আমেরিকানরা যে খারাপ লোককেও ভোট দেয়, ওবামার পূর্বসূরি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নির্বাচিত হওয়াই তার প্রমাণ।
জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন যেন যুদ্ধ লাগানোর জন্যই! সেই প্রেসিডেন্টই তো ইরাকের মতো একটা অগ্রসরমান দেশকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন। হত্যা করলেন ৫০ লাখ নিরীহ ইরাকিকে।
যেসব কথা বলে বুশ গং ইরাক আক্রমণ করেছিলেন, সেসব পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কী আসে যায়! তারা সেজন্য দুঃখিতও নয়, লজ্জিতও নয়। ওই আক্রমণে বুশের সহযোগী ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চ্যানি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফিল্ড; আর বিদেশ থেকে সহযোগী ছিলেন তৎকালীন লেবার দলীয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।
টনি ব্লেয়ার যে একটা বেআইনি কাজে বুশের সহযোগী হতে চলেছেন, সে কথা সেদিন অনেক ব্রিটিশ বলেছিল। কিন্তু ব্লেয়ার যে বুশকে সমর্থন দেবেন সেটা তিনি আগেই স্থির করে নিয়েছিলেন। তাই তার কাছে ইরাকের বিষয়ে সত্য-মিথ্যা ছিল অর্থহীন।
তার একটাই ভাবনা ছিল, সেটা হল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে যে করেই হোক সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। ওই বুশ সাহেব একপর্যায়ে যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ইরাক আক্রমণের পক্ষে নিতে ব্যর্থ হলেন তখন হোয়াইট হাউস থেকে বলে দিলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব দরকার নেই। সিকিউরিটি কাউন্সিল ইজ ইররিলেভেন্ট।
শেষ পর্যন্ত মার্কিন সেনারা জনগণের প্রতিরোধের মুখে ইরাকে পরাজিত হয়। পরবর্তী ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নির্বাচনের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন। আর অন্যদিকে টনি ব্লেয়ার দলের নেতৃত্ব হারান। সারা বিশ্বে এখন টনি ব্লেয়ার একজন খলনায়ক। আজও ব্লেয়ার জনসেবার কথা বলে এদিক-সেদিক যান। কিন্তু খোদ ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছেই তিনি সব সম্মান হারিয়েছেন। তারা ব্লেয়ারের কথাকে এখন আর কোনো মূল্য দেয় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাকে যে অপরাধ আমেরিকানরা সংঘটিত করেছে, তার তুলনা একমাত্র গত শতকের ষাটের দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গেই হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা সময়ের ব্যবধানে পেছনের পরাজয়গুলো ভুলে যান। তারা আবারও যুদ্ধের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তবে বড় কোনো যুদ্ধকে তারাও ভয় পান। তারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে তৈরি নন, যদিও রাশিয়া ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে দখল করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানদের মধ্যে একটা বড় ‘ওয়ার লবি’ কাজ করছে। তাদের কাজই হল যুদ্ধ বাধানো, যুদ্ধা করানো এবং অস্ত্র বিক্রির বাণিজ্য করা। তবে তারা জানে, বড় কোনো সংঘাতে তাদেরও অনেক মূল্য দিতে হবে। তাই তারা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধের জন্য সফ্ট টার্গেট খোঁজে। ইরাক জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে ছিল তেমনিই এক সফ্ট টার্গেট। আজ যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হন, তিনিও বিশ্বে ছোট ছোট সংঘাত লাগিয়ে রাখবেন। তিনিও শক্তভাবে ওয়ার লবির লোক।
যা হোক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অবস্থা এখন তুঙ্গে। জনমত এই হিলারির পক্ষে আবার এই ট্রাম্পের পক্ষে ঝুঁকে পড়ছে। কয়েকটি অঙ্গরাজ্য যেদিকে যাবে সেদিকের প্রার্থীই জিতবেন। সেই অঙ্গরাজ্যগুলো হল- ফ্লোরিডা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া এবং আরও দু-একটি। অন্যগুলোর কোথায় রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প জিতবেন, কোথায় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন জিতবেন তা আগে থেকে ঠিক হয়েই আছে। যেমন টেক্সাস বরাবরই রিপাবলিকানদের ঘাঁটি। অন্যদিকে ম্যাসাচুসেটস ডেমোক্রেটদের ঘাঁটি। যাহোক হিলারি জয় পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-অবস্থানে তেমন পরিবর্তন আসবে না। ওবামা যেমন করে বিশ্ব থেকে আমেরিকার উদ্যোগে যুদ্ধকে বিদায় জানাতে পারেননি, তেমনি হিলারিও সেটা পারবেন না, বরং হিলারি হলেন ডেমোক্রেটদের মধ্যে যুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি। এই হিলারিও বুশের পক্ষে গিয়ে ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।
রিপাবলিকানদের একটা শক্ত ভোটব্যাংক আছে, যারা মোট ভোটারের ২৭-৩০ শতাংশ। এরা হলেন কট্টর খ্রিস্টান ইভানজেলিকানস। এরা বরাবরই রিপাবলিকান প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে, প্রার্থী যেই হোন। এটা ঠিক, মন-মেজাজের দিক থেকে ট্রাম্প অনেকটাই অনুপযুক্ত প্রার্থী। তবুও তিনি অনেক ভোট পাবেন এবং নির্বাচিতও হয়ে যেতে পারেন। ট্রাম্প কত ট্যাক্স দিয়েছেন, সে ব্যাপারে প্রশ্নের মুখেও চুপ থেকেছেন। অথচ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধনকুবের। তাহলে তিনি ট্যাক্সের বিষয়ে চুপ কেন? চুপ তো এজন্যই যে, তিনি কোনো ট্যাক্স দেনইনি। সেটা কীভাবে? ট্রাম্প বলছেন, ট্যাক্স না দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি একজন জিনিয়াস ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাক্স ল’তে যত ফাঁক আছে, সবই তিনি ব্যবহার করেছেন ট্যাক্স না দেয়ার ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, তিনি ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন, অথচ ট্যাক্স রিটার্নে দেখিয়েছেন তার ব্যবসায় শুধুই লোকসান গেছে। তাহলে তিনি এত ধনী হলেন কীভাবে? ব্যবসায় লোকসান, অথচ তিনি ব্যক্তিগতভাবে ধনী! এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার তো কথা ওই দেশের ট্যাক্স অথরিটির, যা আইআরএস নামে পরিচিত।
ট্রাম্পের ট্যাক্স ফাইল পাবলিক করার জন্য বারবার হিলারির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ট্রাম্প ট্যাক্স ইস্যুকে এড়িয়ে গেছেন। আর এটা যদি হিলারির ক্ষেত্রে ঘটত তাহলে রিপাবলিকানরা আকাশ ভেঙে গর্তে নিয়ে আসত। ডোনাল্ড ট্রাম্প কী করে যে রিপাবলিকানদের নমিনেশন পেলেন, এ নিয়ে অনেকে হতবাক হয়েছেন। ট্রাম্প হলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রকাশ্যে বলেই ফেলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে খবর আছে। তিনি প্রচণ্ডভাবে অভিবাসন বিরোধী। যে এক কোটি লোক যুক্তরাষ্ট্রে কথিত বেআইনিভাবে বসবাস করছে, ট্রাম্প বলেছেন তিনি হোয়াইট হাউসে গেলে ওদের বের করে দেবেন। ট্রাম্প ন্যাটো সামরিক বাহিনীর কার্যকারিতা নিয়েও সন্দিহান। তিনি মনে করেন, ন্যাটো জোটের ৭০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অর্থহীন। ট্রাম্প ধনীদের ট্যাক্স কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চান, যেমনভাবে তার পূর্বের রিপাবলিকান প্রার্থীরা অন্য সময়ে বলতেন।
হিলারির ভোটাররা হল অনেকটা বিচ্ছিন্ন। তারা হল কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয়, হিসপানিক এবং নিু ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাদা লোকেরা। ভোটের দিন তারা ভোট কেন্দ্রে গেলে হিলারি জয়ী হতে পারেন। তবে হিলারির জয় একেবারে নিশ্চিত নয়। জেতার সম্ভাবনা বেশি এই যা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তিত বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে বেগ পাচ্ছে। তারা এক সময় ছিল একক বিশ্বশক্তি। এখন বিশ্বশক্তি চীন ও রাশিয়াও। তবে সামরিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বরে আছে, থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রকে চীন চ্যালেঞ্জ জানাবে বটে, তবে সেটা হবে অনেক দূর থেকে। বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বরের অর্থনীতি এবং এক নম্বরের সামরিক শক্তি হয়ে বিশ্বে বিরাজ করবে। বারাক ওবামা কালো, তবে একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক। যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে ওবামার মতো একজন প্রেসিডেন্ট পেতে। ওবামা বিশ্বে নতুন করে আরেকটি যুদ্ধ লাগাননি, কিন্তু ট্রাম্প জিতলে সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
ট্রাম্প বলে চলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আবার মহান’ (গ্রেট এগেইন) করে দেবেন। আর হিলারি বলে চলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রকে একত্র করবেন। তিনি বলছেন, মার্কিনিরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী থাকবে। হিলারি বলছেন, ট্রাম্প হল ভাগ করার নেতা। তিনি কালো-সাদার পার্থক্যে বিশ্বাস করেন। তিনি মুসলিম বিদ্বেষী অবস্থান থেকে নিজেকে বের করতে পারেননি। হিলারি বলছেন, বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলমানকে অবজ্ঞা করে যুক্তরাষ্ট্র কখনও নেতৃত্বদানের অবস্থানে থাকতে পারবে না। ট্রাম্প ধনী ও ব্যবসায়ী। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন