হে বনি আদম! প্রত্যেক ইবাদতের সময় ও ক্ষেত্রে তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করো। খাও এবং পান করো কিন্তু অপব্যয় করো না। আল্লাহ অপব্যয়ীকে পছন্দ করেন না। বলো, কে আল্লাহ তাঁর স্বীয় বান্দাদের জন্য যেসব সুন্দর বস্তু (উপহার) ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা নিষিদ্ধ করেছে? বলো,পার্থিব জীবন বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এসব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে। এরূপে যারা বোঝে সে লোকদের জন্য নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করি। বলো, আমার প্রতিপালক যেসব বস্তু নিষিদ্ধ করেছেন, তা হলো প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ ও সত্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি (সীমালঙ্ঘন) এবং কোনো কিছুকে আল্লাহ শরিক করা যার কোনো সনদ তিনি প্রেরণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা, যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই। (সূরা আল-আরাফ আয়াত ৩১-৩৩)
শাব্দিক ব্যাখ্যা : জিনাত শব্দের অর্থ সৌন্দর্য, পোশাক, অলঙ্কার। মুফাসসিরদের মতে, এ আয়াতগুলোতে ‘জিনাত’ অর্থ পোশাক-পরিচ্ছদ। ‘তাইয়্যেব’ শব্দের অর্থ পাক-পবিত্র, উৎকৃষ্ট, কল্যাণকর, যা ক্ষতিকর নয়। ইসরাফ শব্দের অর্থ অপব্যয়, অমিতাচার, সীমালঙ্ঘন, বাস্তবিকই যার প্রয়োজন নেই। মুফাসসিরদের মতে, ৩১ নং আয়াতে উল্লিখিত ‘ইসরাফ’ শব্দের অর্থ হারাম খাওয়া, অমিতাচার (অপব্যয়) করা ও সীমালঙ্ঘন করা।
আয়াত নাজিলের পরিপ্রেক্ষিত : তদানীন্তন জাহিলি যুগে আরবের পুরুষেরা দিনে ও নারীরা রাতের বেলায় উলঙ্গ হয়ে কাবাঘরের তাওয়াফ করত। তারা বলত, যে পোশাকে আমরা গুনাহ করেছি সে পোশাকে আমরা তাওয়াফ করব না। আবার কেউ কেউ বলত, এ কাজ আমরা শুভ বিবেচনা করে থাকি; অর্থাৎ যেমন আমরা কাপড়শূন্য তেমনি আমরা পাপশূন্য হয়ে যাবো।’ হজের সময় তারা হজের সম্মানার্থে শুধু প্রাণে বাঁচার জন্য সামান্য আহার করত, চর্বি আদৌ খেত না। এসব দেখে মুসলমানরা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা:! আমরা মুসলমান, আমরাই তো এ ধরনের পদ্ধতি পালনের বেশি হকদার।’ এ পরিপ্রেক্ষিতেই এ আয়াত নাজিল হয়েছে।
তাফসিরকারের মতামত : আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপথী তাফসিরে মাজহারিতে লিখেছেন, জিনাত অর্থ এখানে পোশাক-পরিচ্ছদ। তাফসিরকারদের ঐকমত্যে তাই বোঝানো হয়েছে। মুজাহিদ, কালবি ও ইবন আব্বাসেরও এটাই মত।
মসজিদ বলতে এখানে সিজদার স্থান বোঝানো হয়েছে। এ কারণেই আয়াতটির অর্থ করা হয়েছে, তোমরা প্রত্যেক মসজিদেই কাপড় পরিধান করো, তা তাওয়াফের জন্যই হোক বা নামাজের জন্য। এখানে গোটা নামাজকেই বোঝানো হয়েছে। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে,পানাহার ও আচ্ছাদনের পর্যায়ে অনুসৃত নীতি (উসূল) হচ্ছে সব বস্তুই হালাল, যে পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে তা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয় না।
‘ফি জিলালিল কুরআন’ গ্রন্থ প্রণেতা সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ:) লিখেছেন, আয়াতটির তাৎপর্য কেবল সালাতের সময় বেশভূষা এবং পবিত্র বস্তু পানাহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ওই সব জিনাতের সামগ্রী যা বান্দার জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বা এগুলো হারাম করাকে নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহর দেয়া পোশাক ও পবিত্র খাবার কেউ ইচ্ছামতো হারাম করে নেয়া নিন্দনীয় ব্যাপার। কেননা আল্লাহর দেয়া শরিয়াহ ব্যতীত কারো এ ব্যাপারে কোনো অধিকার নেই।
অর্থনৈতিক তাৎপর্য : ইসলামী অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত বেশকিছু নীতি ও শিক্ষা এ আয়াত ক’টিতে বলা হয়েছে। ৩১নং আয়াতে ইসলামের ভোগের নীতি ও সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, খাওয়া ও পান করাকে কেবল হালালই করা হয়নি বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ইসলামে বৈরাগ্যবাদ বা জীবন বিমুখতার কোনো স্থান নেই। এ নীতির ফলে ইসলামী সমাজে উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহর নির্দেশনাবলির আনন্দময় ভোগ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ইসরাফ বলতে মুফাসসিরগণ বুঝিয়েছেন হারাম খাওয়া ও অতিরিক্ত পানাহার। ইসরাফ না করার নীতির ব্যাপক ব্যক্তিগত ও সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি একটি নৈতিক নীতি হিসেবে কাজ করবে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের পর্যায়ে ঠিক করবে যে,তার কী ভোগ-ব্যবহার করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। এ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় নীতিও আইনের সীমার মধ্যেই সে প্রয়োগ করতে পারবে। এ কথাও সত্য যে,ব্যক্তিপর্যায়ে ইসরাফ কাল ও স্থানের পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। এ জন্যই এর কোনো সর্বকালীন সীমা কোনো আইনে বা বিধিতে ঠিক করে দেয়া সম্ভব নয়।
সামাজিক পর্যায়ে ইসরাফ সংক্রান্ত নীতি আরো ব্যাপকভাবে অনুসৃত হতে হবে। সরকারের পরিকল্পনা, মদানি-রফতানি, উৎপাদন, বণ্টননীতি এমনভাবে তৈরি হতে হবে, যাতে সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশে ইসরাফ উৎসাহিত না হয় এবং ব্যক্তিপর্যায়ে ইসরাফ করার সুযোগ কমে যায়। সরকার নিজেও ইসরাফ পরিহার করবে। ইসলামি নীতিতে তাই আদর্শও কাম্য। এ আয়াতে এ কথাও স্পষ্ট যে Consumerism বা ভোগবাদ ইসলামের নীতি নয়। সম্পদ থাকলেও নয়। কেননা তাতে মানুষ বস্তুবাদী ও ভোগবাদী হয়ে যায় এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়ার বেশি আশঙ্কা থাকে। এ ব্যাপারে ইসলামী অর্থনীতিতে মধ্যপন্থা অনুসরণ করতে হবে।
সরকারি পর্যায়ে ইসরাফ বর্জনের নীতিতে এক দিকে তথাকথিত প্রকল্পের পরিবর্তে এমন সব প্রকল্প হাতে নিতে হবে যাতে দরিদ্র ও অপেক্ষাকৃত ভাগ্যহত লোকদের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব, অন্য দিকে জনসাধারণের ওপর আরোপিত কল্যাণহীন করের বোঝা অপেক্ষাকৃত হালকা হয়।
উল্লেখ্য, যারা অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে প্রয়োজনীয় পোশাক-পরিচ্ছদ সংগ্রহ করতে অক্ষম এবং নগ্ন কিংবা অর্ধনগ্ন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে (বা নামাজ পড়তে) বাধ্য হচ্ছে কিংবা অনাহার ও অর্ধাহারে, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাবে জীবনযাপন করছে, তাদের সমস্যা সমাধানেও সমাজ তথা রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামী সমাজে যত দিন পর্যন্ত একজন লোকও এ জাতীয় সমস্যার আবর্তে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত কোনো মুসলমানের পক্ষে তার নিজের ও পরিবারবর্গের একান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অতিরিক্ত কোনো খরচ ইসরাফ বলে গণ্য হতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনমান উন্নত হবে,এটাই কাম্য।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার ওপর স্বীয় নিয়ামতের নিদর্শন দেখতে পছন্দ করেন। ৩২ নং আয়াতে পবিত্র কথাটির উল্লেখ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামি অর্থনীতিতে অপবিত্র, মানুষের স্বাস্থ্য ও মানসিকতার জন্য ক্ষতিকর কোনো বস্তুর স্থান নেই। এ শব্দটি সে দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ নীতিও কার্যকর করতে হবে। এ আয়াত ও পরবর্তী ৩৩ নং আয়াত প্রমাণ করে যে, মূলত কোনো জিনিসকে হারাম করার অধিকার কেবল আল্লাহর। রাসূল সা: যা কিছু হারাম করেন তাও আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা বলেই। যেমন সূরা আরাফের ১৫৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, উম্মি নবী তাদের জন্য পবিত্র বস্তু বৈধ করে এবং অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে। সূরা আরাফের ৩৩ নং আয়াত ও কুরআনের অন্যান্য জায়গায়ও রাসূল কর্তৃক খুব কম দ্রব্যই হারাম করা হয়েছে। বস্তুত মানবজীবন ও সমাজের জন্য অকল্যাণকর দ্রব্যাদি এবং কার্যাবলি হারাম ঘোষণা করে আল্লাহ মানুষের প্রতি বিরাট ইহসান করেছেন।
অন্য দিকে, নির্দিষ্ট কিছু হারাম ছাড়া বাকি সবই হালালের পর্যায়ে রেখেও আল্লাহ আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে তথা উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ভোগের ক্ষেত্রে স্বাধীন নির্বাচনের এক বিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন, যা মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনয়নে অতীব সহায়ক।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন