একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে সেই পাকিস্তানকাল থেকে এখনো পর্যন্ত দেশে দুটি চিত্র দেখা যায়। একদিকে শিশু-কিশোর থেকে বয়স্ক নারী-পুরুষদের অনেকেই শহীদ মিনারে ফুল দেন, শ্রদ্ধা জানাতে আসেন, অন্যদিকে একটি বড় অংশ জনগোষ্ঠী কোনোভাবেই এসবে অংশ নিতে চায় না। কোনদিকে মানুষের পাল্লা ভারী হচ্ছে তা মাপা কঠিন, গণনা করে বলাও সম্ভব নয়। তবে প্রেরণার জায়গা থেকে একুশকে বোঝা, ধারণ করা খুব সহজ কাজ নয়। পাকিস্তানকালে যারা একুশ উদযাপন করতেনÑ তাদের বেশিরভাগই চেতনার আকর্ষণ থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হতেন, একে বৃহত্তর জনমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করতেন। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই একুশ বেশ সীমিত পরিসরে আয়োজিত হতো। পরিসর ক্ষুদ্র হলেও এর প্রভাব এবং প্রসার ছিল দ্রুত বর্ধনশীল। কেননা এর মধ্যে নিহিত ছিল জাতিগত পরিচয়ের প্রেরণা তুলে ধরা, মানুষকে পথ দেখানো, জাতীয়তাবোধের মূলে মানুষকে ভাবতে শেখানো। সে কারণে পাকিস্তানকালে রাষ্ট্র-রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও একুশ ছিল পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে আলোকিত ভুবন তৈরির এক বিপ্লবাত্মক উৎসÑ যা ক্রমেই মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তবে এখনো একুশ নিয়ে কারো কারো মধ্যে দ্বিধা ছিল, কূম-ূকতার সংশয় ও প্রচারণা ছিল। অন্ধ পাকিস্তানপ্রীতিতে যারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল তারা এখনো একুশকে বাঁকা চোখে দেখছে, সংশয় প্রকাশ করছে, একুশকে নিয়ে ধর্মের প্রশ্ন তুলে নিজেদের আলাদা রাখার চেষ্টা করছে। তার পরও শিক্ষামুখী তরুণরা একুশকে নিজেদের মাতৃভাষার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত দিবস হিসেবে বুঝতে শিখেছে। এর মাধ্যমে পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ও বিকাশ ঘটেছে, রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক ধারার উত্থান ঘটেছে। ১৯৬৬-উত্তরকালে পূর্ববাংলা একুশের ভাষা-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক দ্যোতনায় বেগবান হয়েছেÑ তা থেকেই ঊনসত্তর, সত্তর ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে একুশের প্রেরণা ও চেতনা কেবলই ঊর্ধ্বমুখী হবে, সমাজ ও রাষ্ট্র সেভাবেই আধুনিক মানদ- অর্জন করবে। কিন্তু বাস্তবতা ততটা সহজ বা সরলভাবে চলেনি, বিকশিত হয়নি। না পারার অনেক কারণ রয়েছে। তবে মোটা দাগে ১৯৭৫-উত্তর রাষ্ট্র-রাজনীতির উল্টো চলাটি আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে আবার সাম্প্রদায়িকতার বিষয়গুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হলো, জাতিরাষ্ট্রের চরিত্রকে দুর্বল করে দেওয়া হলো। মুখে একুশের কথা বলা হলেও, রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও জাতিতাত্ত্বি¡ক ধারণাকে অঙ্কুরে দুর্বল করে দেওয়া হলো। রাষ্ট্র ও সমাজ অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের বিকাশকে বাধাহীন করা হলো, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনাকে কঠিন ও জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দেওয়া হলো। মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদার চোখে দেখা, এর মাধ্যমে বিকশিত মানুষরূপে গড়ে ওঠার বিষয়গুলোকেই দুর্বোধ্য, অসম্ভব এবং প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। তিনটি ভাষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের সমাজ বিভক্ত হয়ে গেল। অভিজাত শ্রেণি ইংরেজিমুখী হলো, সেই শিক্ষাকেই তারা জীবন ও বিত্ত প্রতিষ্ঠার প্রধান উপায় হিসেবে ভাবতে শুরু করে। মাতৃভাষা তাদের কাছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় মর্যাদার আসন পেলেও তেমন কিছু যায় আসে না। অন্য একটি বিরাট অংশ ইংরেজি মাধ্যমকে ব্যয়ভার বহনের জন্য ধরতে না পারার কারণে কিছুটা ছিটকে পড়েছে। তারা বাংলা, ইংরেজি ও ধর্মভাষা আরবির তিনস্তরের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কার্যত এরা বাংলা, ইংরেজি ও আরবির কোনোটিই দক্ষতার সঙ্গে অর্জন করতে পারছে না। অন্য ধারাটি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভাষাকে না দেখে কেবলই ধর্মীয় লাভ-ক্ষতির বিশ্বাস থেকে আরবি ভাষাকেন্দ্রিক শিক্ষায় আবদ্ধ রেখেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাকেন্দ্রিক বাহনকে গুরুত্ব দেওয়ার অবস্থান থেকে একুশকে দেখা, বোঝা এবং অবস্থান নেওয়া না-নেওয়ার একটি অবস্থান দেশে দৃশ্যমান হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করায় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিবস পালনে এগিয়ে এলেও মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার উপলব্ধি কতটা বুঝতে পারছেÑ তা স্পষ্ট নয়। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো একুশ উদযাপনে আনুষ্ঠানিকতা প্রদর্শন করে থাকে। সে কারণে এই দিন দেশের নগর-শহর-উপজেলা শহরগুলো পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক একুশ উদযাপিত হয়ে থাকে। এতে স্থানীয় স্কুল ও কলেজ, বিশ্ববিদ্যাৎলয়পড়–য়া ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অংশগ্রহণ করে থাকে। ঢাকা শহরে অবশ্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগেও প্রভাবফেরিতে দল বেঁধে অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। বড় বড় শহরেও প্রায় অভিন্ন চিত্র লক্ষ করা যায়। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি একসঙ্গে গেয়ে পথচলায় অংশ নেওয়ার স্রোতে অনেকেই অংশ নিচ্ছেন। এর বাহ্যিক গুরুত্বকে অবশ্যই বিবেচনায় নিচ্ছি। এমনকি এখন গ্রামাঞ্চলেও স্কুল ও কলেজকেন্দ্রিক একুশকে উদযাপনে যুক্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, শহীদ মিনার নেইÑ এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রতীকী মিনার তৈরি হচ্ছে, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও জানতে পারছে ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস, রফিক, শফিক, জব্বারসহ ভাষাশহীদদের নাম, পাকিস্তানের বাংলা ভাষাবিরোধী রাজনীতি, গুলি করা ইত্যাদি বিষয়। যেহেতু পাঠ্যবইতে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৭-৫২ সালে আন্দোলন গড়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে তাই শিক্ষার্থীরা দিবসটি পালনে এক ধরনের আবেগ-অনুভূতির স্পর্শ পায়। তবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেদিন প্রতিটি গ্রামে দলবেঁধে দিবসটি পালনের জন্য এগিয়ে আসবে, শহীদ মিনারকে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর প্রতীকী স্থাপনা হিসেবে গ্রহণ করবে সেদিন দিবসটির আনুষ্ঠানিকতা বিস্তৃত হবে, সমৃদ্ধ হবে। এখনো ২১ ফেব্রুয়ারি শহরকেন্দ্রিক, বড়জোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পালিত হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে যে বার্তাটি বোঝা যায় তা হচ্ছে, মাতৃভাষা কেবলই লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজন। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দিবসটি উদযাপন করে থাকে। এই ভাবনাটি একেবারেই অসম্পূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকরও। শুধু সাধারণ মানুষের পর্যায়েই নয়, দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসাও ২১ ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতা ও চেতনাকে গ্রহণ করছে না। শহীদ মিনার এবং পুষ্পস্তবক অর্পণের বিষয়টিকে এরা শহীদদের প্রতি, তাদের জীবন উৎসর্গের প্রতি প্রতীকী শ্রদ্ধার অংশ হিসেবে দেখছে না। এটিকে তারা ধর্মবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে ওইদিনে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের দরজাই শুধু বন্ধ করে রাখে না, শিক্ষার্থীদেরও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা অর্জনের গুরুত্ব উপলব্ধিতে অংশ নিতে দিচ্ছে না। মাদ্রাসাগুলো শহীদ মিনার এবং পুষ্পার্ঘ্যকে গ্রহণ না করেও ভাষাকেন্দ্রিক শিক্ষার চর্চা, মানুষের জীবন ও জ্ঞানচর্চার উন্মেষের অপরিহার্য বাহন হিসেবে দেখার উপলব্ধি থেকে পালনের ধারা সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু সেই উদ্যোগও তাদের মধ্যে নেই। প্রকৃতপক্ষে ধর্ম শিক্ষার জন্যও মানুষের মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মাতৃভাষায় মাদ্রাসাগুলো ধর্ম শিক্ষা এবং গবেষণার শিক্ষাক্রম চালু করলে শেষ বিচারে তারাই অনেক বেশি উপকৃত হতে পারত, লাভবান হতো। কিন্তু তেমন ভাবনা-চিন্তা বেশিরভাগ মাদ্রাসা শুরু থেকেই গ্রহণ করেনি। পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকীর্ণতা সেই সময় বেশিরভাগ মাদ্রাসাকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে টলাতে পারেনি। পাকিস্তান এবং ইসলামকে এসব মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই সমার্থক হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিল। ফলে তারা মাতৃভাষার গুরুত্বকে ধর্ম শিক্ষার জন্যও যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। সেই রাজনৈতিক প্রবণতা থেকে অনেকেই বের হওয়ার চেষ্টা করেনি। প্রকৃতপক্ষে ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস, উপকরণ ইত্যাদি গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়গুলো মাদ্রাসা শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে ভাষাতত্ত্বের উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার বাইরে থাকার ফলে নানা ধরনের অন্ধ বিশ্বাসের আবর্তে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরতে থাকে, যেখান থেকে মুক্ত হওয়া এদের পক্ষে মোটের ওপর অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাতৃভাষা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, উচ্চতর গবেষণা, এমনকি বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার বিষয়গুলো সম্পর্কেও এদের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের অহেতুক ভয়ভীতি, বিযুক্তি। পৃথিবীর জ্ঞানজগতের নানা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়ে গভীরে প্রবেশের সুযোগ গ্রহণ না করার পরিণতিতে মাদ্রাসাগুলোকে উচ্চতর গবেষণা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, আধুনিক বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চা থেকেও এরা অনেক বেশি পিছিয়ে গেছে। এর ফলে এক ধরনের জ্ঞানাতঙ্ক বিরাজ থেকেই নিজেদের গুটিয়ে রাখা, মুক্ত রাখা। সে কারণেই জাতীয় স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং মাতৃাভাষাকেন্দ্রিক শহীদ দিবসে দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসা এবং তাদের লাখ লাখ শিক্ষার্থী নির্লিপ্ত থাকে, এগুলো থেকে দূরে থাকে। বিষয়গুলোকে তাদের উপলব্ধির জায়গায় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। অধিকন্তু জাতীয় ইতিহাসের এমন আবেগ, চেতনা, শিক্ষাগ্রহণ এবং উজ্জীবিত হওয়ার অধ্যায়গুলো সম্পর্কে পশ্চাৎপদ ও অগ্রসর বিরোধী চিন্তা-চেতনায় অবস্থান নিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ধর্ম শিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসাগুলো পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দেশ ও জনগণের চাওয়া-পাওয়ার বিপরীতে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানুষকে আলোর পথ দেখায়, আধুনিক যুগোপযোগী ব্যাখ্যায় সবকিছুকে বুঝতে শেখায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য শেখায়। দরজা বন্ধ রেখে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এমন প্রয়োজনীয় বিদ্যা শিক্ষা লাভ করতে পারার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা জাতির জীবনের এমন প্রেরণার শিক্ষা থেকে কোনো শিক্ষা নিতে আগ্রহী নন। সে কারণেই তাদের দরজা এই দিনগুলোতে বন্ধ থাকে, কোনোভাবেই শিক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদেরই গভীরভাবে ভাবতে হবে, নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে জাতীয় ইতিহাসে তাদের অবস্থান আরও শিক্ষণীয় হতে পারে।
য় মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন