মধ্যবিত্ত দেবে বেশি, পাবে কম!
25 June 2017, Sunday
এবারের বাজেট অনেক বড়। এ বাজেটের জন্য করও আহরণ করতে হবে অনেক বেশি। বাজেটের আকার বেড়েছে গেল বাজেটের তুলনায় ২৬ শতাংশ; কিন্তু কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। বাজেটে যেভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে তাতে রাজস্ব বোর্ডকে গত বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয় করতে হবে। বাজেটের আকার ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি। তবে এর অধিকাংশ ব্যয় হবে রাজস্ব খাতে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতায়। এর বাইরের দুই অবস্থানে আছে অতীত ঋণের জন্য সুদ ব্যয় এবং সরকারি লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তুকি। কিছু ব্যয় আছে অন্য ভর্তুকিতে, যার মাধ্যমে সরকার বলতে চাচ্ছে, তারা সহনীয় মূল্যে ভোক্তাদের পণ্য ও সেবা প্রদান করছে। ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায়। এই উন্নয়ন বরাদ্দ বড় নয়। তবে যেটা শঙ্কার বিষয় তা হল, বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি চলে যাচ্ছে অনুন্নয়ন খাতে। এত বিশাল অংকের অনুন্নয়ন বাজেটের অর্থ জোগান দিতে গিয়ে সরকার সর্বত্রই করারোপ করে চলেছে, এবারের বাজেটের করারোপের ধরন দেখলে বোঝা যায়, বাজেটের আকার আগে ঠিক করা হয়েছে এবং এ বাজেটের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হবে, তা যেভাবেই হোক সংগ্রহ করা হবে।
মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় বাজেটের আকার অত বড় নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাজেটে যে অর্থের জোগান লাগবে সেটা জনগণ দেবে কেন? তারা কি তাদের ত্যাগের বিনিময়ে যথাযথ সেবা সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে? তাদের কেন বলা হবে, বিশাল এক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বাহিনীর জন্য অর্থের জোগান দিতে হবে? যে বাহিনীর লোকদের কাজ নেই। তারা বেতনভুক্ত আছে বটে, তবে পূর্ণক্ষমতা প্রয়োগের জন্য তাদের হাতে কোনো কাজ নেই। অতিরিক্ত লোকবল বিভিন্ন সরকারি দফতরে যেমন আছে, তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও আছে। কোনো কর্মকর্তা যদি পূর্ণক্ষমতায় কাজ না করে মাস শেষে বেতনভাতা নেয়, সে ধরনের নিয়োগকে অর্থনীতি শাস্ত্রে আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট (Under employment) বলে। অর্থাৎ, এ ধরনের লোকেরা তাত্ত্বিক অর্থে কাজে নিয়োজিত আছে বটে, তবে প্রকৃত অর্থে তাদের কোনো প্রয়োজন নেই, তারা বেকার। এই অর্থনীতিতে আন্ডার এমপ্লয়মেন্টের আকার বা সংখ্যা নিয়ে কোনো অধ্যায়ন হয়নি। হলে দেখা যেত ১৩ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে কত লাখ বেকার।
অর্থনীতিতে আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট বোঝার জন্য একটা মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়। সেটি হল, একজন লোককে, যিনি বেতন-ভাতার বিপরীতে নিয়োজিত আছেন, জিজ্ঞাসা করা হবে, আপনি আপনার অন্য এক সহকর্মীর কাজগুলো কি করে দিতে পারবেন, যদি আপনাকে তার বেতন-ভাতাটা দিয়ে দেয়া হয়? এ লোক যদি আনন্দে রাজি হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে তার সহকর্মীর কোনো প্রয়োজন নেই। তাকে খামাখাই বেতন-ভাতা দিয়ে পোষা হচ্ছে। পূর্ণক্ষমতার নিচে কাজ করার অর্থই হল, যারা এ রকম করছে তারা আংশিক বেকার। সরকারি দফতরে নাকি অনেক পদ খালি আছে। কিন্তু অর্থনীতি শাস্ত্রে যেভাবে নিয়োগকে (employment) সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তাতে সেই মাপকাঠি যদি প্রয়োগ করা হয় তাহলে প্রকৃত অর্থে সরকারি দফতরে খুব কম পদই শূন্য আছে। বরং যারা নিয়োজিত আছে তাদের একটা বিরাট সংখ্যকের কোনো প্রয়োজন নেই। দক্ষ প্রশাসন মানে কাজ বাদে অতিরিক্ত লোকের নিয়োগ প্রদান নয়। বিষয়টিকে অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। যে কাজ বেসরকারি খাতে ১০ জনে করছে, সেই কাজ সরকারি খাতে করছে ২০ জনে। তাহলে কি এটাই বোঝা যায় না, সরকারি খাতের ২০ জনের মধ্যে ১০ জনই বেকার? অথচ এই বেকার লোকগুলোকে বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য সরকার জনগণকে বলছে, আরও বেশি কর দাও!
সুদ ও ভর্তুকি ক্ষেত্রেও আমরা যেন লাগামহীন হয়ে পড়েছি। ঘাটতি বাজেট মেটাতে গিয়ে সরকারকে ঋণ নিতে হয়। বাজেট ঘাটতি থাকলে ঋণ অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, বাজেট ঘাটতি কেন? এ প্রশ্ন উঠলে সরকার বলে, অন্য দেশে ঘাটতির আকার আরও বড়, আমাদের তো ঘাটতি অন্যদের তুলনায় অনেক কম। এটা কোনো ভালো উত্তর হল না। বিশ্বে অনেক অর্থনীতি আছে যারা আয় অনুযায়ী ব্যয় করে, কোনো রকমের ঘাটতি বাজেটের আশ্রয় নেয় না। আজকে বাজেট ঘাটতির জালে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবদ্ধ না হলে কমপক্ষে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন বাজেটে জোগান দেয়া যেত। আমাদের উন্নয়ন বাজেট হতো এক লাখ আশি হাজার কোটি টাকার। আর ভুর্তকির বিরাট অংশ যাচ্ছে লোকসানি সরকারি সংস্থাগুলোকে পুষতে গিয়ে। এতদিনেও কি আমরা লোকসান দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনার কল-কারখানাগুলোকে চালাতে থাকব!
জনগণ থেকে বাড়তি কর পাওয়া সহজ। কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্ন কি করা হচ্ছে যে, করের বোঝা কারা বেশি বহন করছে? যেহেতু দরিদ্রদের আয় কম সেজন্য ভ্যাট-রাজস্বের যে চাপ অর্থনীতিতে পড়বে, তার একটা বড় অংশ নিন্ম-মধ্যবিত্তদেরই বহন করতে হবে। অন্যদিকে এদের এবং মধ্যবিত্তদের বাজেটে আগেই টানাপড়েন শুরু হয়ে গেছে। তারা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য বাড়তি মূল্য দিচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি দিতে হবে। এদের ওপরই খক্ষটা পড়বে বর্ধিত কর জোগান দেয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু এই শ্রেণীর কি আয়-রোজগার সেই অনুপাতে বাড়ছে? মধ্যবিত্ত হল ভোগতাড়িত অর্থনীতির প্রাণ। এরাই জাতীয় অর্থনীতিকে সামনে টেনে নিয়ে যায় ভোগ ব্যয়ের মাধ্যমে। কিন্তু আজ কর কাঠামোকে যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতে এদের ভোগের ক্ষমতা কমে যাবে। সে অবস্থা কি অর্থনীতির জন্য ভালো হবে? যাদের আয় বাড়ানোর কোনো ক্ষমতাই নেই, তাদের যদি বর্ধিত মূল্যে বাজার থেকে পণ্য কিনতে হয় এবং বর্ধিত মূল্যে সরকার থেকে গ্যাস-বিদ্যুৎ কিনতে হয়, তাহলে তো তাদের সামনে বিকল্প একটাই- ভোগ কমাও, আগের ভোগের অবস্থান থেকে সরে এসো। যে অর্থনীতিতে জিডিপি বাড়ছে ৭ শতাংশের উপরে, সেই অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোগে টান পড়বে- এটা কেমন কথা! তাহলে জিডিপি বৃদ্ধির আনুপাতিক সুফল কি তারা পাচ্ছে না? সেক্ষেত্রে তো বর্ধিত ট্যাক্স দিয়েও তাদের ভোগ ব্যয় কমার কথা নয়। সত্য হল, অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তার জন্য অর্থের জোগান দিচ্ছে নিন্মমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। আর সেই প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ চলে যাচ্ছে অল্প কিছুসংখ্যক ধনীর পকেটে, যে ধনীরা আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঐচ্ছিকভাবে ঋণখেলাপি হচ্ছে। এ ঋণীদের একটা অংশ বিভিন্ন কৌশলে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে।
মধ্যবিত্তের জন্য বিনিয়োগের জায়গাগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। ব্যাংক আমানতে সুদের হার কমে গেছে। একই অবস্থা সরকারি সঞ্চয়পত্রেও। তাহলে তাদের কি সঞ্চয় করতে বলা হবে না? একটা বিকল্প হতে পারত দেশের পুঁজিবাজার। কিন্তু সেটা কি চলছে? ভালো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য কোনো উদ্যোগ আছে কি? তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির কর্পোরেট আয়কর কমিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও বাজেট প্রস্তাবে এক্ষেত্রে কোনো কিছু নেই। যখন এ লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপযুক্ত সময় এলো, তখন তিনি কর বসানোর বিষয়টিকে ভুলে গেলেন! পুঁজিবাজার নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের অন্যসব বক্তব্য এই বাজারকে চাঙ্গা করতে বা রাখতে কোনো ভূমিকাই রাখবে না। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, বিশ্বে কর্পোরেট আয়কর হল গড়ে ২৪ শতাংশের সামান্য বেশি। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে এই কর গড়ে কত, তা কি তিনি হিসাব করেছেন? কর হার কমালে রাজস্ব আয় কমে যাবে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং কর হার কমালে রাজস্ব আয় বাড়ে, এটাই প্রমাণিত। কর্পোরেট আয়কর যেমন কমানো উচিত ছিল, তেমনি ব্যক্তির আয়করের হারও কমানো উচিত ছিল। কর হার বেশি থাকলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার আয়কে লুকাতে চায়। এটা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সত্য।
সেদিন এক ডায়ালগে কয়েকজন বয়স্ক আলোচক সরকারের প্রতি অনুরোধ করেছেন, বয়স্ক লোকদের জন্য কিছু করুন। অন্তত তাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি আয়করে রেয়াতি সীমা ৫ লাখ টাকা করা হোক। ওদের কথা হল, সরকারের কি রাষ্ট্রের সিনিয়র সিটিজেনদের প্রতি দায়িত্ব নেই?
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন