নতুন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে দুই মাস ধরে রাজনীতি, প্রচারমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা, প্রত্যাশা ও প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করে আসছি। রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তার সঙ্গে দেখা করেছে, বৈঠক করে নানা ধরনের মতামত দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি তার পূর্বসূরি মরহুম জিল্লুর রহমানের উদ্ভাবিত সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নামের একটি তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পূর্ণাঙ্গ কমিশন নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটির গঠন এবং কর্মপদ্ধতিতে কিছু নতুনত্বের সংযোজন ঘটেছে। তার পরও দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরুতে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল তাতে অনেকেই হতাশ হয়েছেন, অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন, অনেকেই সার্চ কমিটির কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। বিএনপির মহাসচিব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিবসহ কয়েকজন নেতা সার্চ কমিটির সদস্যদের যে ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন তার সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতের ভিন্নতা লক্ষ করা গেছে। তিনি সংযত ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সার্চ কমিটির কার্যক্রম দেখার পক্ষেই তার অবস্থান দেখিয়েছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের অবস্থান সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। কেননা তিনি সার্চ কমিটির প্রধানসহ সদস্যদের ৬ জন ব্যক্তি হিসেবেই দেখেননি, দেখেছেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান এবং মর্যাদাকেও। বিষয়টি সেভাবেই গুরুত্বের সঙ্গে দেখার ও নেওয়ার বিষয়। দেশের সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, মহাহিসাবরক্ষণ, পিএসসি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও উপ-উপাচার্যÑ পদগুলো দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচিতিকেও বহন করে। যে মানুষগুলো এসব পদে অবস্থান করেন, তাদের নৈতিক অবস্থানকে খাটো করে দেখার অবকাশ থাকে নাÑ যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো পদে অবস্থানকারী ব্যক্তি গুরুতর কোনো অনিয়ম না করেন। যিনি তেমন কোনো শৃঙ্খলাভঙ্গ করেন তাকে নিয়ে সমালোচনা অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতে হবেÑ এতে কোনো দোষের কিছু নেই! কিন্তু যারা মেধা, মনন ও দক্ষতায় প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেনÑ তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস দেশবিরোধী কিছু না হলে, কার্যক্ষেত্রে সেটির অপ্রপ্রয়োগ না ঘটানো হলে, বিতর্কে না জড়ালেÑ তাদের নিয়ে এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করাটি মোটেও শুভ লক্ষণ নয়, কোনো মহৎ চিন্তাকে বহনও করে না। আধুনিক রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সামগ্রিক রাজনীতি সচেতন হবেন নাÑ এমনটি কতটা কাক্সিক্ষত হতে পারে তা ভাবার বিষয়। বরং আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন থেকে নিজ অবস্থানকে দেশের অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক ভূমিকা রাখার ব্যক্তিকে মোটেও খাটো করে দেখা উচিত নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি যে দায়িত্বে অবস্থান করেন সেটি তিনি কতটা আইনানুগ, বাস্তবসম্মত দেশ ও জনগণের কল্যাণে করে থাকেন সেটি বিবেচনার বিষয়। সার্চ কমিটি গঠনের শুরুতে সম্মানিত সদস্যদের নিয়ে বিএনপির একটি অংশের দিক থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছিলÑ তার কোনোটিই সার্চ কমিটির কারো এ সময়ের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হওয়ার মতো শোনা যায়নি। কিন্তু সার্চ কমিটি নিয়ে শুরুতে যে বিতর্কটি সৃষ্টির করা হয়েছিল তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত খুব একটা স্থায়ী হয়নি। কেননা সবাই বুঝতে পেরেছিলেন গঠিত সার্চ কমিটি মাত্র ১০ কর্মদিবসের মধ্যে একটি নামের তালিকা প্রণয়ন করবেÑ যাদের দক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা নির্বাচন কমিশনের গুরুদায়িত্ব পালনে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া সার্চ কমিটি নিজে নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশনের নাম তৈরি করবে নাÑ এটি সবারই জানা ছিল। সার্চ কমিটি দ্রুতই ৩১টি রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের বিবেচিত ৫ জনের তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। এরই মধ্যে ২৭টি রাজনৈতিক দল প্রায় ১২৫ জন ব্যক্তির নাম সার্চ কমিটির কাছে জমা দিয়েছে। ৪টি রাজনৈতিক দল কোনো তালিকা দেয়নি। নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি আমন্ত্রিত হয়ে সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাদের মতামত দেশবাসী শুনেছেন। এখন অন্তত ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হচ্ছে, যা থেকে অন্তত ১০ জনের একটি তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়ে সার্চ কমিটি তাদের বিলুপ্তি ঘোষণা করবে, তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব শেষ করবে। কাজটা মোটেও সহজ নয়। আশা করা যাচ্ছে, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। রাষ্ট্রপতি এসব নাম থেকেই হয়তো একজনকে প্রধান করে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশনের তালিকা অনুমোদনের ব্যবস্থা নেবেন। পুরো বিষয়টি সাংবিধানিক কোনো আইন মোতাবেক না হলেও সরকারের অনুমোদনক্রমে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগটি মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১২ সালেও সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় সার্চ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় বিরোধী মহল বড় ধরনের কোনো ক্ষোভ সৃষ্টি করেনি। অতীতে সরকার নিজস্ব ক্ষমতাবলেই কমিশন গঠন করেছিল। তাতে বিরোধী দলের মতামতকে খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয়নি। এর ফলে ক’দিন মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত সবকিছু থিতিয়ে গেছে। তবে কোনো নির্বাচন কমিশনই এ পর্যন্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বিদায় নিতে পারেনি। কেউ নিজেদের কারণে সমালোচিত হয়েছিলেন, কেউ বা সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে সমালোচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখনো এমন কোনো প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি যেখানে কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন স্বয়ম্ভর বলে দাবি করা যায়। এখানে আইনের সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে এখনো যে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রশাসন, স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে অনেক কিছু আছে আবার অনেক কিছুরই অভাব রয়েছে। তার মধ্যে যারা দায়িত্ব নেন তাদের দক্ষতা, সততা ও যোগ্যতার ওপরই নির্বাচন কমিশনের সাফল্য এককভাবে নির্ভর করে না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছাও অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। একটি নির্বাচনকে অর্থবহ করতে কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং জনগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে। একপক্ষ বাগড়া দিলেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এ ধরনের আরও অনেক কিছু এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনে জয়-পরাজয়, ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার অনেক কিছুই ঘটে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, তাই প্রতিষ্ঠানটিকে আইনানুগভাবে গড়ে তোলা ছাড়া ৫ জন কমিশনের পক্ষে বেশি কিছু করা খুবই কঠিন কাজ। যারাই এই দায়িত্ব নিতে যান তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের তোপের মুখে থাকতে হয়, নানা অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য তাদের শুনতে হয়। আমার ধারণা, রাষ্ট্রপতি শেষ পর্যন্ত যে কমিশন গঠন করবেন, সেই কমিশন প্রধান ও সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকবে, তাদের ব্যক্তিজীবন খোঁড়াখুঁড়ির চেষ্টা হবে নাÑ এমনটি হলফ করে বলা যাচ্ছে না। ১০ দিনের একটি নিরীহ সার্চ কমিটি নিয়েও যেখানে নানা সমালোচনা শুরু হয়েছিল, সেখানে ৫ বছরের জন্য একটি কমিশন গঠিত হওয়ার পর কয়েকদিন হয়তো আমাদের কমিশনারদের ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দেখতে হতে পারে। তাদের বিরুদ্ধেও দলকানা রোগের অভিযোগ শুনতে হতে পারে। যে মানুষগুলো সম্পর্কে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা বিশেষ কিছু জানি না, আমার ধারণা আগামী সপ্তাহে তাদের নাম অনুমোদিত হওয়ার পর বেশ ক’দিন তাদের পক্ষে বা বিপক্ষে অনেক কিছু শুনতে হতে পারে, তাদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হতে পারে। মূলত ব্যক্তিচরিত্র হননের একটি প্রচেষ্টা দেখতে হতে পারে। এভাবে ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে লেখালেখি, বলাবলির মধ্য দিয়ে আমরা আসলে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কাজগুলোর কথা ভুলে যাই, সেগুলোকে গৌণ করে ফেলি। চার দশকের বেশি সময় ধরে আমরা এ কাজটি অত্যন্ত অবিবেচকের মতো করেছি। ফলে উপহাসের পাত্র হয়ে বিদায় নিয়েছে অতীতের প্রায় সব নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনকে গড়ার কাজটি করা হয়নি, সমালোচনা বা আলোচনা সেসব বিষয়কে নিয়ে খুব একটা এগোয়নি ফলে নির্বাচন কমিশন আস্থার জায়গায় যেতে পারেনি বলে আমরাই বলাবলি করছি। অথচ আমাদের সেই কাজগুলোই করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। নির্বাচন কমিশন আপনা-আপনি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশ ও জাতিকে ক্রমাগতভাবে উপহার দিতে পারবে না, যদি আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে সেভাবে গড়ে তোলার সব দিকের প্রতি মনোযোগী না হই। সেই কাজটি সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সব মহলকেই গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে। সেই প্রতিশ্রুতি প্রদান করা জরুরি, যে ব্যক্তিদের এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা যদি সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্য উপযুক্ত হন, সৎ, মেধাবী এবং যোগ্য হন তাহলে তাদের ওপর দায়িত্ব প্রদান করা হোক। আমাদের দেশে ৫ জন যোগ্য, দক্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়Ñ যারা নির্বাচন কমিশনকে একটি আস্থার জায়গায় নিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তেমন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে দেখতে বা গড়তে চাই কিনা, নাকি কমিশনারদের মেরুদ- নিয়ে মু-ুপাত করতে আগ্রহী, নিজেদের গলায় শক্তি প্রদর্শন করতে বেশি তৎপর থাকতে চাইÑ সেটি আগে নির্ধারণ করতে হবে। পুরনো ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসে আটকে থেকে কোনোদিনই প্রত্যাশিত নির্বাচন কমিশন গঠন বা কার্যকর করতে পারার কোনো কারণ নেই। বিষয়টি সবাই বোঝেন, কিন্তু দোষটা দেওয়ার চেষ্টা হয় কমিশনকে এককভাবে। অথচ কাজটি জাতীয় তথা সামাজিক। সেটি করা হলেই নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে প্রত্যাশা পূরণের বাস্তব ভিত্তি তৈরি হতো। আশা করব, এখন থেকে আমাদের দৃষ্টিটা সেভাবে পড়বে, কাজগুলোও সেভাবে হবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন