আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জামায়াত নিষিদ্ধের সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দিয়েছে। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও এর সব সহযোগী সংগঠন সারা দেশে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধ সংঘটিত করেছে, তার তথ্যপ্রমাণ সংকলিত করেছে তদন্ত কমিটি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, এতে ৩৭৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনসহ মোট ৯৫৭ পৃষ্ঠার দালিলিক প্রমাণাদি রয়েছে। এই প্রতিবেদনে জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ সাত ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর তৎকালীন নেতারা পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে শান্তিবাহিনী, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন এবং সেগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে এসব অপরাধ সংঘটিত করেছে। একইভাবে এরই মধ্যে ঘোষিত রায়সমূহে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যেসব পর্যবেক্ষণ ট্রাইব্যুনাল প্রদান করেছেন, তাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বলা চলে, তদন্ত সংস্থা জামায়াত নিষিদ্ধের জন্য যেসব তথ্যপ্রমাণ ও বিচারিক উপাদান অপরিহার্য- তা নিয়েই এই প্রতিবেদনটি প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করেছে। গণমাধ্যমে এর নানা দিক এরই মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, প্রসিকিউশন প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই করে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করবে। সেটি শুরু হলে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসংক্রান্ত মামলার কার্যক্রম নতুন পর্যায়ে উন্নীত হবে। এ ক্ষেত্রে সফল হলে দেশের রাজনীতিতে নতুন বাঁক সৃষ্টি হতে পারে।
'জামায়াতি রাজনীতি' অকার্যকর করার যুদ্ধ
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বর্তমান উদ্যোগটি বোঝার জন্য স্মরণ করা প্রয়োজন ন্যুরেমবার্গ আদালতের কথা। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল অপরাধ সংঘটনের হোতাদেরই শুধু নয়, নাজিসহ সাতটি সংগঠনকে বিচারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করেছে, বাংলাদেশেও তাই একইভাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। জার্মানিতে সেই থেকে এসব দল নিষিদ্ধ রয়েছে, ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ কারণেই এ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদ থেকে অনেকটা নিরাপদ রয়েছে। ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ধারায় সেই থেকে যুক্ত থাকার নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশ পেয়েছে। আজকের ইউরোপের অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের পেছনে মূলত রয়েছে ফ্যাসিবাদী-নাৎসিবাদী সংগঠন ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি। গণতন্ত্রে ফ্যাসিবাদী-নাৎসিবাদী শক্তির রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না- এ কথা ন্যুরেমবার্গ আদালতের রায় থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির রাজনীতি করার অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজে থাকতে পারে না- সে কথাই নাৎসি আদর্শের ধারক দল ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের মধ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে। গণতন্ত্র মানে যার যা খুশি বা ইচ্ছে তা করার অধিকার নয়। গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের জন্যই কেবল গণতন্ত্র হতে পারে। গণতন্ত্রে বেশ কিছু আইন ও নিয়মকানুন রয়েছে, যা প্রতিটি দলকে মানতে হয়। তাহলেই কেবল গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে। ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী দলের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া ও থাকার কারণেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের চূড়ান্ত উত্থান, বিকাশ ও রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। ভোটের অধিকার নিয়ে গণতন্ত্রবিরোধী ওই অপশক্তিটি ইতালি ও জার্মানিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে দল দুটি গণতান্ত্রিক শক্তির ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার রাখেনি, তাদের হত্যা, নির্যাতন ও দেশত্যাগ করতে বাধ্য করাসহ সব ধরনের শক্তির প্রয়োগ ঘটিয়েই দেশ দুটিতে ভয়াবহ উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, ইউরোপসহ দুনিয়াকে গ্রাস করার উন্মত্ততায় মেতে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের ঘটনা তো বিশ্বসভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিক্ষেপ করেছিল। চরম গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা গেলে কী নির্মম পরিণতি দেশ, জাতি ও বিশ্বসভ্যতার জীবনে নেমে আসে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ও প্রমাণ হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ইতালি ও নাৎসিবাদী জার্মানি। সে কারণেই ন্যুরেমবার্গ আদালত গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী শক্তি হিসেবে ফ্যাসিবাদী-নাৎসিবাদী দল ও রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপের দেশগুলোতে সেই থেকে মানবতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী এসব দল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। এ থেকে এটিই প্রমাণিত হয়, গণতান্ত্রিক সমাজে কেবল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল ও মতাদর্শের সহাবস্থানের রাজনীতির স্বীকৃতি থাকতে পারে, অন্য কোনো মতাবলম্বীর নয়।
১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী ছিল বলেই ১৯৭২ সালে জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী বেশ কিছু দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্ট-নভেম্বরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতিসহ অনেক কিছুই বদলে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকে কঠিন করে দেওয়া হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে ফিরিয়ে আনা হয় সেসব দল ও রাজনীতিবিদদের, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনকভাবে ১৯৭১ সালে অবস্থান নিয়েছিল। দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালের পর বহুদলীয় রাজনীতির নামে তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হয় প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তি, শুভবোধসম্পন্ন রাজনীতি ও সংগঠনের জন্য। সেখান থেকেই জামায়াতের নতুনভাবে যাত্রা শুরু হয়। একাত্তরে যারা এত অপকর্ম ও অপরাধ সংঘটিত করেছে, যাদের বিরুদ্ধে বিচারের কাজও চলছিল- সেসব কিছু বাদ দিয়ে তাদেরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হলো। এর ফলে জামায়াত অচিরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতেই শুধু নয়, সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রস্তুতি ও আয়োজন নিয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশ সমাজের হেন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, অঞ্চল নেই যেখানে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে দলটি শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়নি। ধর্ম ও অর্থবিত্ত নিয়ে এরই মধ্যে সংগঠনটি দেশের রাজনীতিসহ সব কিছুতে একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ দলটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো একটি মৌল আদর্শই মানে না, গ্রহণও করেনি। দলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা থাকবে না। একটি তালেবানি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তাদের সুবিদিত, এটি মোটেও গোপন কিছু নয়। অথচ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় দলটি নির্বাচন ও বিপ্লব- এই দুই উপায়েই আসার সুযোগ নিচ্ছে। ধর্মের জিকির তোলার মাধ্যমে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে তারা কাছে টানছে, বিভ্রান্ত করছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্পর্কে বিরূপ ভাবাপন্ন করে তুলছে। জামায়াতের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নয়, জামায়াতের কল্পিত বাংলাদেশে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। বিপুল অর্থবিত্ত ও নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে দলে ভেড়ানোর মাধ্যমে জামায়াত এরই মধ্যে যে জায়গায় চলে এসেছে- তাকে অবহেলা করার অর্থ হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া, গণতন্ত্র অপসারিত হওয়া এবং একটি তালেবানি চরিত্রের রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে চলে যাওয়া। জামায়াতের লক্ষ্য তেমন রাষ্ট্রই গড়ে তোলা। ক্ষমতার নাগাল পেলে সেটি তারা করবেই- এতে কোনো সন্দেহ নেই। গত তিন দশকের রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান তেমন ধারণাকেই জোরালো করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ কতটা সম্ভব, কতটা বাস্তবসম্মত? এ নিয়ে একটি বিতর্ক এরই মধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে করা হচ্ছে। যাঁরা এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন, তাঁদের সে ধরনের সন্দেহ একেবারে অযৌক্তিক তা বলছি না। কেননা জামায়াতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি বাংলাদেশে খুব দুর্বল- তা বোধ হয় এখন আর দাবি করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশকে গত চার দশকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য কতটা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বোধ হয় সিরিয়াসলি কেউ দেখছে না। জামায়াতের মিত্র দলগুলো কমবেশি জামায়াতের রাজনীতিরই ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে, বুদ্ধিবৃত্তিসহ নানা স্তরে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার বিস্তর ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজবাস্তবতায় এমনি করে একটি জায়গা তৈরি হয়ে গেছে, যা এখন মোটেও অবিশ্বাস্য নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ১৯৭৫ সাল-পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সবল না করে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে অনেকটাই দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। এই রাষ্ট্রের তলদেশ, মধ্যদেশ বা উপরিদেশসহ সব ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতা, দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতার কাছে আত্মসমর্পণ করার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। এমন রাষ্ট্রটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার অবস্থানে এখন কতটুকু আছে, তা তলিয়ে দেখার বিষয়। তবে চারদিকের বাস্তবতা বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ১৯৭১ বা ১৯৭২-৭৫ সালের বাস্তবতায় এখন আর নেই। বাংলাদেশ কতটা মুক্তিযুদ্ধকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে হয়তো কষ্টই বেশি পেতে হবে। তেমন অবস্থায় দলগতভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ ও এর ভাবাদর্শগত অবস্থান অকার্যকর করার মতো কাজগুলো কতটা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে রোধ করতে যত দেরি হবে, তত বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পড়বেই। তা হতে থাকলে একসময় গণতান্ত্রিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে অবশিষ্ট থাকবে না। তখন কারো পক্ষে করার মতো তেমন কিছু থাকবে না। তবে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি খুব সহজে সম্পন্ন হবে না, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মতোই একটি কঠিন যুদ্ধ করতে হবে। সব অপশক্তি, স্বার্থপরতা ও দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। জামায়াতের আর্থিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল করার পাশাপাশি এর রাজনৈতিক মতাদর্শকে অকার্যকর করা, দুর্বল করা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে পাশে নিতে হবে, জনগণকে সচেতন করার পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ জেগে উঠবে।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান, মানবিক ও ভাষা স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
(কালের কন্ঠ, ০৩/০৪/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন