১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাত্রি নিয়ে নানাজনের নানা মনস্তাত্তি্বক ব্যাখ্যা আছে। সেদিন যেভাবে মানুষের রাস্তায় বেরিয়ে আসার কথা ছিল তা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা, তথাকথিত ইসলামপন্থী, স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে ফেলার জন্য শুরু থেকে সক্রিয় ছিল। তারা বাংলাদেশের সূচনা থেকেই তলে তলে নানা কায়দায় ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। স্বাধীনতার পক্ষশক্তি যখন হাত-পা ধুয়ে ঘরে উঠে গেছে 'দেশ স্বাধীন হয়েছে' বলে, তখন থেকে ঘাতকরা সময় নষ্ট না করে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে এবং মাঠে কেউ প্রতিরোধ করেনি বলে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যায়। তাদের এই ফাঁকা মাঠ তৈরি হয় ৩ নভেম্বর জেলের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে। যদি জাতীয় চার নেতা সে সময় জীবিত থাকতেন তাহলে হয়তো নেতৃত্বের মাঠ অতটা শূন্য হতো না এবং বাংলাদেশ বিপথগামী হওয়ার অমন অবাধ সুযোগ পেত না।
৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অনেকের মতো আমাকেও ভীষণভাবে অস্থির করে তোলে। তখন আমি ছিলাম কর্মী, নেতারা যা সিদ্ধান্ত নিত আমি ছিলাম তা বাস্তবায়নের হাতিয়ার। সেদিন আমি আমার এতদিনের নেতাদের মধ্যে নেতাসুলভ অবস্থানে দেখতে পাচ্ছিলাম না, প্রায় সবাই ভয়ে ইঁদুরের মতো গর্তে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, তাদের দেখা পাওয়াই দুষ্কর। অনেকে আবার কালোপেঁচার মতো অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে অবস্থা লক্ষ্য করেছেন_ অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) নামে যে বামপন্থীরা খুব উৎসাহী ছিলেন, তারা সবাই তখন চুপি চুপি খোলস বদলাচ্ছিলেন। তারই ফলে পরবর্তী সময়ে জিয়ার ১৯ দফা ছাপিয়েছিল ন্যাপ। আর সিপিবি জেনারেল জিয়ার খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নেয়। শুধু তা-ই নয়, লজ্জা-শরম ছেড়ে তারা এ কথাও বলে যে, তারা বাকশালে যেতে চায়নি, বঙ্গবন্ধু জোর করে তাদের ঢুকিয়েছেন, তাদের নৈতিক অবস্থান ছিল ধামাধরা নপুংসকের। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল ভালো, না থাকলে খারাপ, এ কথা সত্যিকারের চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ কখনো মেনে নিতে পারে না। আর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীরাও তো হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল।
৭৫-পরবর্তী সময়ে ২০ আগস্ট আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর নূরুল আমীন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. ম. আখতারুজ্জামানের একটি লিফলেট তৈরি করি। তার হেডলাইন ছিল 'মীরজাফররা হুশিয়ার'। আর ভেতরের বক্তব্য ছিল, 'তোমরা যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সহযোগিতা করবে, তাদের সবংশে নির্বংশ করা হবে,' লিফলেটের হাতের লেখা ছিল প্রফেসর নূরুল আমীনের। যা হাত মেশিনে ফটোকপি করা হয়।
পরে এই লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা হয়। এই লিফলেটটি আমরা মন্ত্রী, এমপি, সচিব, ডিসি ও এসপিদের কাছে ডাকযোগে পাঠাই এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সেদিনের মতো এমন ভয়াল মুহূর্তে এই কাজটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর পরে কিছু সাহসী যুবকের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকা থেকে 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়' নামে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। এই বইটি পরে আমরা ভারতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা অবস্থায় ছাপাই এবং কলকাতা, দিলি্ল, লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করি। কবি-সাহিত্যিকরাই যে জাতির দুঃসময়ে বিভ্রান্ত জাতিকে স্বপ্ন দেখায় 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়' গ্রন্থটি তারই দৃষ্টান্ত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কবি নজরুল ইসলামের কবিতা কী প্রভাব বিস্তার করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কবির নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা থেকে। যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দু_ নজরুলের এই পাঁচটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ ছাড়া আরো অনেক লেখা তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়েছিল, যদিও সেগুলো শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়নি। যেমন_ অগি্নবীণা, ফণিমনসা, সঞ্চিতা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল প্রভৃতি।
১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ছাত্র-শিক্ষক-জনতার শোক মিছিল যায় ধানম-ির ৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা জানাতে। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ওই হত্যাকা-ের বিচার দাবি করে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি একুশে উদযাপন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতা আবৃত্তি করেন_ 'আমি কারও রক্ত চাইতে আসিনি'।
বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পরে ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম শোকসভা হয়, লন্ডনের কনওয়ে হলে। সেদিন শোকসভায় উপস্থিত ছিলেন গাউস খান, রুহুল কুদ্দুস, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ, কিন্তু জিয়ার অনুগত পেটোয়া বাহিনী লন্ডনের সেই সভাকেও প- করার জন্য হামলা করে, তখন লন্ডন আওয়ামী লীগ সভাপতি গাউস খানের হুংকার শুনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, রুহুল কুদ্দুস ও ড. মতিন চৌধুরীর ছেলেসহ অন্যান্য ছাত্র-যুবরা মিলে জিয়ার অনুগত দুষকৃতদের পিটিয়ে হল ছাড়া করে।
এরপর ১৯৭৭ সালে আমরা দিলি্লর গান্ধী মেমোরিয়াল হলে শোকসভার আয়োজন করি। এই শোকসভায় ভারতের সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই কমবেশি অংশগ্রহণ করে। এই শোকসভায় বক্তৃতা দেন ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিএন হাকসার, বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি রমেশ চন্দ্র, কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ভিভি রাজু, জনতা পার্টির নেতা কৃষ্ণকান্ত (যিনি পরবর্তীতে ভারতের উপরাষ্ট্র হয়েছিলেন) এবং সভাপতিত্ব করেন বিপ্লবী ও লেখক মন্মথনাথ গুপ্ত। সেদিনের সেই শোকসভা ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে দারুণ সাড়া ফেলেছিল।
১৯৭৯ সাল, তখনও স্বাভাবিক হয়নি বাংলাদেশের রাজনীতি, আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা কেউ জেলে, কেউ স্বেচ্ছা নির্বাসনে কেউবা জেল-জুলুমের ভয়ে পলাতক। প্রফেসর মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ। এই পরিষদই প্রথম টিএসসির উন্মুক্ত প্রান্তরে বঙ্গবন্ধু স্মরণে শোকসভার আয়োজন করে এবং খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে ধানম-ির ৩২ নাম্বারের বাড়ির রুদ্ধ দ্বারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে। এই ১৯৭৯ সালের শোকসভাতেই বঙ্গবন্ধু পরিষদ বঙ্গবন্ধুর বিশেষ কয়েকটি বক্তৃতার সংকলন 'বাংলাদেশের সমাজবিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন' নামক গ্রন্থ প্রকাশ করে। বইটির মূল্য ছিল ২৫ টাকা। সেদিন এই বই কেনার মতোও ক্রেতা ছিল নগণ্য।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুজিব আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের ধারা পুনরুজ্জীবিত করতে তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায় শেখ হাসিনার মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনা দলের হাল শক্ত করে ধরেন। আজ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। এ জন্য বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ৪০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। মনে হয় সেদিনের ঘটনা, কিন্তু মাঝখানে ব্যবধান প্রায় অর্ধশতাব্দীর। এই চার দশকের ঘটনা হাতড়ালে অনেক কথাই ভেসে ওঠে মনের কোণে, অনেক স্মৃতিই জেগে ওঠে দু'চোখের পাতায়। এসব স্মৃতি দেখে মনে হয়_ মেঘ সাময়িক, সূর্যের আলোকিত উপস্থিতিই চিরন্তন। কবিও হয়তো এজন্যই বলেছিলেন_ 'মেঘ দেখে তুই করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।' বঙ্গবন্ধু শাহাদাতবরণ করার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মেঘ জমেছিল। ৭৫-পরবর্তী কালপর্বে এ দেশের বুকে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা ছিল নিষিদ্ধ। তবু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কিছু মানুষ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে গোপনে গোপনে চালিয়েছে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা, লড়াই করেছে মুজিববিরোধী শিবিরের সঙ্গে। আজ সেই স্মৃতি হয়তো ইতিহাসের মলিন কাহিনী মাত্র। কিন্তু একদিন এই মলিন স্মৃতিগুলোই ছিল বাস্তব সত্য। আজ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৪০ দিনের শোক পালন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমি ঠিক জানি না, এই ৪০ দিনের ঘোষিত অনুষ্ঠানে কতজন মুজিবপ্রেমী, সত্যিকার ভক্তকর্মী নিমন্ত্রিত হয়েছেন, বা আদৌ হয়েছেন কিনা। তবে আজ যারা উদার, উন্মুক্ত আলোর নিচে দাঁড়িয়ে এই শোকদিবস উদযাপন করছেন, তারা হয়তো জানেন না, একদিন কী ভয়ংকর সময় ছিল আওয়ামী লীগের জন্য, কী পরিমাণ হুমকি ছিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সেই ভয়ংকর মেঘ কেটে গেছে আওয়ামী লীগের আকাশ থেকে, দিন বদলে গেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন আওয়ামী লীগ তার জীবনের স্বর্ণযুগ পার করছে, চতুর্দিক থেকে নতুন নতুন দলছুট নেতাকর্মীরা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমাচ্ছে। দলের পদ-পদবী পাচ্ছে, কখনো কখনো দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ আবার দলের মুখে চুন-কালিও মাখাচ্ছে। আমার মনে হয় আওয়ামী লীগের এই স্বর্ণযুগ আনতে যারা জীবনবাজি রেখেছিলেন আজ তারা অনেকেই মৃত, জীবিতরাও বয়সের ভারে গৃহবন্দি, যেই দুই-একজন এখনো রাজনীতি করছেন, তারাও খুব ভালো আছেন তা নয়, আমি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখছি_ প্রবীণদের চেয়ে নবীনদের উচ্ছ্বাসই বর্তমানে আওয়ামী লীগে বেশি। এটা নিঃসন্দেহে ভালোদিক, আবার এর একটা খারাপ দিকও আছে। আবেগ আর অভিজ্ঞতার মূল্য কোনোদিনই এক হতে পারে না।
জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ২১ বছর জেনারেল জিয়া, এরশাদ গং বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি মৌলবাদী ধারায় নেয়ার প্রয়াস শুরু করে তা এখন অনেকটাই অপসৃয়মান। এরশাদের জাতীয় পার্টি আজ প্রায় বিলুপ্ত, জিয়ার বিএনপিও বিলীয়মান। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে আরো শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। মূল্য দিতে হবে ত্যাগী নেতাদের, দল থেকে দুর্নীতিবাজদের বিদায় করতে হবে। সাবধান থাকতে হবে দলছুট নেতাদের থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল সংগঠন আওয়ামী লীগ, যার আদর্শের মূলে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও কর্ম। কোনো ষড়যন্ত্রের মেঘই তার আলো মস্নান করতে পারবে না।
উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা বজায় রাখার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংগঠনকে সৎ ও সক্রিয় নেতাকর্মী সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে।
মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন