অবশেষে সড়ক পরিবহন শ্রমিক এবং মালিক সমিতির ডাকা দুদিনের আকস্মিক ধর্মঘট বুধবার তিনটায় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ঘোষণার পর প্রত্যাহার করা হয়। ফলে দুদিনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান হয়, মানুষ চরম ভোগান্তি থেকে আপাতত মুক্তি পায়। জানি না, এতে কার কী লাভ হলো, তবে সাধারণ মানুষ দুদিন রাস্তায় নাকাল হলো, পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তাঘাটে অবরোধ সৃষ্টি করে যে তা-ব চালিয়েছিল তা মানুষকে হতচকিত করেছে, কোত্থেকে এসব উচ্ছৃঙ্খল তরুণ রাস্তায় রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করে, টায়ার পুড়িয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে অংশ নিয়েছেÑ তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। এদের আচরণ, ভাষা এবং যানবাহনে আক্রমণের ধরন এতটাই মারমুখী ছিল যা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক জায়গায় পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে আসতে সাহস পাননি বলে মনে হয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই মুখে সরকারবিরোধী সেøাগান এবং গালিগালাজ ছিল, আইন-আদালত না মানার কথা উচ্চারিত হচ্ছিল। যারা খুব কাছ থেকে এদের রাস্তা অবরোধের কর্মকা- অবলোকন করেছেন, তারা এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করেছেন। আরও দুদিন এই ধর্মঘট বহাল থাকলে শেষ পর্যন্ত এটি কোনদিকে মোড় নিত বলা মুশকিল। তবে পরিবহন শ্রমিক এবং মালিক সমিতি সড়কপথে দুদিন যা দেখিয়ে দিয়েছে তার নেপথ্যের শক্তি এবং তাদের উদ্দেশ্য সাধনের বিষয়টি সবার মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এবং প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙার শক্তিমত্তার প্রদর্শন হিসেবেই বেশি বেশি আলোচিত হচ্ছে। এটি শেখ হাসিনার সরকারের ভাবমূর্তিতে এই মুহূর্তে এক ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন লাগিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সরকার বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছে বা নেবে তা সরকারই ভালো বলতে পারে। তবে দেশের আমজনতা এতে এক ধরনের অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছে। এমন উচ্ছৃঙ্খল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করার পেছনে যারাই থাকুক না কেন, তারা দেশ ও সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেছে। দুদিনের সড়কপথের নৈরাজ্যকে মোটেও হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এই ধর্মঘটটি শ্রম আইনের দিক থেকেও গ্রহণযোগ্য ছিল না, দেশের আইন ও বিচারালয়ের দিক থেকে তো প্রশ্নই ওঠে না। এটা আদালত অবমাননার চরম নজির সৃষ্টি করেছে। নিম্ন আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে শ্রমিক নেতা এবং পরিবহন ফেডারেশন দেশের উচ্চ আদালতে যেতে পারে, সেখানে তাদের প্রতিকার চাওয়া এবং পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, সরকার বা জনগণ কোনো গাড়িচালককে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদ- শাস্তি প্রদান করেনি। অথচ পরিবহন শ্রমিকরা, তাদের সমিতি, মালিকদের ফেডারেশন ধর্মঘটটি ডেকেছে সরকারের বিরুদ্ধে, জিম্মি করেছিল দেশের নিরীহ জনগণকে। জনগণ কোনো শ্রমিককে রাস্তায় আক্রমণও করেনি, ড্রাইভারকেও মৃত্যুদ- দেয়নি। অথচ পরিবহন শ্রমিক এবং তাদের মালিক সমিতিগুলো আদালতের রায় প্রত্যাহার করার দাবি জানাল সরকারের কাছে। এসব সংগঠনের সভাপতি বলে পরিচিত নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সরকারের মন্ত্রী হয়ে বললেন, ‘পরিবহন শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছে। আবার তিনিই এপক্ষ-ওপক্ষের সঙ্গে সভা করে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তার সব নৈরাজ্য বন্ধ হয়ে গেল, শ্রমিকরা সুবোধের মতো স্বেচ্ছায় অবসর থেকে বের হয়ে এসে কাজে যোগদান করল, দেশব্যাপী যানবাহন চলতে শুরু হলো। দেখা যাচ্ছে, দেশের লাখ লাখ পরিবহন শ্রমিক ও মালিক মন্ত্রী শাজাহান খানকে মানছে পীর-দরবেশের মতো। এটি ভালো কথা। মন্ত্রী মহোদয় আগের দিনই তো পারতেন বন্ধ করে দিতে, আইনি বিষয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে সুরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারতেন। তিনি দুজন চালকের শাস্তির রায়টি সম্পর্কে অবহিত থাকার পরও কেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় সপ্তাহজুড়ে নৈরাজ্যকর অবস্থা চলতে দেওয়া হলো, অবশেষে মঙ্গল-বুধবার দুদিন দেশব্যাপী এমন অবৈধ ধর্মঘট ডাকতে পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের চলতে দিলেনÑ তা মোটেও বোধগম্য নয়। এই ধর্মঘটের ফলে পরিবহন শ্রমিক এবং মালিকরা দেশের জনগণের সব সহানুভূতি হারিয়েছে, পরিবহন খাতকে দেশের অন্য সবকিছু থেকে আলাদা অপশক্তি হিসেবে অতীতের ভাবনাকে নতুন করে দেখেছে। যদিও পরিবহন খাতকে একটি সেবা খাত হিসেবে সবাই অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু এই খাতে সেবার আড়ালে নানা ধরনের অপশক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। পরিবহন খাতের সেবা নিতে গিয়ে মানুষ কীভাবে নাকাল হয়, বাড়তি অর্থ দিতে বাধ্য হয়, জিম্মি হতে হয়Ñ তা কী অস্বীকার করার মতো বাস্তবতা রয়েছে? গোটা দেশ দুদিন পরিবহন শ্রমিক এবং মালিকদের কাছে জিম্মি ছিল, খুলনা-যশোর অঞ্চলের মানুষ প্রায় ৬ দিন জিম্মি ছিল। সরকার কিছুই করতে পারেনি। এর অর্থ হচ্ছে, দেশে সরকারের চেয়েও বড় শক্তি হচ্ছে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরাÑ যারা চাইলে মানুষের যাতায়াত বন্ধ করে দিতে পারে, আবার চাইলে ঘণ্টার মধ্যেই তা নিরসন করে দিতে পারে। পৃথিবীর সর্বত্রই পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিকরা নানা যৌক্তিক কারণে আন্দোলন করে থাকে, অবরোধ, হরতাল ও ধর্মঘটের মতো কর্মসূচিও তারা দিয়ে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এমন পরিস্থিতির আইনগত ভিত্তি শ্রমিক-মালিকদের পক্ষে থাকার কারণে মানুষ নিজেদের কষ্টের পরও শ্রমিকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এই ধর্মঘটের কোনো যৌক্তিক, নৈতিক ও আইনগত ভিত্তিই ছিল না। সে কারণে এই ধর্মঘটের পক্ষে এক শতাংশ মানুষও খুঁজে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। অধিকন্তু আন্দোলনকারীরা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করছিল, সেগুলোর কোনোটিই সরকারকে স্পর্শ করে না, সম্পূর্ণরূপে আদালতেই এগুলোর প্রতিকার চাইতে হবে। অধিকন্তু আন্দোলনকারীদের কথা শুনে মনে হয়েছে, তারা দেশের আইন মানতে যেন বাধ্য নয়, একইভাবে বিচারের ঊর্ধ্বে নিজেদের পেতে চায়। কোনো গাড়িচালক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী না হলে আদালত তাকে শাস্তি দেবেন এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে কেউ যদি সত্যি সত্যিই দায়ী হয় তাহলে সে উপযুক্ত শাস্তি পাবে নাÑ তা কী করে হয়! দেশের সরকারপ্রধানই যেখানে আইন ও বিচারের ঊর্ধ্বে নন, সেখানে একজন ট্রাক বা গাড়িচালক কীভাবে আশা করে, যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদ-াদেশের মতো শাস্তি নিয়ে কেউ গাড়ি চালাতে আসবে না। কোনো গাড়িচালক সতর্কভাবে গাড়ি চালালে, নিয়মনীতি মেনে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা শূন্যের কাছাকাছি থাকে। পরিবহন খাতে অসংখ্য সচেতন গাড়িচালক ছিল বা আছে, যারা এই পেশা থেকে চমৎকারভাবে কাজ শেষে অবসরে যায়। সেই সংখ্যাই বেশি কিন্তু পরিবহন খাতে যেভাবেই হোক অনেক গাড়িচালকই রয়েছে, যাদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, জীবনবোধেরও অভাব রয়েছে। তাদের হাতেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। যে দুজন গাড়িচালক সম্প্রতি আদালত থেকে শাস্তি পেয়েছে তাদের একজন ইচ্ছে করেই স্বামী-স্ত্রীর ওপর ট্রাক তুলে দিয়েছিল, স্বামী ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন, স্ত্রী বাঁচতে পারেননি, ট্রাকের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। এই ট্রাকচালকের বিষয়টি মোটেও দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল ইচ্ছাকৃত হত্যা। আদালত তাই ট্রাকচালককে মৃত্যুদ- দিয়েছেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি একটি সড়ক দুর্ঘটনা, যেখানে বিপরীত দিক থেকে আসা বাসচালক জামিলের অসতর্ক গাড়ি চালানোর প্রমাণ ছিল বলেই আদালত বাসচালক জামিলকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন। জামিল বা তার সংগঠন নিম্ন আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চতর আদালতে যেতে পারে, সেখানে হয়তো শাস্তির ধরনও ভিন্নতর কিছু আশা করতে পারে। এই বিষয়গুলো ব্যক্তিগত দায়, কোনো পেশা বা সমিতিরও নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ব্যক্তিগত দায় বা বিচারকে পরিবহন শ্রমিক এবং মালিকরা সহজে মেনে নিতে পারছে না। তারা কি সমাজের অন্য পেশার লোকজনকে অপরাধীর জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে দেখে না? ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো অপরাধের বিচার দেশের আদালতে হলে নিশ্চয়ই আমার কর্মক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি আদালতের রায় বা দ-াদেশকে প্রতিবাদ করার কথা কল্পনাই করতে পারে না। আমরা সেটি করিও না। দেশের অন্যান্য পেশায়ও একই অবস্থা। কোনো ব্যক্তির অপরাধ, অন্যায়Ñ যা কিছুই ঘটে তার জন্য সেই ব্যক্তিকেই শাস্তি পেতে হয়, চাকরি হারাতে হয়, জেলে যেতে হয়, গুরুতর অপরাধ হলে ফাঁসির দ-ও হতে পারে, হয়েও থাকে। কিন্তু এর জন্য পেশার সংগঠনকে দায়মুক্তির জন্য কেউ ব্যবহার করে না, সমিতিগুলো তা করেও না। এটি মোটেও আইনসম্মত নয়। যদিও আমাদের দেশে কোনো সংগঠন কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি দিয়ে থাকে, যা মোটেও কাম্য নয়। এমনটি হওয়া মোটেও শোভনীয় নয়। দেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক সময় শ্রমিক সংগঠনগুলোর গৌরবময় ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেই ঐতিহ্য বেশিরভাগ শ্রমিক সংগঠন ধরে রাখতে পারেনি। না পারার কারণ অনেক। তবে প্রধান কারণ হচ্ছেÑ স্বেচ্ছাচারিতা, শক্তির প্রয়োগ, অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা। ফলে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই লাটে উঠেছে। আমরা আশা করব, বিশাল পরিবহন খাতে যেসব সংগঠন রয়েছে সেগুলো শ্রমিককল্যাণ, মানবসেবা ইত্যাদি আইনানুগ কর্মকা-ে যুক্ত থাকবে, দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখবে। একুশ শতকের পরিবহন খাত অনেক বেশি বর্ধনশীল। এখানে আইন, নিয়মনীতি, শৃঙ্খলা, উচ্চতর দক্ষতা, মানবিক মূল্যবোধের চর্চাকেই গুরুত্ব দিতে হবে, শক্তির প্রয়োগ নয়, দায়মুক্তির চেষ্টাও নয়। তা হলেই বাংলাদেশের পরিবহন খাত উন্নত দুনিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিতে সক্ষম হবে।
মমতাজউদ্দীন পাটওয়ারী, অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন