আত্মসমালোচনার সময় এসেছে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নিন
08 October 2015, Thursday
আমি যখন তরুণ ছিলাম তখনকার একটি গণসঙ্গীত এখনো আমাকে দোলা দিয়ে যায়। সত্যেন সেনের লেখা গণসঙ্গীতের প্রথম পঙ্ক্তি ছিল_ 'অনেক ভুলের মাশুল তো ভাই দিলাম জনম ভরে'। আমার মনে হয় গানের এ বাণীটি বর্তমান বিশ্বের যে দেশটির জন্য প্রযোজ্য তার নাম আমেরিকা। আমেরিকা বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের কম-বেশি সব দেশের ওপরই খবরদারি করেছে, সামরিক শাসকদের মদদ দিয়েছে ও নজরদারি করেছে। এখন বিশ্ববিবেক জেগে উঠেছে। আজ তাদের বিগত দিনের ভুলের মাশুল দেয়ার সময় এসেছে। তা না হলে অতীত পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী বিগত সুপার পাওয়ারের মতো তাদের পতনও অবশ্যম্ভাবী।
আমেরিকা 'বাংলাদেশ' মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বিপক্ষে ছিল, তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হোক তা তারা চায়নি। তবু বাংলাদেশ হয়েছে। আমেরিকার সপ্তম নৌবহরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আটকাতে পারেনি, আসলে আমেরিকা বোঝে না_ তারা এখন কোনো কিছু আটকানোর ক্ষমতা রাখে না, শুধু কিছু দিনের জন্য ভোগান্তি বাড়াতে পারে মাত্র। বর্তমান বিশ্বে যত রকমের সন্ত্রাস চলছে তার বেশির ভাগই আমেরিকার সৃষ্টি বা আমেরিকার মদদপুষ্ট। আজ পৃথিবী বুঝে গেছে আমেরিকা কারো বন্ধু নয়, সে কারো ভালো চায় না, আমেরিকা শুধু ডলার উপার্জন বোঝে আর বোঝে কিভাবে আমেরিকা সব দেশের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবে, বর্তমান কালপর্বে এ পলিসি নিয়ে সম্ভবত আর বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয় সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার। মনে রাখতে হবে, তিন শতাব্দীর বেশি কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই টিকে থাকতে পারেনি।
বাংলাদেশের পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে সমগ্র দেশের সংযোগ সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কোনো দেশই তার বৃহদাকার জনসংখ্যাকে উন্নয়নের বাইরে রেখে সমগ্র দেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলে দক্ষিণবঙ্গের ১৭ জেলার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ ও সুন্দর হবে। এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু আমরা দেখছি বাংলাদেশ যখন এ সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের দ্বারস্থ হলো, তখন তারা কীসব নাটকের অবতারণা করল; যা শুধু হাস্যকরই নয়, রীতিমতো বিস্ময়ের বিষয়। কিন্তু দেশের অর্থে সে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হলো_ আজ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এখন তাদের অতীত আচরণ ভুলে গিয়ে টাকা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আমেরিকা মুখে মুখে সভ্যতার কথা, গণতন্ত্রের কথা বলে বটে কিন্তু আসলে ওসব ফাঁকা বুলি। ওই সুন্দর কথাগুলো তারা নিজেরাই বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, কেউ কেউ বিচারের মান নিয়ে প্রথম প্রথম একটু-আধটু সংশয় প্রকাশ করলেও আজ সবাই বিচারের স্বচ্ছতায় মুগ্ধ ও বিস্মিত। কিন্তু আমেরিকা এখনো চায় না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলুক, তারা চিহ্নিত অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য এখনো তৎপর। অবশ্য তাদের এ তৎপরতার একটি ঐতিহাসিক কারণও আছে। কেননা এ চিহ্নিত ঘাতকদের পক্ষেই তো আমেরিকা তৎপর ছিল। ১৫ আগস্টের আগে ও পরে তাদের প্রভাবেই হত্যাকারীরা আশ্রয় পেয়েছিল বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশকে প্রভাবিত করে তুলেছিল। স্মরণ রাখতে হবে, চীন ও সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা কি ভুলে গেছে জর্জ ওয়াশিংটনের সেই বিখ্যাত উক্তি, যা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন আমেরিকার যুদ্ধাপরাধীদের জন্য।
'ইংল্যান্ডের সৈন্যরা, যারা আমাদের হাতে ধরা পড়েছে, তারা যুদ্ধবন্দি; যুদ্ধাপরাধী নয়। তারা ওপরওয়ালার নির্দেশে আমাদের দেশে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ হয়ে যারা নিজের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, নিজেদের মা-বাবা, ভাই-বোনকে হত্যা করেছে; তারা দেশদ্রোহী, তারা যুদ্ধাপরাধী। এদের অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। যুদ্ধবন্দিদের আমরা মহানুভবতা দেখিয়ে ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু এদের ছেড়ে দেয়া যাবে না। এদের মৃত্যুদ- দেয়ার জন্য আমরা বুলেট খরচ করতেও রাজি নই। এদের গায়ে উত্তপ্ত আলকাতরা ঢেলে মৃত্যুদ- কার্যকর করতে হবে।'
আমেরিকা যদি যুদ্ধাপরাধীদের 'গরম আলকাতরা' ঢেলে মৃত্যুদ- দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায়সঙ্গত বিচার নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথার কারণ কী? তাদের এ মাথাব্যথা কি মানবাধিকারের জন্য নাকি পুরনো বন্ধুদের জীবন রক্ষা করার জন্য?
আমেরিকা নিজেকে আজ অপ্রতিরোধ্য মনে করে এক রকমের সুখানুভূতি উপভোগ করছে। কিন্তু তারা কি ভুলে গেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের চরম শিক্ষার কথা, সম্প্রতি আফগানিস্তানে নাকানি-চুবানি খাওয়ার কথা, ইরাক-লিবিয়া-ইরান থেকে তারা যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তাও অত্যন্ত বেদনাদায়ক, এত কিছুর পরও যদি তারা সাবধান না হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমেরিকা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নির্লজ্জ হয়ে গেছে।
বর্তমান পৃথিবী অশান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ আমেরিকা। তারা নিজেদের অস্ত্র ব্যবসা এবং 'পেট্রো-ডলার' বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। আজ সারা মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাহিনীর উদ্ভব হয়েছে। আল-কায়েদা, আইএসের নেপথ্যে আছে আমেরিকার সরাসরি মদদ। ইরাক, লিবিয়া, মিসরের মতো রাষ্ট্রের বৈধ সরকারকে উৎখাতের পেছনে আমেরিকার যুক্ত থাকার বিষয় আজ সবাই অনুধাবন করছে। পৃথিবীতে একসময় ওয়ারসো (ডঅজঝঙ) চুক্তি ছিল ন্যাটোর বিরুদ্ধে কিন্তু এখন নেই। আমেরিকা ইচ্ছা করলেই ন্যাটো বিলুপ্ত করতে পারে কিন্তু করছে না, ন্যাটো কার স্বার্থে টিকে আছে_ পৃথিবীর মানুষ আজ তা ভালো করেই উপলব্ধি করছে। আমেরিকা পৃথিবীর দেশে দেশে যে অনাচার ও অনাসৃষ্টি করছে বিশেষ করে ইউক্রেনসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে তা দেখে মনে হয় তারা ঠা-া লড়াইয়ের (ঈড়ষফ ধিৎ) যুগে ফিরে যেতে চায়। অথচ অনেক দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ রয়েছে। এখন ঠা-া লড়াই বাধলে আমেরিকাসহ সব দেশের জনগণের জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়ে আরো ভয়াবহ পরিণতি হবে। কারণ অ্যাটম বোমার থেকে পারমাণবিক অস্ত্র আরো বহুগুণ শক্তিশালী।
যারা বাঙালির জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল সেই ঘাতকরা আজ আমেরিকায় নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের অসংখ্য মেধাবী মানুষ নিজেরা মেধা, শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে সচল রাখছে আমেরিকার অর্থনীতির চাকা_ এ বিষয়গুলো আমেরিকাকে এখনই ভেবে দেখা দরকার। আমেরিকা কুখ্যাত লাদেনকে পাকিস্তানে বিনা বিচারে হত্যা করেছে, এখন আমাদের দেশের হত্যাকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়_
'চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়
আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায় ।'
আজ মানুষ মনে করছে আমেরিকা সাপ নিয়ে খেলা করছে। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না সাপুড়ের মৃত্যু সাপের কামড়েই হয়। আমেরিকা যাদের সৃষ্টি করেছিল তারাই এখন আমেরিকার প্রধান শত্রু। আজ আমেরিকার আত্মসমালোচনার সময় এসেছে। এখনই যদি তারা আত্মশুদ্ধির পথ বেছে না নেয়, তাহলে আগে যারা সাম্রাজ্যবাদী সুপার পাওয়ার ছিল তাদের বর্তমানে যে অবস্থা হয়েছে, ভবিষ্যতে আমেরিকারও সে অবস্থাই হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন