নোট অচল করল ভারত, ক্ষতিগ্রস্ত হল বাংলাদেশও
06 January 2017, Friday
ভারত সরকার গত বছর ৮ নভেম্বর তাদের বাজারে প্রচলিত ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট অচল ঘোষণা করেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বলে দিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ থেকে ওই নোটগুলো আর লিগ্যাল টেন্ডার বা আইনি মুদ্রা থাকবে না।
যেসব ভারতীয় নাগরিক ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট ধারণ করবে, তাদের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকে ওইসব নোট জমা দিয়ে অন্য নোট নিতে হবে। না নিলে ওইসব নোটের কোনো মূল্যই থাকবে না, ওগুলো হয়ে যাবে টুকরিতে ফেলে দেয়ার মতো শুধুই কাগজ।
নোট বদল করার সময় কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে। তবে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ছিল পুরনো নোট জমা দিয়ে নতুন নোট নেয়ার শেষ দিন। ভারতীয় জনগণও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ওই দিনটিকে তাদের হাতে থাকা ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোটগুলো বদলে নেয়ার শেষ দিন হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। তবে প্রায় দুই মাসের অন্তর্বর্তী সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেবা ক্রয় ও পাওনা মেটানোর জন্য ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোটগুলো গ্রহণ
করা হয়েছিল।
ভারত সরকার হঠাৎ করে তাদের বড় রুপির নোটগুলোকে অচল ঘোষণা করতে গেল কেন? ভারত সরকারের ব্যাখ্যা হল, তারা ট্যাক্স ডজার (Tax dodger) এবং কালো টাকার মালিকদের ধরতে চেয়েছে। এসব লোক যেভাবে লেনদেন করে তা ভারতীয় রেকর্ডের মধ্যে আসে না। এরা ট্যাক্স দেয় না।
এরা নগদে (in cash) লেনদেন করে বেশি। এদের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যত মুদ্রাই জইও (Reserve Bank of India) সরবরাহ করুক না কেন, এদের কারণে সেই অর্থের হদিস পাওয়া যায় না। ওই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে পুনঃপ্রবেশ করে না। ওই অর্থ ব্যয় ও ব্যবহৃত হয় বেআইনি আর্থিক লেনদেনের কাজে, যার মধ্যে সন্ত্রাসে অর্থায়ন অন্যতম।
অর্থনীতির বিরাট অংশ রেকর্ডকৃত আর্থিক লেনদেনের বাইরে থাকার ফলে জইও-এর মুদ্রা ও আর্থিক নীতি উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই অর্থনীতিকে রেকর্ডে আনার জন্য এবং কালো টাকাকে শায়েস্তা করার জন্য ভারত সরকারকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ভারত সরকার এও বলছে যে, এর ফলে জনগণ কাগুজে নোটের পরিবর্তে ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে বা ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। প্রথমে ভোগান্তি হলেও পরে এটি সহনীয় হয়ে পড়বে। তবে ভারতের মোদি সরকারের নোট অচলের এ ঘোষণায় সাধারণ মানুষ অতি বিপাকে পড়ে যায়। সাধারণ মানুষের অর্থ ধারণের প্রায় সবটাই নগদ রুপিতে। ভারতের জনগণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে কত লোক লেনদেন করে বা ব্যাংক হিসাবধারীদের শতকরা হিসাব কত, তা আমাদের জানা নেই।
তবে অনুমান করা যায়, ভারতে ৪০-৫০ শতাংশ মানুষের ব্যাংক হিসাবই নেই। তারা নগদে আয় করে, নগদে ব্যয় করে। যে অর্থনীতিতে নগদে লেনদেন বেশি হয়, সেই অর্থনীতিতে কালো অর্থনীতি গড়ে ওঠা সহজ হয়। গ্রামের কৃষক-মজুররা কোনো কালো অর্থনীতির মালিক নয়, কিন্তু নোট অচলের কারণে তারা পড়েছে বিপাকে। তাদের অনেকের হাতের কাছে ব্যাংক নেই। থাকলেও ব্যাংক নতুন রুপি জোগান দিতে অসমর্থ হয়েছে।
এর কারণ হল, জইও যত রুপি ভারতীয় অর্থনীতিতে ছেড়েছে তার ৮৫ শতাংশই ছিল ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোটে। ফলে ছোট ডিনোমিনেশনের নোটে জনগণকে অর্থ ফেরত দেয়াটা রীতিমতো একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছিল। অবশ্য নতুন নোট যে ছোট মূল্যের হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। জইও পুরনো নোটের বদলে একই মূল্যের নতুন নোট দিতে পারে। পরে হয়তো করেছেও তাই। কারণ, ছোট নোটের অর্থ ফেরত দিতে গেলে জইও-কে নতুন করে কোটি কোটি নোট ছাপাতে হবে। জইও-এর একটিমাত্র ঘোষণায় ভারতের পুরনো বড় ডিনোমিনেশনের নোটগুলো অচল হয়ে গেল।
সেটি কীভাবে সম্ভব হল? জনগণ কি চাইলে সেসব নোট দিয়ে অনুমোদিত লেনদেনের বাইরে গিয়ে লেনদেন করতে পারত না? উত্তর হল, না। কারণ, কোনো কাগুজে নোট মুদ্রা (কারেন্সি) কিনা তা নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের- যে ব্যাংক নোট বা মুদ্রা ইস্যু করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত- ঘোষণার ওপর।
নোট ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ যদি বলে, কাল থেকে ওই ওই মাপের, ওই ওই মূল্যের নোট বা মুদ্রা নামের কাগজের ওপর লেখা হবে প্রচলিত মুদ্রা বা লিগ্যাল টেন্ডার (Legal Tender), তাহলে সেই কাগজই হবে লেনদেনের জন্য স্বীকৃত মুদ্রা। মানুষ চাইলেও অন্য কাগজকে মুদ্রা ভেবে লেনদেন করলে সেটা বৈধ হবে না। মুদ্রার মূল্য কত? যেটা গায়ে লেখা থাকে সেটিই মূল্য। আর সেটি ঠিক করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি একদিনে সব মুদ্রা অচল ঘোষণা করতে পারে? তত্ত্বীয়ভাবে পারে। তবে তাতে মুদ্রায় লেনদেন একটা সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।
জনগণের কাছে নতুন মুদ্রা গেলেই কেবল লেনদেন শুরু হবে। মুদ্রা কি শুধু লেনদেনের কাজে ব্যবহৃত হয়? না, এর অন্য কাজও আছে। অন্য বড় কাজ হল সম্পদের ডিপোজিটরি (depository) হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। অন্য কথায়, মুদ্রা বা মানি হল সম্পদ ধারণের বাহন। অর্থাৎ সম্পদ হল স্বর্ণ, জমি, শেয়ার শস্য ইত্যাদি। কেউ এসবের বদলে নগদ প্রচলিত মুদ্রায়ও সম্পদ ধারণ করতে পারে। এজন্যই বলা হয়, Money is a store of value.
ভারত সরকারের নোট অচল করা নিয়ে ভারতে অনেক বাদ-প্রতিবাদ হচ্ছে এবং হয়েছে। তাদের অনেক বিজ্ঞ লোকই বলেছেন, এ হুকুমজারি কালো টাকার লোকদের শাস্তি দিতে পারবে না।
এই হুকুম শুধু গরিবদেরই শাস্তি দিচ্ছে। তাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বলেছেন, প্রত্যেক দেশেই ক্যাশ লেনদেন বা নগদে আদান-প্রদানের একটা বড় অংশ ক্যাশেই হয়। এমনকি মার্কিন অর্থনীতিতেও এর হার ৬০ শতাংশের ওপর। চিদাম্বরম যা বলেছেন, তার মধ্যে অনেক সত্যতা আছে। কালো টাকার মালিকরা অন্য পথে কালো সম্পদ ধারণ করবে। প্রতিবাদকারী বিজ্ঞজনেরা বলছেন, নোট অচল করে বিশ্বের অন্য কোনো অর্থনীতি কোনোদিনই ট্যাক্স খেলাপি এবং কালো টাকার মালিকদের শাস্তি দিতে পারেনি।
যে পদক্ষেপ জরুরি বা যুদ্ধাবস্থায় কোনো দেশ গ্রহণ করে, মোদি সরকার সেই পদক্ষেপ শান্তির সময়ে ভারতে গ্রহণ করে অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি করেছে। ইতিমধ্যে ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে। তাদের শেয়ারবাজার পড়ে গেছে। বাইরের লোক পারতপক্ষে আর ভারতীয় রুপি ধারণ করবে না। যারা ভারতে গিয়ে ভারতীয় রুপি নিয়ে নিজ দেশে ফিরেছে, তারা সেই ধারণকৃত অর্থ হারিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক লোক ভারতীয় নোট অচলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা ভারত ভ্রমণে গিয়ে ইনফরমাল মার্কেট থেকে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট নিয়েছিল, তারা সেই নোট বদল করতে পারেনি। কারণ, ভারতীয় ব্যাংকগুলো বিদেশীদের কাছে অর্থের বা নোটের উৎস জানতে চেয়েছিল।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে নগদের পরিমাণ কত তার কোনো রেকর্ড নেই। যার ফলে ওই পথে যাদের কাছে রুপি এসেছে, ওইসব রুপির বৈধতা দিতে ভারতীয় ব্যাংকগুলো নারাজ। তাদের কাছে এগুলো হল ইষধপশ গড়হবু. বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও নাকি ৫০ কোটি ভারতীয় রুপি ওদের অচল ঘোষিত ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোটে পড়ে আছে। ২৭ ডিসেম্বর খবর বের হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এসব নোট নিয়ে বিপাকে আছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব ভারতীয় নোট আইনি পথেই এসেছে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ এগুলো বদল করে নিতে এত দেরি করল কেন? আর এ সমস্যা তো শুধু বাংলাদেশেরই নয়- নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকারও তো একই সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে ওরা ওইসব ভারতীয় নোট নিয়ে কী করছে সেটা দেখা। বাংলাদেশের বৈধভাবে অর্জিত ভারতীয় নোটগুলোর দায় ভারতকে নিতে হবে। যদি ভারত তা না নেয় তাহলে পুরো আন্তর্জাতিক লেনদেনেই একটা অবিশ্বাস জন্ম নেবে। ভবিষ্যতে ভারতীয় রুপি অন্য দেশের ব্যাংক ও নাগরিকেরা গ্রহণ করতে চাইবে না। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ব্যাংক তার কাছে রক্ষিত ভারতীয় নোটগুলো বৈধভাবে বদল করে নিতে পারবে।
ভারতীয় মুদ্রা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আস্থা হারিয়েছে। এখন আর এটা বিশ্বাস হয় না যে, বাইরের কেউ ভারত ভ্রমণে গিয়ে ডলারের সঙ্গে কিছু ভারতীয় মুদ্রা নিয়ে দেশে ফিরবে। বাংলাদেশের ভ্রমণকারীরা আগে যেভাবে আস্থার সঙ্গে ভারতীয় রুপি পকেটে নিয়ে দেশে ফিরত, ভবিষ্যতে সেটা হবে না। মুদ্রার অবাধ ব্যবহার লেনদেনকে উৎসাহ দেয়। ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। মোদি সরকার ব্ল্যাক মানি থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে উদ্ধার করতেই নাকি নোট অচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ব্ল্যাক ইকোনমি কি শুধু বড় ভারতীয় নোটে সীমাবদ্ধ? মোদি কি পারবেন স্বর্ণ অচল করতে? অনেকের মতো ব্ল্যাক ইকোনমির একটা বিরাট অংশ রয়েছে স্বর্ণে।
মোদি কি পারবেন ধনী ভারতীয়দের সুইস ব্যাংকের অর্থের হিসাব নিতে? শেষ বিচারে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, নোট অচল ঘোষণার পদক্ষেপ ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষতিই করবে বেশি।
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন