গত ১০ মে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি সংবাদ সম্মেলনে ভিশন ২০৩০ রূপকল্প ঘোষণা করেছেন। হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে ২০-দলীয় জোটের বাইরে অন্য কোনো দলের কেউ উপস্থিত ছিলেন না, কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক ছাড়া বাকিরা সবাই ছিলেন দলের নেতা ও কর্মী। ২৫৬ অনুচ্ছেদের ভাষণটির ইংরেজি সংস্করণ বসার আসনে সংরক্ষিত থাকলেও খালেদা জিয়া পাঠ করেছেন বাংলা সংস্করণটি। এটি পাঠ করতে তার সময় লেগেছিল দুই ঘণ্টারও বেশি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হেন কোনো খাত বা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ‘জনকল্যাণে’ সংস্কার বা পরিবর্তন আনা হবেÑ এমন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি প্রতিবেদন তিনি পড়ে শুনিয়েছেন। এসব প্রতিশ্রুতি নিয়ে গত ক’দিন রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানে কথা চালাচালি হচ্ছে, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো অনেক দিন পর আওয়ামী লীগ-বিএনপিসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে টক শো করার সুখ খুঁজে পেয়েছে, সমর্থকরা তা শুনে ‘ধন্য’ হচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য, টক শোর পক্ষ-বিপক্ষ আলোচনা মিডিয়া ও দলীয় সমর্থকদের মনোযোগ আকর্ষণ করার গতানুগতিক ধারায় চলছে, আরও কিছুদিন চলবে, এর পর চাপা পড়ে যাওয়ার স্বাভাবিক নিয়মে পড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলতে যা বোঝায় তা যে খুব একটা হচ্ছে না, হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না- সেটি বোধহয় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এখনই বলে দেওয়া যায়।
আমি লেখার শিরোনামটি যেভাবে রেখেছি তা দেখে অনেকে হয়তো ভ্রু কুঁচকাবেন। তবে যারা দলীয় রাজনীতির মতাদর্শগত চরিত্র এবং ভিত্তি জেনে বা বুঝে রাজনীতি করেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার বিদ্যাশিক্ষা লাভ করেছেন তারা সহজেই বুঝতে পারেন কোন রাজনৈতিক দলের দৌড়, মিশন, ভিশন কী হতে পারে, কোন দল দ্বারা রাষ্ট্র-রাজনীতির সংস্কার কতটুকু হতে পারে। মুখে অনেকেই অনেক ভালো কথা বলেন, কিন্তু সবাই যা বলেন তা যদি তাদের মজ্জাগত হতো তাহলে রাষ্ট্র-রাজনীতির গতিময়তা নিয়ে এতসব সন্দেহ, হতাশা, ক্ষোভ এবং বাস্তবতাবিবর্জিত অবস্থা তৈরি হতো না। একজন মহৎ মানুষ যা বিশ্বাস করেন, কাজ করে থাকেন, একজন জটিল ও কুটিল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী মানুষ তা মোটেও করেন না। রাজনীতিতেও বাহ্যিকভাবে সব দলই তো ভালো কথা বলে মনে হয়, গণতন্ত্রের কথাও বলে থাকে। কিন্তু সবার আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু মোটেও এক নয়। উদারবাদী গণতন্ত্রে যারা বিশ্বাস করেন, যে দল বিশ্বাস করে তার পক্ষে সর্বডানে বা সর্ববামে গিয়ে হঠকারী কিছু করা সম্ভব নয়, আবার ডানপন্থায় বিশ্বাসী ব্যক্তি ও দলের পক্ষে মধ্যপন্থায়, উদারবাদী ভাবাদর্শের রাজনীতি কিছু করাও সম্ভব নয়। এটি আমার মনগড়া বা একটি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয়। এটি হচ্ছে রাজনীতির মতাদর্শগত বৈশিষ্ট্যের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞান। তাই আওয়ামী লীগ যখন দলগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে আওয়ামী লীগের মতাদর্শের পরিধিকে বিবেচনায় রেখেই তা নিয়ে থাকে। দলটি ডানপন্থায় যাওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও ডানপন্থায় বিশ্বাসীরা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করবেই, মনেপ্রাণে খুব একটা গ্রহণ করবে না। বামপন্থাতেও গেলে একইভাবে আস্থা লাভে সমর্থ হবে না। দল হিসেবে এর একটি সুনির্দিষ্ট গ-িবদ্ধ চারিত্রিক অবস্থান রয়েছে, ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে দলটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অপেক্ষাকৃত বিশেষ একটি অবস্থান নিয়ে আছে। অনুরূপভাবে বিএনপির অবস্থানও তাই। তবে তা আওয়ামী লীগের বিপরীতে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি বাংলাদেশের সব ডানপন্থায় বিশ্বাসীর প্রধান ভরসা বা আশ্রয়দাতা। ডানপন্থায় বিশ্বাসীদের প্রায় সবাই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অবিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অনেকেরই বিরোধী অবস্থান এবং ভূমিকা ছিল, সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণ ও বিচ্যুত জাতীয়তাবাদ উদারবাদবিরোধী সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত, উগ্র ও হঠকারী আচরণে বিশ্বাসী গোষ্ঠীর মিত্র পৃষ্ঠপোষক এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সেভাবেই দেশকে পরিচালিত করে থাকে। বিএনপি সর্বদক্ষিণ থেকে মধ্যদক্ষিণ পর্যন্ত সব স্তরের মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী দল, এতে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। বিএনপি যে জাতীয়তাবাদের কথা বলে তা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক, তালগোল পাকানোÑ বস্তুত দ্বিজাতিতত্ত্বের নবসংস্করণ, যে মুক্তিযুদ্ধের কথা দলটি বলে থাকে তাতে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ভীষণভাবে রয়েছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হেনস্তা করার রাজনীতি রয়েছে, বিকৃত ইতিহাস রচনা করে মুক্তিযুদ্ধকে ক্রমাগতভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে। ডানপন্থায় বিশ্বাসীরা এমন বিকৃত আদর্শেরই অনুসারী হয়ে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ডানপন্থায় বিশ্বাসীদের অবস্থান বাস্তবেই পশ্চাৎপদ ও মধ্যযুগমুখী। পৃথিবীর কোনো জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীনতা কোনো ডানপন্থায় বিশ্বাসী নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও ত্যাগে অর্জিত হয়নি। এ পর্যন্ত পৃথিবীর সব শোষণ, বঞ্চনা, উপনিবেশবাদ, পরাধীনতা ইত্যাদি বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধ-সংগ্রাম, আধুনিক রাষ্ট্র গঠন কোনো ডানপন্থায় বিশ্বাসী রাজনীতি, দল বা নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়নি, গঠিতও হয়নি। যে পাকিস্তান রাষ্ট্র ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার মূল নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্বাসে একজন অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রী, কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করায় জিন্নাহর গড়া পাকিস্তান ভাঙতে ভাঙতেই চলছে।
বিএনপি এ পর্যন্ত ১৬ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। এত বছর বিএনপির কাছে বাংলাদেশের সব খাত ও প্রতিষ্ঠানে মৌলিক পরিবর্তনের বা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা জরুরি মনে হয়নি। তেমন কোনো রূপকল্প চিন্তা করার কথা ভাবা হলো না। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তার কথা সাধারণত বামপন্থি দলগুলোই দাবি করে থাকে। আইনের ধারা বাতিল, চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল, মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা আয়, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, সংসদকে জবাবদিহিতায় আনা, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা দেওয়া, সব বাহিনীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করাসহ যেসব সংস্কারের প্রস্তাব বিএনপির চেয়ারপারসন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, সেগুলো শুনে মনে হচ্ছে দেশের বামপন্থি দলগুলো সচরাচর যেসব দাবি করে থাকে, বিএনপির চেয়ারপারসন সেগুলোরই যেন প্রতিধ্বনি করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অতীতে রাজাকার এবং মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বোধহয় এখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নতুন করে আবার মুক্তিযোদ্ধাদের আসল তালিকা প্রণয়ন করার প্রতিশ্রুতির অর্থ রহস্যাবৃত অবস্থায় থেকে কেন আবার সেই তালিকা তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলÑ তা বুঝতে কি অসুবিধা হচ্ছে? একাত্তরের নরঘাতকদের বিচারের বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান সুস্পষ্ট। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির বিকৃত অবস্থানও সবার কাছে স্পষ্ট। তার পরও বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে বিরাট কিছু করার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা একেবারেই স্ববিরোধী, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তামাশা করার শামিল। বিএনপি যখন নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি, আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বলে দাবি করে তখন তাদের ইতিহাস মূল্যায়নের স্বরূপটি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে যখন ২০০১-০৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দেশ থেকে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিতাড়িত করার ধর্মযুদ্ধে নেমে পড়ে, সব সরকারি চাকরিতে ভিন্ন জাতি ও রাজনীতি ধর্ম বিশ্বাসীদের পথ রুদ্ধ করা হয়Ñ তখন স্পষ্ট হয়ে যায় ডানপন্থায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তির চরিত্র কেমন হতে পারে। এমন উগ্র, হঠকারী শক্তিদের হাতে আর যাই হোক দেশের প্রগতি, গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে সেই নজির নেই।
২০০৮-০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ভিশন ২০২১ রূপকল্প এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদির ঘোষণা দেয়, বিএনপি তখন ডিজিটাল শব্দ নিয়েই হাটে-ঘাটে-মাঠে ব্যঙ্গ করেছে, লোডশেডিং হলে ডিজিটাল ডিজিটাল বলে চিৎকার করেছে, পদ্মা সেতু নিয়ে নানারকম কুৎসা রটিয়েছে। কিন্তু এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি নিয়ে বিএনপির কোনো কর্মীই আর ব্যঙ্গ করার সাহস পাচ্ছে না, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পদ্মা সেতু, ঢাকার উড়াল সেতু, মধ্য আয়ের বাংলাদেশ গড়ার বিষয়গুলো নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না। সবাই মনে করছেন ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পরিবর্তিত হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা আছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে। সেই সমালোচনার বিষয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই যৌক্তিক ও তথ্যপ্রমাণভিত্তিক, তবে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে যে রূপকল্প জাতির কাছে উপস্থাপন করেছে, তার ধারা-উপধারা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার সরকারের সাফল্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা এই সময়ে দেশকে ভিশনারি ও মিশনারি নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দেশ সে কারণেই অভূতপূর্ব উন্নয়নের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভাবমূর্তি এখন অবশ্যই সুবিদিত। দেশকে এমন পরিবর্তনের মহাসড়কে নিতে পারে উদার গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কোনো ডান ও রক্ষণশীল নেতৃত্ব নয়। আওয়ামী লীগ ভিশন ২০২১ প্রদান করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পেরেছে, দলটি ভিশন ২০৪১ ঘোষণা করার পর ২০৩০ সালকে জাপটে ধরেছে বিএনপি। বিএনপি নেতৃত্ব এসব অবস্থা বুঝতে পেরে বিগত সম্মেলনে ভিশন ২০৩০-র কথা উল্লেখ করেছে। এখন সেই রূপকল্পের যে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে তা শুনতে ভালো লাগলেও কোনো ডানপন্থায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তির দর্শনে প্রগতিশীল, অগ্রসর কোনো ভিশন মিশন থাকে না। এ কথা রাজনীতিতে যারা তাত্ত্বিক জ্ঞান রাখেন তাদের বিশ্বাস করাতে পারার কোনো কারণ নেই। যারা অন্ধ আবেগ ও বিশ্বাস দিয়ে রাজনীতি করেন তারা তাতে পা দিতে পারেন। কিন্তু তাতে দেশ ও জাতির ভাগ্যে কোনো ইতিবাচক মহৎ পরিবর্তন সাধিত হওয়ার নয়, প্রতারিত হওয়া ছাড়া। ডানপন্থিদের দর্শন রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক হলেও কৌশল গ্রহণে তারা বামপন্থিদের গুরু মানে, অনুসরণ করেÑ যদিও তারা প্রকৃত বামদের নাস্তিক অপবাদ দিয়ে রাজনীতিকে আদর্শহীন ও অর্থহীন করে ফেলেছে। খালেদা জিয়ার রূপকল্প ঘোষণায় ডানদের উপস্থিতি থাকলেও বামরা ছিলেন না, তবে ইংরেজি সংস্করণে প্রতিবেদন প্রচার করে বিদেশিদের যদি মন গলানো যায়- তাহলে মন্দ কী? এ করে কি নিজের স্বরূপ লুকানো যায়?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন