বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে তখন দেশটিতে জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তরুণদের একটি অংশ সন্ত্রাসী কর্মকা-ে যুক্ত হওয়া যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়।
এমনিতেই ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করা বাংলাদেশের জন্য মোটেও সহজ কাজ নয়, তার ওপর জঙ্গিদের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি, দেশি-বিদেশি মানুষ খুন করার নেশা দেশকে ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সংকটে ফেলে দিতে পারে। এই মুহূর্তে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মুসলিমপ্রধান বেশ কটি দেশে জঙ্গিদের অপতৎপরতার ফলে দুর্ভিক্ষাবস্থা, সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে যদি জঙ্গিবাদের প্রভাব ওইসব দেশের মতো বেড়ে যায় তা হলে এই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেমে যাওয়া মোটেও অসম্ভব কিছু হবে না। তেমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার বর্তমান আপাত সন্তুষ্ট অবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক সচেতনতার চেয়ে নানা বিভ্রান্তি, দোদুল্যমানতা, অপরাজনীতি, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদিই বিরাজ করছে। তাই জঙ্গিবাদ সৃষ্ট বিপদ সম্পর্কে সব মহলকে এখনই সচেতন হতে হবে। সর্বশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগর এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় চালানো অপারেশন ঈগল হান্ট গত বৃহস্পতিবার বিকালে সমাপ্ত হয়েছে। অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে।
জঙ্গিবাদ নিঃসন্দেহে এই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উগ্র বৈশ্বিক ধর্মান্ধ রাজনৈতিক মতাদর্শ- যার প্রভাবে তরুণদের একটি অংশ খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে মানুষ হত্যার নেশায় আত্মহননের মতো পথ বেছে নিতে মোটেও দ্বিধা করছে না। মূলত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর বিশ্ব রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে মতাদর্শের যে সংকট ও শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তার স্থলে মুসলিম দেশগুলোয় উগ্র ধর্মান্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবাদর্শ জায়গা করে নিতে থাকে। বিশেষত পশ্চিমা দুনিয়ার লগ্নি পুঁজিপতি গোষ্ঠী এক সময় বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে প্রতিহত করতে অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠীকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিল, সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পর সেসব ‘যোদ্ধা’ই জেহাদ সংঘটিত করার স্বপ্ন থেকে, মুসলমানদের জন্য পৃথক খেলাফত তথা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নানা ধরনের সংগঠন গড়ে তোলে। সত্তর-আশির দশক-পরবর্তী সময়ে তালেবান, আল কায়েদাসহ উগ্র জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম দেশগুলোয় পশ্চিমা রাষ্ট্রব্যবস্থাবিরোধী প্রচারণার বিস্তার ঘটাতে থাকে, নিজেদের জন্য বিকল্প ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জেহাদ ঘোষণা করে। সর্বশেষ আইএস প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের লক্ষ্যাভিযানের সাফল্য হিসেবে ভাবা হয়েছিল। মূলত এদের হাতে তখন একদিকে বিপুল অর্থ-সম্পদ, অন্যদিকে অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিজ্ঞতা জমা ছিল। এসবকে সম্বল করে জঙ্গিবাদী নেতৃত্ব তা দেশে-বিদেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে থাকে, আমাদের মতো দেশগুলোয় নানা ধরনের জঙ্গিবাদী সংগঠন এবং তাদের অপতৎপরতা সেভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, উঠতি তরুণদের সাম্প্রদায়িক অংশকে সহজেই এরা আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। গত তিন দশকে পৃথিবীব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতিকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে এসব দেশের তরুণদের মগজ ধোলাইতে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। একইভাবে প্রশিক্ষিত ও নবদীক্ষিত জঙ্গিরা সরকার উৎখাতে লিপ্ত হওয়া, পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া, দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মতো কর্মকা-ে যুক্ত হয়। অনেক তরুণই জেহাদ শব্দের ধর্মীয় এবং জঙ্গিবাদী ব্যবহারের পার্থক্য বুঝতে না পেরে নিজ বুদ্ধিমতো বিশ্বাস থেকে এসব সংগঠনে যুক্ত হতে থাকে, এক ধরনের উগ্র হঠকারিতা ও রোমান্টিকতায় আপ্লুত তরুণরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। মূলত ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী না হয়েই উঠতি তরুণদের এই অংশটি ইসলামি সমাজ ও জীবনব্যবস্থার কাল্পনিক চিত্র মনে মনে এঁকে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হচ্ছে। অনেক বিত্তশালী মানুষ ও সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী না বুঝে এদের অর্থবিত্ত দিয়ে সাহায্য করে থাকেন, অনেকে আবার জীবন উৎসর্গ করতে ঘর, পরিবার, এমনকি দেশত্যাগ করছেন। এক ধরনের আবেগ ও অন্ধবিশ্বাস তথা উত্তেজনা এ ক্ষেত্রে ভীষণভাবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে সমাজ বিপ্লবের অনুসরণে জঙ্গিবাদী মতাদর্শ এই সময়ের মুসলিম তরুণদের অনেককেই জেহাদে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে ধর্ম, রাষ্ট্র ও মানবজীবন ব্যবস্থার আধুনিক জ্ঞানের বিস্তর অভাব। অনেকে পবিত্র ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণাকে অবিচ্ছেদ্য ভেবেই এর প্রতি যুক্ত হচ্ছে, অনেকের মধ্যেই রয়েছে সামগ্রিকভাবে ধর্ম, রাজনীতি, পরকাল ও বিশ্ববাস্তবতার জটিল বিষয় নিয়ে সীমাহীন অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি। এসব কাটিয়ে ওঠার মতো জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার তেমন কোনো সুযোগ এসব দেশে নেই। ফলে জটিল মতাদর্শগত সংকটের মধ্য দিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর তরুণরা বর্তমান সময়টিকে অতিক্রম করছে। এই সুযোগে জঙ্গিবাদীগোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন সংস্থা ও প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের যে পুনর্জন্ম শুরু হয়, এটির চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে বিগত দেড়-দুই দশকে জঙ্গিবাদের দিকে তরুণদের একটি অংশ ঝুঁকে পড়ার। দুঃখজনক হলেও সত্য, জঙ্গিদের ভয়াবহ নৃশংসতা, অমানবিক সহিংসতা, অপতৎপরতার পরও এদের জঙ্গি মতাদর্শ থেকে সহজে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমাদের গোটা সমাজও আন্তরিকভাবে ততটা শক্তভাবে দাঁড়াচ্ছে না, যতটা হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। এর কারণ হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বিদ্যমান থাকায় বৃহত্তর সমাজ এর দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছে যে, এখন তা থেকে বের হতে দ্বিধাগ্রস্ত। এর থেকে মুক্ত হতে পারছে না, দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং সামাজিক চিন্তা এ থেকে সেভাবে মুক্তও নয়। আমাদের ধর্মাধিষ্ঠানগুলো জঙ্গিবাদ সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই নীরবতা পালন করছে। জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বাংলাদেশে এক-দু’বছর আগেও মিশ্র ধারণা, দুর্বলতা এবং বিভ্রান্তি সর্বত্র লক্ষ করা গেছে। হলি আর্টিজান, শোলাকিয়া এবং এর পরবর্তী হত্যাকা-ের ভয়াবহতা সমাজে কিছুটা নাড়া দিতে সক্ষম হলেও সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন ও দোদুল্যমান সমাজে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তথা গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সচেতনতা সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখনো রাজনৈতিক শক্তির বড় অংশই জঙ্গিবাদের বিষয়টিকে নানাভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে, প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষভাবে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করছে, বিরোধী দলকে দমনের নামে জঙ্গি ইস্যুকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগও করা হচ্ছে। এখানেই জঙ্গিবাদের ভয়াবহ মতাদর্শের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটি অভিন্ন জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সমস্যা নিহিত বলা হলে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। ব্যক্তি জঙ্গিকে ভয় করাই যথেষ্ট নয়, জঙ্গিদের উগ্র মতবাদকে পরিত্যাগ করার মতো রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সচেতনতা বৃহত্তর মানুষের মধ্যে তৈরি করা জরুরি বিষয়। সেটি বেশ কঠিন কাজ। এ পর্যন্ত সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যথাযথভাবে করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করে উপায় নেই। তবে এই দায়িত্ব একা সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পালন করলে হবে না, সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা তুলে ধরার গুরুদায়িত্ব রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবীসহ সব সচেতন মহলকে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের সমাজে জগদ্দল পাথরের মতো আসন গেড়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতার উৎসমূলকে বন্ধ করতে হবে, উদারবাদী ভাবাদর্শকে রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চায় প্রাধান্য দিতে হবে। দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক সব গোষ্ঠীর চরিত্রকে জনগণের কাছে তুলে ধরার কাজকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, বিশ্বজনীনবোধ, সহাবস্থানের নীতি অনুসরণের চর্চাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। জঙ্গিবাদকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেয় এমন রাজনীতির স্বরূপ যথাযথভাবে উন্মোচন করা অপরিহার্য। একইভাবে আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বেড়ে গেছে। সে কারণে সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং পাঠদানের প্রবণতা রোধ করতে হবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গিসহ বিজ্ঞানচেতনা, মানব সমাজ ও সভ্যতার উত্থান এবং ক্রমবিকাশের জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা প্রদানের ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে না উঠলে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের প্রভাবমুক্ত নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব কল্পনা। একই সঙ্গে দেশের গণমাধ্যমকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদার গণতন্ত্রের সেবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত করতে হবে। বিশেষভাবে ভূমিকা নিতে হবে আমাদের মসজিদ, মাদ্রাসাসহ ধর্মাধিষ্ঠানে কর্মরত মানুষদের। ইসলামের উদারবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, দেশপ্রেম ও ধর্মচিন্তাকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে এসব প্রতিষ্ঠান যেন অবদান রাখে সেটিকে গুরুত্ব দিতেই হবে। বস্তুত ধর্মের নাম করে পরিচালিত জঙ্গিবাদ একটি উগ্র মতাদর্শ, যা ইসলামের মূল আদর্শের পরিপন্থী। এর হঠকারিতা সম্পর্কে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বিধাহীন ধারণা তৈরি করার মাধ্যমেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। এর জন্য আগে প্রয়োজন বহুমাত্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শ্রেণি-পেশার সংগঠনগুলোর উদ্যোগ নেওয়া- যা জনসচেতনতা তৈরি এবং জঙ্গিবিরোধী মতাদর্শকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন