সন্তান ও সম্পদ পরীক্ষার সামগ্রী
10 December 2020, Thursday
‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করো না। নিজেদের আমানতের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করো না। আর জেনে রাখো তোমাদের মাল ও তোমাদের সন্তান প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষার সামগ্রী। আল্লাহর কাছেই রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সূরা আনফাল : ২৭ ও২৮)
আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
২৭ নম্বর আয়াতে হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ- উভয়ই উল্লিখিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্বে এ বিষয়ে চেতনা এত কম যে, তা শূন্যের কোঠায়; তাই আয়াতটির বাস্তবতা সুস্পষ্ট। হকুক বা অধিকার সম্বন্ধে অজ্ঞতা ও অনীহা উভয়ই এ জন্য দায়ী। এ আয়াতে জ্ঞাতসারে অনীহার কথা উল্লিখিত হয়েছে। স্পষ্টতই এটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ২৮ নম্বর আয়াতে ২৭ নম্বর আয়াতের বক্তব্যের জের টেনেই বলা হয়েছে যে, ধন-সম্পদ লাভ ও সন্তান-সন্ততির কল্যাণ কামনাহেতু লোকে হকুক ভুলে যায়। এতে করে তারা আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধেই ভুল করে বসে। পার্থিব জীবনে যা লাভ বলে মনে হয়, তা প্রকৃত লাভ না-ও হতে পারে। প্রকৃত পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর কাছেই, আর তার গুণগত মান অতি উচ্চ, পরিমাণও বিপুল।
এই যে, আল্লাহর কালামে উল্লিখিত সত্য, ঈমানদার ব্যক্তির উত্তম আচরণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য এটি যথেষ্ট হওয়ার কথা। মুমিনদের আর্থ-সামাজিক জীবন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য এটাই পথনির্দেশ। এখানেই আয়াত দু’টির বিশেষ গুরুত্ব।
তাফসিরকারদের আলোচনা
সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী লিখেছেন- নিজেদের আমানত বলতে সেই সব দায়িত্ব বোঝানো হয়েছে, যা সবের প্রতি আস্থা স্থাপন করে তার ওপর ন্যস্ত করা হয়। তা ওয়াদা পূরণের দায়িত্ব হতে পারে। কিংবা কোনো সংস্থার অভ্যন্তরীণ গোপন তথ্য হতে পারে, ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ধন-সম্পদ হতে পারে। কারো প্রতি ভরসা করে জনসমাজ যদি তাকে কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করে তা-ও এর মধ্যে শামিল বলে মনে করতে হবে।
মানুষের ঈমানের প্রতি নিষ্ঠা ও সততার সাধারণত যে বিষয় দোষ-ত্রুটির উদ্ভব করে আর যে কারণে প্রায়ই মানুষ মুনাফেকি, বিশ্বাসঘাতকতা ও খিয়ানতে লিপ্ত হয়, তা অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সন্তান-সন্ততির স্বার্থের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ ও উৎসাহ। এ কারণে এখানে বলা হয়েছে, এ ধন-সম্পদ যার ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে তোমরা সাধারণত সত্য ও সততার পথ থেকে গোমরাহ হয়ে যাও, তা আসলে এ দুনিয়ার পরীক্ষাগারে তোমাদের পরীক্ষার সামগ্রী মাত্র। তোমরা যাকে পুত্র বা কন্যা বলো তা আসলে পরীক্ষার একটি কাগজ মাত্র। আর যাকে তোমরা জমি জায়গা ও ব্যবসার সম্পত্তি মনে করো, তা আসল পরীক্ষার আরেকটি কাগজবিশেষ। এসব জিনিস তোমাদের হাতে অর্পণ করা হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, এসবের দ্বারা তোমাদের যাচাই ও পরীক্ষা করা হবে।
মুফতি মুহাম্মদ শফী লিখেছেন : ২৭ নম্বর আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার হকগুলো কিংবা পারস্পরিকভাবে বান্দার হকগুলোর খেয়ানত করো না। হক আদায়ই করবে না কিংবা আদায় করলেও কোনো শৈথিল্যের সাথে আদায় করবে- এমন যেন না হয়। আয়াতের শেষভাগে বলে দেয়া হয়েছে- তোমরা তো খেয়ানতের অপকারিতা ও বিপদ সম্পর্কে জানোই। তারপরও সে দিকে পদক্ষেপ না নেয়া মোটেও বুদ্ধিমত্তার কথা নয়। আর যেহেতু আল্লাহ ও বান্দার হকগুলো আদায় করার ক্ষেত্রে গাফিলতি ও শৈথিল্যের কারণ সাধারণত মানুষের ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততিই হয়ে থাকে, কাজেই সে সম্পর্কে সমার্থক করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে; এ কথা জেনে রেখো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য ফিতনা।
‘ফিতনা’ শব্দের অর্থ পরীক্ষাও হয়, আজাবও হয়। এ ছাড়া এমন সব বিষয়কেও ফিতনা বলা হয় যা আজাবের কারণ হয়ে থাকে। কুরআন মাজিদের বিভিন্ন জায়গায় এ তিন অর্থেই ফিতনা শব্দের ব্যবহার হয়েছে। বস্তুত এখানে তিনটি অর্থেরই অবকাশ রয়েছে।
আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য
এ দু’টি আয়াতে ইসলামী সমাজ ও অর্থনীতি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি রয়েছে। আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর সাথে খেয়ানত না করার তাৎপর্য হচ্ছে, আমরা আল্লাহ ও রাসূল (সা:)-এর শিক্ষা মানতে বাধ্য। কোনো অবস্থাতেই আমরা তা ভঙ্গ করতে পারি না কিংবা পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম দেশের পার্লামেন্টকে এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
২৭ নম্বর আয়াতে আমানতে পারস্পরিক বিশ্বাস ভঙ্গ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমানতের ব্যাপক অর্থ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আমানতের এ গুরুত্ব ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক বিষয়। অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিশ্বাস বা আমানতদারির ওপর নির্ভর করে। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয় Credit worthiness. এটা আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার ভিত্তি। ইসলামী সমাজ ও অর্থনীতি এরই প্রতিষ্ঠা চায়। যদি আমানতদারি অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সেখানে ব্যবসায়-বাণিজ্য, ঋণ দান, ঋণ গ্রহণ, বিনিয়োগ-সবই নিরাপদ ও সহজ হয়ে যাবে। সে অবস্থায় উৎপাদন ও সামগ্রিক উন্নতি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। অবশ্য ইসলামী রাষ্ট্রকে শিক্ষা, তথ্য-মাধ্যম ও সামাজিক পত্রিকায় প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আমানতদারি সৃষ্টি করতে হবে। তবেই তার সুফল পাওয়া যাবে।
২৮ নম্বর আয়াতে লোভ-লালসা ও স্বজনের অতিরিক্ত প্রীতি সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। ধন-সম্পদ পরীক্ষার সামগ্রী। এর তাৎপর্য হলো, ধন-সম্পদকে সঠিকভাবে ইসলামী শিক্ষা মোতাবেক নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য ব্যবহার করতে হবে। ধন-সম্পদকে অবৈধভাবে ও অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা যাবে না। ধন-সম্পদ অপব্যয় ও নষ্ট করা যাবে না। মানব কল্যাণেই এর প্রয়োগ হতে হবে। এখানে ভোগ্য ব্যবহারের কী নীতি হবে, তারও ইঙ্গিত রয়েছে। এ নীতিকে ভিত্তি করে পরিকল্পনা কমিশন জাতির জন্য ভোগ্য ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করতে পারে।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়া দিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন