সংযত আচরণ কাম্য
16 February 2017, Thursday
যারা ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতের সংবাদ টিভিতে দেখেছেন তারা রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের উক্তিটি শুনে কতটা বিস্মিত, হতবাক এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন জানি না, তবে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকর্মী কথা প্রসঙ্গে তাদের ক্ষোভের কথা আমাকে বলেছেন। আমি নিজেও রাতে টিভি চ্যানেলগুলোর খবরে মির্জা ফখরুলের মুখে কথাটি শুনে হতবাক হয়েছি। মির্জা ফখরুল ইসলাম একটি সভা শেষে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। নির্বাচনের সময় বিএনপি কেমন সরকার চায়Ñ এমন প্রশ্নের উত্তরে মির্জা ফখরুল ‘সহায়ক সরকারের’ কথা উল্লেখ করলে সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিলÑ প্রস্তাবটি নিয়ে কি আপনারা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবেন? মির্জা ফখরুল কোনো ধরনের বিলম্ব না করেই উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘তার কাছে যাব কেন, তিনি তো তার অপকর্ম করেই দিয়েছেন।’ কথাটি শুধু শ্রুতিকটূই নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানকেও কতটা অবজ্ঞা এবং ঘৃণার চোখে দেখেন তার বহিঃপ্রকাশই যেন তার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো। সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। এই উদ্যোগগুলো তিনি নিয়েছিলেন। এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা দেশে যখন উচ্চারিত হয়েছিল বিএনপি তখন সেটির বিরোধিতা তো করেইনি, বরং স্বাগত জানিয়েছিল, রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সবার আগে দলবল নিয়ে বিএনপিই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেছে। দলের চেয়ারপারসন ও মহাসচিবসহ সিনিয়র কয়েকজন নেতা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের আলোচনা সফল হওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য দলও একইভাবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতিকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। সংবিধানে এককভাবে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো ক্ষমতা না থাকার পরও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতিকে পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মতো উদ্যোগ নিলে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। রাষ্ট্রপতির পক্ষে এমন উদারবাদী উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে সরকারের সদিচ্ছা কাজ করেছিলÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার সে রকম একটি পরিবেশ চেয়েছিল বলেই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা রাষ্ট্রপতির পক্ষে সম্ভব হয়েছে। সারা দেশ পরিস্থিতির ওপর প্রতীক্ষণ দৃষ্টি রেখেছিল, এমনকি আন্তর্জাতিক মহলও। বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো মহল থেকে অভিযোগ করা হয়নি যে, অনুসন্ধান কমিটি ভালো হয়নি। বিএনপির মহাসচিব তখনো অত্যন্ত তীব্র ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনুসন্ধান কমিটির সবাইকে আওয়ামী লীগের লোক বলে ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন। কিন্তু তখন বিএনপির ভেতরেই এ নিয়ে ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটায় মির্জা ফখরুল কিছুটা বাগ্্যুদ্ধ বন্ধ করেছিলেন। পুরো বিষয়টি দেশবাসী দেখেছেন। অনুসন্ধান কমিটি ১০ জনের যে চূড়ান্ত তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করেছিল, রাষ্ট্রপতি কালবিলম্ব না করে তালিকা থেকে ৫ জনের নাম অনুমোদন করে দিলেন। তিনি যদি সময়ক্ষেপণ করতেন তাহলে নানা ধরনের অপপ্রচার দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকত। অনুসন্ধান কমিটির দেওয়া নাম পরিবর্তন করার অভিযোগ উত্থাপন করলেও অনেকে সেটিই হয়তো বিশ্বাস করত। প্রাপ্ত নাম ধরে রাখার বিপদ কী হতে পারে সেটি বিবেচনায় রেখেই হয়তো রাষ্ট্রপতি দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেন। রাষ্ট্রপতি প্রাপ্ত তালিকা থেকে যে ৫ জন ব্যক্তি কোনো ধরনের রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি, চাকরি শেষে সম্পূর্ণভাবে অবসর জীবনযাপন করছিলেন সে রকম ৫ জনকেই বাছাই করলেন। এর সুবিধা হলো যে, কেউ তাদের সংগঠন-সংশ্লিষ্টতা খুঁজে হয়তো পাবে না, অহেতুক বিতর্ক করার সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আলী ইমাম, ড. তোফায়েল বা ড. কলিমুল্লাহকে মনোনীত করা হলে দেশে বড় ধরনের বিতর্কের ঝড় ওঠার আশঙ্কা অনেক বেশি হতো। তারা বিভিন্ন সংস্থা ও লেখালেখির সঙ্গে এতটাই জড়িত ছিলেন যে, তাদের যে কেউ একজনকে নির্বাচিত করা হলে বিএনপির তাতে বিতর্ক করার অনেক বেশি সুযোগ তৈরি হতো। সেদিক থেকে রাষ্ট্রপতি যে ৫ জনকে দিয়ে ১১তম নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন তারা কেউই চাকরি জীবনের পর কোনো সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাই তাদের কথা নিকটজনদের বাইরে তেমন কেউ জানত না। ফলে প্রথম দিন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এতে স্বস্তির একটি পরিবেশ বজায় থাকার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। অবশ্য মিডিয়াগুলোয় কোনো কোনো ব্যক্তি এত অপরিচিত ব্যক্তিদের এমন দায়িত্বে আনা নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ সুশীল সমাজের কাউকে না রাখায় হতাশ হয়েছেন। তবে তাদের আশা এবং আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো আরও ভালো হতো। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় তেমন কাউকে দেওয়ার পর বিরোধিতার বহর তারা কতটা সামলাতে পারতেন জানি না। সিইসি পদে কে এম নুরুল হুদা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, এমন কথা জানার পরও তার বিরুদ্ধে জনতার মঞ্চ এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে বিএনপি মাঠ গরম করার চেষ্টা কম করেনি, কথার কামান কম দাগায়নি, কিন্তু কোনো মহল থেকেই সমর্থনে কেউ মাঠ গরম করতে নামেনি। তার পরও বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী প্রতিদিনই কে এম নুরুল হুদাকে পদ না দেওয়ার দাবি জানিয়েই যাচ্ছেন। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এসব বক্তব্য শুনে সচেতন মহল বিস্মিত হলেও বিএনপির নেতারা তাদের কথা অবিরত বলেই যাচ্ছেন, নতুন ইসিকে আওয়ামী লীগের বলে প্রচার করেই যাচ্ছেন। নতুন ইসির ওপর রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এমন লাগামহীন বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। এ নিয়ে কোনো মহলেই তেমন বিরূপ সমালোচনা যেমন নেই, তেমনি বিএনপি নেতাদের বলাবলির প্রতি তেমন কোনো বাড়তি আগ্রহ কেউ দেখাচ্ছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও অনেক মনে করছেন। কেননা নতুন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বেশ কিছু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেÑ যেগুলো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করার একটি চ্যালেঞ্জ তাদের সম্মুখে রয়েছে। সবাই সেসব কিছু দেখার অপেক্ষায় আছেন। এমন একটি পরিস্থিতিতে বিএনপির মহাসচিব রাষ্ট্রপতির প্রতি সঞ্চিত ঘৃণারই যেন বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। রাষ্ট্রপতি ‘অপকর্ম’ করেছেনÑ এমন কথা মির্জা ফখরুলের মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার পর তার কাছেই জানতে চাওয়া উচিত অপকর্মের সংজ্ঞার মধ্যে রাষ্ট্রপতির এ সময়ের কর্মকা- পড়ে কিনা। তা দেশবাসীকে বুঝিয়ে বলা উচিত। রাষ্ট্রপতি তো কোনো দলের ব্যক্তি নন এখন, তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতিষ্ঠানকে অলঙ্কৃৃত করছেন। ওই পদে বসে ‘অপকর্ম’ করার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই সেই অপকর্মের দায় নিতে হবে। গোটা দেশ এবং জাতি সেই অপকর্মের কুফল ভোগ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের একজন মানুষও রাষ্ট্রপতির নেওয়া উদ্যোগকে অপকর্ম হিসেবে অভিহিত করলেন না, হয়তো কিছু কিছু ভিন্নমত ও আশা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমগুলো অপকর্মের পর্যায়ে পড়ে এমন সনদ দিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি বিএনপির মহাসচিব। তিনি কি ওই পদের জোরে রাষ্ট্রের এমন মর্যাদাপূর্ণ পদকেও বা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও এভাবে অভিযুক্ত করতে পারেন? রাষ্ট্রপতি পদকে অশোভন শব্দ দিয়ে তিনি যে রুচি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাতে ব্যক্তিগতভাবে তার এবং তার দলের ভাবাদর্শ লালনেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মির্জা সাহেবরা এক সময় বিপ্লববাদী রাজনীতি করেছেন। তাদের সেই বিপ্লববাদ ছিল সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র হঠকারী ভাবাদর্শ দ্বারা তাড়িত, ভিন্নমত, পথ, উদারবাদী ভাবাদর্শের প্রতি ঘৃণা, কুৎসা রটনা এবং প্রত্যাখ্যান করার সংস্কৃতিতে পূর্ণ। দেশ, জাতি ও প্রগতির নামে হঠকারী রাজনৈতিক ভাবাদর্শে গড়া সংগঠন থেকে কোনো বাস্তবতাবোধ দ্বারা পরিচালিত রাজনীতি তৈরি হয়নি। তারা রাজনীতিতে এক সময় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, দেশ ও জাতির জীবনে বিন্দুবিসর্গ অবদান রাখতে সক্ষম না হয়ে দল ভেঙেছে, ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র দল গড়েছে, শেষ পর্যন্ত খড়কুটোর আশ্রয় নিয়েছে ডানপন্থার, সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের দল বিএনপিতে। এদের বেশিরভাগ নেতার মনন ও চেতনায় আওয়ামী বিরোধিতা এতটাই প্রবল যে, সেই দলের সমালোচনায় তারা ন্যূনতম রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখতে পারেন না। বোঝাই যাচ্ছে, সারাজীবনের আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির প্রভাব সাধারণ আচরণেও পড়ছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি পদটিকে প্রথম (১৯৯৬-২০০১) শাসনে যতখানি উদারভাবে অবস্থান করতে দিয়েছে বিএনপি কি একবারও তা করেছেÑ এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো তিনি দেবেন না। তবে রাষ্ট্রপতি ‘অপকর্ম করেছেন’ এমন কথা বলার পরও আওয়ামী লীগ মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নিÑ এটিই বেশ বিস্ময়ের বিষয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক এবং বর্তমান পদমর্যাদায় দেশের কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বলবেন বলে মনে হয় না যে, তিনি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এমন কিছু করেছেন যা নিয়ে এমন অশোভন উক্তি করা যায়। এই উক্তি আমাদের আহত করেছে, রাষ্ট্রপতি পদকে অসম্মানিত করেছে।... মির্জা ফখরুল ইসলাম এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন না। এত বড় দলের মহাসচিব তিনি, তিনি দুঃখ প্রকাশ করবেনÑ সেটি আমরা আশা করি কীভাবে! আগামী সময়ে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ এমন উগ্র, হঠকারী রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ‘উচিত শিক্ষা’ই হয়তো পাবেÑ এর কিছুটা ২০০১-২০০৬ সালে সবাইকে দেখতে হয়েছে। নিজেদের রাষ্ট্রপতিকেই যারা বঙ্গভবন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতিদের বঙ্গভবনে দেখছেন, সহ্য করছেনÑ এটিই তো বেশি বোধহয়। সম্ভব হলে সেটিই হয়তো করা হতো। উগ্র হঠকারী ও সাম্প্রদায়িক রোমান্টিক বিপ্লবীদের কথা এবং আচরণ এর চেয়ে খুব বেশি উন্নত কিছু দিয়েছে এমন ইতিহাস কোথাও খুব একটা খুঁজে পাই না। বাংলাদেশে এর ব্যত্যয় হওয়ার কিছু আশা করা যায় না। এটিই আমাদের দুর্ভাগ্য, এটিই আমাদের দেখতে হবে।
য় মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন