও পরবর্তীতে সেটি তামাশায় পরিণত হয়। এখন সরকারী অফিসে গ্রামের রাস্তার উন্নয়নের প্রকল্প ইংরেজীতে প্রণীত হয়। সরকারী অফিসের সেমিনারের ভাষা হয় ইংরেজী। তারা কথা বলেন ইংরেজীতে, প্রবন্ধ লিখেন ইংরেজীতে। বেসরকারী অফিসে বাংলা একেবারেই নেই। উচ্চশিক্ষায় বাংলা নেই। উচ্চ আদালতেও বাংলা নেই। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার ইংরেজীতে রূপান্তর হচ্ছে। তথাকথিত ইংরেজী মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সনের বদৌলতে শিশুদের মাতৃভাষা বর্জন করতে হচ্ছে।
কেউ কেউ এই কথাটি বলতে পারেন যে, বাংলাকে তো ইংরেজীর মতো ব্যবহার করা যায় না। এর ব্যাকরণ ও বানান শুদ্ধিকরণ সফটওয়্যার নেই। এর জন্য প্রণীত অপটিক্যল ক্যারেক্টর রিডার সফটওয়্যার কাজ করে না। এর অনুবাদক সফটওয়্যার নেই বা খুব ভাল করপাস গড়ে উঠেনি। এসব সত্য কথা। কিন্তু আমরা ২০১৭ সালে এসে সেই সত্যকে অতিক্রম করার পথে পা দিয়েছি। শেখ হাসিনার সরকার ৩ জানুয়ারি ২০১৭ অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তার মাধ্যমে ১৬টি টুলস উন্নয়ন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বাংলা ভাষার ডিজিটাল টুলের ঘাটতিটা কেটে যাবে।
তবে বাংলা ভাষার বর্তমান সঙ্কটটা কেবল টুলসের অপ্রাপ্যতা নয়। সঙ্কট মানসিকতার। আমরা আমাদের জীবনধারায় বাংলা ভাষাকে ঠাঁই দিচ্ছি না। বাড়িতে নিজেরা বাংলায় কথা বললেও বিয়ের দাওয়াতের কার্ডটাও ইংরেজীতে করি। এমনকি আমাদের নতুন প্রজন্মের কিছু লোক রোমান হরফে বাংলা বা রোমান হরফ দিয়ে লিখে বাংলায় রূপান্তর করার কুচর্চা করছে। এর ফলে বাংলা ভাষার বানান চর্চায় কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়নি বরং দিনে দিনে একটি প্রজন্ম বাংলা হরফ বা যুক্তাক্ষর চিনতে ভুলে যাচ্ছে। এই চরম অরাজক অবস্থা আমরা মানতে পারি না। কিছু বিভ্রান্ত মানুষের জন্য বাংলা ভাষা ও বর্ণমালাকে আমরা বিপন্ন হতে দিতে পারি না। এখনও আমরা আমাদের সেই পূর্ব পুরুষদের পথ ছাড়িনি। বাংলার জন্য তাই আমাদের লড়াইটা চালু আছে। থাকবে।
উৎসঃ জনকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন