অনেকগুলো টপিক জমে গেছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব। আওয়ামী লীগ পুরো অগাস্ট মাসকে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবের হত্যা দিবস উপলক্ষে শোক দিবস হিসেবে পালন করছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছরের শোক দিবসটি আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এবার শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা মুজিব হত্যার পটভূমি নিয়ে কথা বলেছেন, যেটি তারা অতীতে কিছুটা কমই করেছেন। এবার জাসদ ও বামপন্থীদের ৪০ বছরের অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। এগুলো আমার আজকের লেখার উপজীব্য নয়। তাই এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে যাচ্ছি। গত ২১ অগাস্ট শুক্রবার আমি একান্ত ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে বগুড়া গিয়েছিলাম। শুক্র থেকে মঙ্গলবার- এই ৫ দিন ঢাকার বাইরে ছিলাম। যতই বয়স বাড়ছে ততই নাড়ির টান তথা শেকড়ের টান তীব্রভাবে অনুভব করছি। তাই ছুটে গিয়েছিলাম আমার মাতৃভূমি বগুড়ায়। যেহেতু জন্মভূমি তাই সব কিছুই দেখা, সবকিছুই জানা। তবুও আরো ভালো করে, আরো গভীর করে জানার জন্য গিয়েছিলাম বগুড়া শহর থেকে ১০ কি.মি. উত্তরে সেই গোকূলে, বেহুলা সুন্দরীর বাসর ঘরে। গিয়েছিলাম মহাস্থানগড়ে, শাহ্ সুলতান মাহি সওয়ারের মাজারে। গিয়েছিলাম আরো উত্তরে ভাসু বিহারে। গিয়েছিলাম শহরের ভেতর অবস্থিত ওয়ান্ডার ল্যান্ডে, এডওয়ার্ড পার্কে, বগুড়া স্টেডিয়ামে। দেখে এসেছি মাটিডালির পাশ ঘেঁষে বাইপাস সড়ক। এগুলো দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই কয়েকটি অমর চরণ, বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরেবহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরেদেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়াঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়াএকটি ধানের শীষের উপরেএকটি শিশিরবিন্দু॥কথাগুলো একেবারে খাঁটি সত্য। বাংলাদেশের বাইরে একাধিকবার আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। ঐগুলি সেসব দেশ যেগুলো আজ বিশ্বে ধনে মানে উন্নত হিসেবে পরিচিত এবং সভ্যতাগর্বে গর্বিত। সেখানে অভ্রভেদী দালান আছে। কিন্তু কবি ডিএল রায়ের ভাষায়, তাদের দেশের ধানের ক্ষেতে বাতাস এমন ঢেউ খেলে যায় না। সেগুলো তো অনেক লম্বা কথা। তাই আগে আমাদের এই সফরের বিড়ম্বনার কথা বলি। ॥ দুই ॥আমি সাধারণত উত্তরবঙ্গে যে কম্পানির বাসে ট্র্যাভেল করি সেটির নাম, ‘এস.আর ট্র্যাভেলস’। এটির মালিক বগুড়ার শেরপুরের জিএম সিরাজ, অর্থাৎ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। এক সময় তিনি বিএনপির টিকেটে এমপিও হয়েছিলেন। তো যথারীতি এই কম্পানির এসি বাসের দুটো টিকেট কিনি। আমাদের যাত্রার তারিখ ছিল ২১ অগাস্ট শুক্রবার। ঢাকা থেকে বাসটি বগুড়ার উদ্দেশ্যে ছাড়ার কথা ছিল বিকেল ৪.২০ মিনিট। হঠাৎ করে বেলা ১২টার দিকে এস.আর ট্র্যাভেলস থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো যে, আজ অর্থাৎ ২১ অগাস্ট শুক্রবার বিকেল বেলার এসি বাস যাবে না। তাহলে আমি কি করব? আমাকে বলা হলো যে, ২১ অগাস্ট যেতে হলে নন এসিতে যেতে হবে। অগত্যা মধুসুদন! বেলা সাড়ে ৪টায় নন এসি বাস ছাড়ল। বাসটি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এটি একটি লক্কড় ঝক্কড় বাস। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর আগে আনফিট বাসের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তারপরেও এমন লক্কড় ঝক্কড় বাস হাইওয়ে বা মহাসড়কে চলে কিভাবে? যাই হোক, কিছুক্ষণ যাওয়ার পর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বাসের মধ্যে পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এই অবস্থায় বাসটি জিরানি বাজার পর্যন্ত যেতে পারল। তারপর বাসটির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বাস ভর্তি মানুষ। তারা এখন কি করবে? ড্রাইভার তখন কম্পানির হেড অফিসে ফোন করে। আমাদের জানানো হয় যে, ঢাকা থেকে আরেকটি গাড়ি আসবে। সেই গাড়িতে আমরা বগুড়া যাব। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা পর একটি বাস এলো। এই আড়াই ঘণ্টা পুরুষ নারী এবং শিশু যাত্রীরা রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরা ফেরা করেন। রাত ১২টায় আমরা বগুড়া পৌঁছি। ২৫ তারিখ মঙ্গলবার আবার বেলা ৪টায় এসি বাসে বগুড়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ৪/৫ কি.মি. আসার পর দেখা গেল, বাসে এসি কাজ করছে না। যাত্রীরা স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি সুপারভাইজার এবং ড্রাইভারের গোচরীভূত করেন। তাদের সাফ জবাব, সিরাজ সাহেবকে (এস.আর ট্র্যাভেলসের মালিক) বলেন। সারা রাস্তা এলাম গরমে সিদ্ধ হয়ে, এসি বাস বলে ভেতরে কোন ফ্যান নেই। জানালা খোলারও ব্যবস্থা নেই। এই হলো আমাদের বাস সার্ভিস। এসির ভাড়াতো কড়ায়গ-ায় দিতে হলো। কিন্তু যাত্রী সেবা? ঠন ঠনা ঠন ঠন। হতভাগ্য যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার কেউ নেই। ॥ তিন ॥এবার রাস্তার অবস্থা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত রাস্তায় মাঝে মাঝেই খানাখন্দ। মাইলের পর মাইল এমন অবস্থা। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো ক্রেডিট নিয়ে বলেছেন যে, সব রাস্তা নাকি মেরামত করা হয়েছে। উনি তো মাঝে মাঝেই রাস্তায় টহল দেন। কি দেখেছেন তিনি? উড়ো জাহাজে বাম্পিং হয়। উড়ো জাহাজের ক্যাপ্টেন সেটিকে বলেন টার্বুলেন্স। কিন্তু মাটির ওপরে চলন্ত বাসেও যে টার্বুলেন্স হয় সেটা যদি এই মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তারা বাসে ওঠেন তাহলে বিলক্ষণ টের পাবেন। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মহাসড়কে কোনো ত্রিচক্র যান বা থ্রি হুইলার চলবে না। কিন্তু সারা রাস্তায় কি দেখলাম? তিন চাকার ছোট ছোট গাড়ি বহাল তবিয়তে চলছে। তবে সংখ্যায় আগের তুলনায় বেশ কম। এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিন চাকাওয়ালারা সরকারি নির্দেশ সেভাবে মানছে না। এখন তারা টেস্ট কেস হিসেবে সীমিত সংখ্যায় রাস্তায় নেমেছে। সরকারি টহল ঢিলা হয়ে গেলে হুড়মুড় করে রাস্তায় নামবে। আরেকটি অবাক ব্যাপার হলো, ঢাকা-বগুড়া এই ২শ’ কি.মি. রাস্তায় কোনো টহল পুলিশ বা হাইওয়ে পুলিশ নেই। তাহলে সরকারি নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে কে? বগুড়া সম্পর্কে জানতে হলে টিএমএসএসের কর্মকা- সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ, ঠ্যাংগামারা থেকে প্রায় মহাস্থান গড় পর্যন্ত তাদের বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য। তাদের সম্পর্কে লিখতে গেলে বিস্তারিত লিখতে হবে। তবে তাদের উসিলায় বগুড়ার হাজার হাজার মানুষ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে। তারা কাজকর্ম করে খাচ্ছে। আজ শুধু এটুকুই বলব যে, একজন মহিলা অতি সাধারণ অবস্থা থেকে কিভাবে এমন সুউচ্চে অবস্থান নিয়েছেন সেটি ভাবলে অবাক হতে হয় এবং তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হয়। অনেকে হয়তো জানেন না যে, টিএমএস নামক এ বিশাল সাম্রাজ্যের যিনি অধিশ্বরী তিনি কিন্তু একজন মহিলা। নাম হোসনে আরা। এক সময় কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন। তিনি জন্মসূত্রে পুরুষ ছিলেন। পরবর্তীতে রূপান্তর ঘটে এবং তিনি একজন মহিলায় রূপান্তরিত হন। তার স্বামী আছে এবং একটি পুত্র সন্তানও নাকি আছে। পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। ॥ চার ॥ঢাকা বগুড়া আসা-যাওয়ার পথে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম। সারা রাস্তা বিশেষ করে ঢাকা থেকে ভূয়াপুর পর্যন্ত প্রচ- যানজট। বাস বলুন আর মোটর কার বলুন, কেউ স্পিড নিতে পারে না। আসা এবং যাওয়া উভয় পথেই শত শত ট্রাক। বাসও শত শত। প্রাইভেট কারও শত শত। মাঝখানে সিএনজি, ইজিবাইক এবং ভটভটির মত তিন চাকা। যা কিছুই করা হোক না কেন লেন সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এখন রয়েছে দুই লেন। কমপক্ষে চার লেন করতে হবে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তারপর ১৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। যখন এই সেতুটি চালু হলো তখন আমি ঢাকা-বগুড়া করেছি। স্বাভাবিক ও ব্যস্ত প্রহরে সময় লাগত ৪ ঘণ্টা। আর খুব ভোরে রওয়ানা হলে ঢাকা থেকে বগুড়া বা বগুড়া থেকে ঢাকা পৌঁছতে সাড়ে ৩ ঘণ্টা লাগত। তারপর সময় বাড়তে থাকে। কারণ যমুনা সেতু নির্মিত হওয়ার পর উত্তরবঙ্গে সড়ক পথে যান চলাচল দ্রুত বাড়তে থাকে। এখন স্বাভাবিক সময় ৬ ঘণ্টা এবং ব্যস্ত সময়ে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লাগে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যমুনা সেতু তথা যমুনা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশের যমুনা নদীর উপরে অবস্থিত একটি সড়ক ও রেল সেতু। এর দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার। এটি বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম সেতু। ১৯৯৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটি যমুনা নদীর পূর্ব তীরের ভূয়াপুর এবং পশ্চিম তীরের সিরাজগঞ্জকে সংযুক্ত করেছে। এটি বিশ্বে ১১তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৬ষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু। যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে বৃহত্তম এবং প্রবাহিত পানি আয়তানিক পরিমাপের দিক থেকে বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। সেতুটি বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে একটি কৌশলগত সংযোগ প্রতিষ্ঠিত করে। এইটি অত্র অঞ্চলের জনগণের জন্য বহুবিধ সুবিধা বয়ে আনে, বিশেষত অভ্যন্তরীণ পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা দ্রুত করে। পরবর্তীতে এই সেতুর নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু সেতু। যমুনা সেতু স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৪৯ সালে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রথম এ উদ্যোগ নেন। কিন্তু তখন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৫ অক্টোবর ১৯৯৪ সালে এর কাজ শুরু হয় এবং ২৩ জুন ১৯৯৮ সালে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছেন যে, জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কি.মি. রাস্তা চার লেন করা হবে। খুব শিগগিরই নাকি এই রাস্তার নির্মাণ কাজ শুরু হবে। যোগাযোগমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আসলে চার লেনের কাজ অনেক আগেই শুরু করা দরকার ছিল। যমুনা সেতু চালুর পর ১৭ বছর পার হয়ে গেছে। কত দ্রুত গতিতে এই মহাসড়কে যান চলাচল বাড়ছে সেটা সরকার অবশ্যই লক্ষ্য করছে। তবুও বলতে হয় ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। তবে শুধুমাত্র জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা কেন? ঢাকা থেকে এলেঙ্গা নয় কেন? উত্তরবঙ্গের যাত্রী সাধারণ লক্ষ্য করেছেন কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পৌঁছতে ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগে। এখানে যদি যানজট না থাকত অথবা চার লেনের রাস্তা থাকত তাহলে ১ ঘণ্টা বা তারও কম সময়ে জয়দেবপুর পৌঁছা যেত। একথা ঠিক যে, ঢাকা থেকে ‘এ্যারিস্ট্রোক্রাট’ রেস্টুরেন্টের পাশে অবস্থিত চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রলম্বিত মহাসড়কে প্রচুর যানজট থাকে। কারণ যেসব বাস ঢাকা থেকে ছাড়ে সেগুলো থাকে রাজশাহী, পাবনা এবং বগুড়া অভিমুখী বাস। চৌরাস্তায় গিয়ে এসব বাস তিন মহাসড়কে ত্রিমুখী গন্তব্যে রওয়ানা হয়। তাই এই চৌরাস্তা পর্যন্ত এই মুহূর্তে চার লেনের রাস্তা করার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে বলে আশা করি।Email:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন