বাংলাদেশের গণতন্ত্র : একাল-সেকাল
11 February 2015, Wednesday
ব র্তমান বিশ্বব্যবস্থায় গণতন্ত্রই সর্বাধিক প্রিয় সরকারপদ্ধতি। গণতন্ত্র চায় না বা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে না এ রকম দেশের সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই একেবারে নগণ্য। গণতন্ত্র ছাড়া আধুনিক জীবন অকল্পনীয়, একটি মানুষের জীবনকে সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করার জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্রের ইউটোপিক কল্পনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছিÑ যতদিন না সাম্যবাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে কোনো রাজনৈতিক মতবাদই রুখতে পারবে না।
আমি বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের একটা ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাই গণতন্ত্রের বৈশ্বিক অবস্থা নিয়ে কথা না বলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের বৃত্তেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই। বাংলাদেশের সব মানুষ স্বীকার না করলেও অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে বাংলাদেশের জনগণের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ওতপ্রোত জড়িত। আওয়ামী লীগের মূল প্রোথিত রয়েছে এ দেশের স্বাধীনতাপ্রিয়, মুক্তিকামী জনতার মধ্যে, এ দেশের উর্বর মাটির পরতে পরতে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবধারার কুপ্রভাব থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি নতুন ভাবাদর্শ সৃষ্টি করেছিল। সেই ভাবাদর্শের নাম হলোÑ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা, দেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ ভাবাদর্শের সাহায্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে উদ্ধার করে বাঙালি জাতিকে গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ ও সমুন্নত করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পরে যে দুটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল সেগুলো ছিল কৃত্রিমভাবে অতিষ্ঠিত দল। ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিএনপি আর পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় পার্টি। বিএনপি মূলত রাজাকার, আলবদর, আলশামস, ন্যাপ, সুবিধাবাদীদের নিয়ে গঠিত ওরস্যালাইন পার্টি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন পঁচাত্তর-পরবর্তী জিয়া সরকার ছিল অবৈধ। এই অবৈধ জিয়া সরকার সারা দেশে সৃষ্টি করে এক দুর্বিষহ আতঙ্ক। তার সীমাহীন নির্যাতনে জেলখানা ভরে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা। কেউ কেউ চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে। আন্ডারগ্রাউন্ডেও যখন সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়, তখন তারা বাধ্য হন হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে। জিয়ার শাসনামলে প্রতি রাতে দেশে ‘মার্শাল ল’ থাকত। জনজীবন ছিল চরম অনিরাপত্তার ভেতর। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশে যে কালো আইন তৈরি এবং মুজিব হত্যাকা-ের বৈধতা দান করে ঘাতকদের পুরস্কৃত করে তাতেই কি জিয়ার নির্দয় একনায়কের পরিচয় বহন করে না?
জিয়ার পরে আসে আরেক গণতন্ত্র হত্যাকারী জেনারেল এরশাদ। এরশাদও আওয়ামী লীগের নেতৃকর্মীদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালায়। কেননা এরশাদ তো প্রকারান্তরে জিয়ারই ভাবশিষ্য। গুরু প্রদর্শিত পথই তো শিষ্যের জন্য অনুসরণীয়। তাই আওয়ামী লীগকে নির্যাতন করতে জিয়া ও বিএনপি যা যা করেছেÑ এরশাদ আর জাতীয় পার্টিও তা-ই করেছে। বরং এরশাদের নির্যাতন কোথাও কোথাও জিয়াকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জনগণের প্রিয় পার্টি আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮টি আসন, ভোট পায় ৮৯ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি আসন, ভোট পায় ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি পায় ২০৭টি আসন এবং ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৯টি আসন এবং ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোট। এখানে লক্ষ করার মতো একটি ব্যাপার হলোÑ ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগেও যে আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। তার মৃত্যুর পরে ভোটার সংখ্যা কীভাবে ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে যায় আর হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার ভুঁইফোড় বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট।
১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে বিএনপি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরে দাঁড়ায় এবং খালেদা জিয়া তথাকথিত আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টা মিডিয়া ক্যু করে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩টি আসন, ভোট পায় ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। মিডিয়া ক্যু না হলে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই যেত। ১৯৮৮ সালে আবার এরশাদের অধীনে নীলনকশার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন, ভোট পায় ৬৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ফ্রিডম পার্টি তথা কিলার পার্টি পায় ২টি আসন আর আসম আবদুর রব ১৯টি আসন পেয়ে হয় বিরোধীদলীয় নেতা হন।
এরপর ১৯৯১ সালে সর্বদলীয় রাজনৈতিক পার্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বিএনপি পায় ১৪০টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি ও জাতীয় পার্টি পায় ৩৫টি আসন। এই নির্বাচনের ভোটের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিএনপির বাক্সে পড়ে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৩ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি পায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট। জামায়াত পায় ১৮টি আসন। জামায়াত-বিএনপির সিট এলাইন্সের ফলে বিএনপি ১৯৯১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার এসে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অধীনে আয়োজন করে ষড়যন্ত্রের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন, ফ্রিডম পার্টি পায় ১টি এবং স্বতন্ত্র পার্টি পায় ১০টি আসন। কিন্তু খালেদা জিয়া গণআন্দোলনের মুখে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।
এই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন এবং ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে একুশ বছর পরে অর্থাৎ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন এবং ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি আসন এবং ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এই নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমসংখ্যক ভোট পেলেও আসন সংখ্যায় বিএনপি এগিয়ে থাকে। এবারও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াতের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোট নিয়ে এবং ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার নানামুখী ষড়যন্ত্র করে, রাজাকারদের মন্ত্রী বানায়, বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এবং দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। বিএনপির রক্তলোলুপ চক্রান্তে নিহত হতে তাকে আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী। শেখ হাসিনাও বহুবার মৃত্যুঝুঁকি থেকে বেঁচে যান। এর মধ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা সবচেয়ে নির্মম আর মর্মান্তিক।
বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে যেমন ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি, তেমনি ২০০১ সালে ক্ষমতা পেয়েও তারা মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহনা শুরু করে। এরপর আবির্ভূত হয় আর্মি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারাও দুই বছর গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রাখে। চেষ্টা চালাতে থাকে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তারাও বাধ্য হয় ২০০৮ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে এবং মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করে। দেশে এখন সেই ধারাই অব্যাহত আছে। ওপরের বিশ্লেষণ থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে যে, যখনই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে তখনই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এ ধারা ১৯৭০ থেকে শুরু হয়ে ২০১৪ পর্যন্ত বিদ্যমান। আওয়ামী লীগ যেন সত্যি এক বহতা নদী, যার গতি কখনোই রোধ করা সম্ভব নয়।
একটি কথা মনে রাখা দরকারÑ জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ উভয়েই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। উভয়েই বিভিন্ন চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। আজ তাদের পক্ষে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা, গণতন্ত্রের বিপক্ষেই কথা বলা। দেশে অনেক জঞ্জাল জমেছে। সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সময় ও সমর্থন দেওয়া দরকার। আশা করি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ সে সুযোগ আওয়ামী লীগকে দেবে।
লেখক : কলামনিস্ট
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন