এক জাপানি অধ্যাপককে তাঁর এ দেশীয় এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা তুমি তো বাংলাদেশে কয়েক মাস ছিলে, বল তো বাংলাদেশের কোন দুটি বিষয়ে তোমার কাছে খটকা লেগেছে? ওই জাপানি অধ্যাপক নাকি এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, আমি বুঝতে পারলাম না তোমার দেশে এত এলোমেলোভাবে গাড়ি চলে, কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট বা দুর্ঘটনা কী করে এত কম হচ্ছে। আমার তো মনে হয়, তোমাদের দেশের রাস্তাগুলোয় নিত্যই দুর্ঘটনাজনিত ভাঙা গাড়ি পড়ে থাকতে দেখা যাওয়া উচিত ছিল এবং নিত্যই কয়েক শ লোক ওই সব ঘটনায় নিহত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, সব কিছু এলোমেলো, আবার সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। হঠাৎ করে দ্রুতগামী প্রাইভেট কারের সামনে এসে হয়তো রাস্তা পার হচ্ছে, লোক পড়ছে নতুবা মানুষের টানা রিকশা এসে পড়ছে। কিন্তু কী আশ্চর্য ওই দ্রুতগামী গাড়িটি ঠিকই থেমে যাচ্ছে, মানুষটিও পার হয়ে যাচ্ছে, রিকশাও ওই পাশে চলে যাচ্ছে! আমি তোমাদের দেশে কয়েক মাস ছিলাম। যখন গাড়িতে উঠতাম তখন ভয়ে মুখ ও চোখ ঢেকে রাখতাম, ভয় লাগত এই বুঝি আমার গাড়িটি অন্য গাড়িকে ধাক্কা দিচ্ছে অথবা অন্য কোনো গাড়ি আমার গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছে। তার চোখে-মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। আমি হলাম প্যাসেঞ্জার, আমিই যত ভয় পেতাম। আবার আমি এও দেখলাম, রাস্তার এই ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে তোমাদের দেশের ধনী লোকদের কেউ কেউ গাড়িতে বসে দিব্যি কাগজ পড়ছে নতুবা টেলিফোনের মধ্যে কী যেন দেখছে। তাদের মধ্যেও ভয় আমি লক্ষ করলাম না। তারা বসে আছে তো আছেই। একটুও যেন বিরক্ত হচ্ছে না। দেরি হওয়ার কারণে গাড়ি থেকে নেমে পুলিশকেও বলছে না, এই পুলিশ, তুমি কেন আমাদের দিকের রাস্তাটা আটকে রেখেছ? অন্যত্র তোমাদের দেশের লোকের ধৈর্যের অভাব হলেও ট্রাফিক জ্যামে পড়ে গাড়িতে রাস্তায় বসে থাকতে তাদের ধৈর্য আছে।
এবার বাংলাদেশি সহকর্মী বললেন, তোমার কাছে দ্বিতীয় কোন বিষয়টি পর্যবেক্ষিত হলো যার হিসাব তুমি মেলাতে পারলে না? জাপানি অধ্যাপক বললেন, আমি তোমাদের মসজিদগুলো থেকে অনেক লোককে বের হতে দেখেছি, মনে হলো তোমাদের দেশের লোক গডফিয়ারিং বা তোমাদের কথায় আল্লাহভীরু। বহুদূর থেকে প্রার্থনা বা নামাজের জন্য যে ডাক দেওয়া হয়, তা শোনা যায়। দিনে পাঁচবার বলা হয়, তোমরা আল্লাহর দিকে আসো, কল্যাণ ও সত্যের দিকে আসো। লোকজন সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১০-১২ মিনিটের মধ্যে মসজিদের দিকে ছুটে যাচ্ছে। একসঙ্গে কাতারবন্দি হয়ে নামাজ আদায় করে আবার কাজের সন্ধানে বের হয়ে যাচ্ছে। অতি সুন্দর এক চালচলন, মহিলারা হিজাব পরে রাস্তায় বের হয়। ধর্ম তোমাদের দেশের লোকদের জীবনের এক বিরাট অংশ দখল করে আছে। নামাজের সময় হলে মিটিং-সভা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো কিছু শুরু করতে আল্লাহর বা সৃষ্টিকর্তার নাম নেওয়া হয়। তাহলে আমি ভাবি, যে জাতি এত আল্লাহভীরু, সেই জাতি কী করে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে দুর্নীতিতে এক বা দুই বা প্রথম দশ জাতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়! আমার কাছে এই হিসাব মেলানো ভার। আমি বহু চিন্তা করেছি, এই হিসাব মেলাতে পারিনি। শুধু ভাবলাম, দুর্নীতি করার ব্যাপারে বাংলাদেশের লোকদের ক্ষেত্রে তাদের ধর্ম কি কোনো বাধাই দিচ্ছে না? না, তারা ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখেছে। দুর্নীতি ও ধর্মকে মিশতে দেয়নি। ধর্ম যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ন্যায়পরায়ণতার কথা বলেছে, সেটা শুধু তারা শুনেছে, পড়েছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই অনুশাসন যে মানতে হবে সেটা তারা বিশ্বাস করেনি। একটি গডফিয়ারিং সমাজে কিভাবে এত দুর্নীতি হতে পারে! ধর্মই যদি নৈতিকতার প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাহলে তোমাদের দেশের লোকগুলোর তো লেনদেনে, কতর্ব্য পালনে, অর্থ রোজগারে ও ব্যয়ে নৈতিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা তো আমি দেখলাম না। বরং আমি শুনেছি, তোমাদের সমাজ দুর্নীতিকে গ্লোরিফাই করে। যে দুর্নীতি করতে পারে তাকে সালাম দেয় বেশি, তাকে সমীহ করে অন্যরা চলে। এ কেমন দেশ হলো, যেখানে পাঁচ বেলা মাইক্রোফোনে বলা হচ্ছে—তোমরা এক স্রষ্টার ইবাদতের জন্য আসো। এবং তোমাদের ভালো-মন্দ তোমাদের স্রষ্টার হাতে; তাহলে এই লোকগুলো কি মসজিদ থেকে বের হয়ে প্রার্থনার মর্মবাণীগুলো ভুলে বসে আছে!
বাংলাদেশি তার সহকর্মী জাপানি অধ্যাপকের এসব কথা শুনলেন। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলেন না ওই অধ্যাপক সাহেবকে বোঝানোর জন্য। শুধুই মাথা নত করে শুনে গেছেন। আর তিনিও ভাবলেন, ঠিকই তো, যে দেশের লোকেরা এত ধর্মভীরু তাদের তো সততার মাপকাঠিতে আরো অনেক ওপরে থাকা উচিত ছিল। তাহলে এটাই তো সত্য, এরাও নামাজ পড়ছে, তবে নামাজের মতো নামাজ পড়া হচ্ছে না। নামাজ শুধু আল্লাহর বন্দনা করা নয়। বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হয় নামাজের মাধ্যমে। যে বান্দা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে স্বতঃস্ফূর্ত করতে পেরেছে, সে তো প্রাত্যহিক কাজে অসৎ হতে পারে না। মসজিদে সিজদায় এক কথা বলছে, আর বাইরে এসে ওই কথা ভুলে যাচ্ছে। সেটা কী করে সম্ভব হচ্ছে! জাপানি অধ্যাপক সাহেব তো আমাদের ওই ব্যবহার দেখেননি যে আমরা চোরের ভয়ে আমাদের জুতা-স্যান্ডেলগুলো সিজদার সামনে রাখছি। দেখলে তিনি আমাদের সম্পর্কে আরো অনেক বেশি হতাশ হতেন। ভাবতেন, আমাদের ধর্ম মহান বটে, কিন্তু আমরা মহান হতে পারিনি। আসলে আমাদের এই ব্যর্থতা আমাদের ধর্মের ব্যর্থতা নয়। সর্বোত্তম জীবনবিধানও আমাদের সঠিক পথে রাখতে পারেনি, কারণ আমরা সঠিক পথে থাকতে চাইনি। আমরা কি যেভাবে নামাজগুলো পড়া উচিত, সেভাবে পড়ছি? শুধু নামাজের খাতিরে নামাজ পড়লে তো এর প্রভাব আমাদের জীবনে পড়বে না। জীবন তো হওয়া উচিত মসজিদে, বাড়িতে, অফিসে একই রকম। সৎ, পরিশ্রমী, সবার জন্য সমান বিচারের ভিত্তিতেই তো জীবন চলার কথা ছিল। কিন্তু সেই জীবনাচরণ থাকলে দুর্নীতি নিয়ে আমাদের সমাজ এত সংকটে পড়ে আছে কেন?
বাংলাদেশে অবাক করার মতো অনেক কিছুই ঘটছে, যার হিসাব আমরাও মেলাতে পারি না। জাপানি অধ্যাপক তো আমাদের রাস্তার এলোমেলো ভাব আর ট্রাফিক জ্যামের বিষয়টি কিছুতেই হিসাবে মেলাতে পারছিলেন না। তিনি আমাদের আপাত বন্ধুবৎসল লোকগুলোকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলার ক্ষেত্রেও হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। তাঁর ভাবনা এবং শঙ্কার সঙ্গে আমরাও একমত। কিন্তু আমরাও হতবাক হই, তার পরও বাংলাদেশ এগোচ্ছে এবং ভালোভাবে এগোচ্ছে। একসময়ে আমরা ভাবতাম, এত লোকের এই ছোট্ট দেশটি বুঝি লোকসংখ্যার ভারে ডুবে যাবে। নৌকা ছোট্ট, কিন্তু যাত্রী অনেক। ঢেউয়ের জল থেকে থেকে নৌকায় ঝাপটা মারে। এই বুঝি নৌকাটা ডুবে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য, নৌকাটা ডুবে যায়নি, নৌকা অধিক যাত্রী নিয়েই যেন তীরে পৌঁছে যাচ্ছে। এক দশক আগেও বিশ্বের অনেক লোক বিশ্বাস করতে পারেনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ৭ শতাংশ করে বছরে বাড়তে পারে। বাংলাদেশের এত মহিলা শুধু একটি শিল্পেই কাজ করবে, বাংলাদেশের ৬০ লাখ লোক দেশের বাইরে কাজ করবে। সব আশ্চর্যের বড় আশ্চর্য হলো, দেশের কৃষিজমি বছরে ২ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে, এর পরও ১৬ কোটি ৫০ লাখ লোককে বাংলাদেশ খাওয়াচ্ছে। কেউ ভাবেনি এখন থেকে ৩০ বছর আগে যে বাংলাদেশের লোকেরা নিজেদের জমিতে উৎপাদিত খাদ্য দ্বারা নিজেদের জন্য খাদ্যের জোগান দিতে পারবে। বাংলাদেশের লোকদের মধ্যে আশ্চর্য এক অ্যাডাপটেশনের ক্ষমতা আছে। বাজারে গেলে মুরগি-চিকেনের অভাব হয় না। দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোল্ট্রি। ছোট দোকানের পাশাপাশি সুপারশপ গড়ে উঠেছে। সেই সব শপে বিদেশি ফল, বিদেশি দুধ, বিদেশি চকোলেট, কর্নফ্লেকস সবই পাওয়া যায়। চাইলেই যে দুধ খাওয়া যাবে এমনও ভাবা যেত না দুই দশক আগেও। বাংলাদেশের অর্থনীতি গ্লোবাল অর্থনীতির সঙ্গে জুড়ে গেছে। তবে সেই জোড়া লাগানোটা এখনো অন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। এই দেশ এখনো কোনো বড় গ্লোবাল ইকোনমিক ব্লকের সদস্য হতে পারেনি। যে কয়টা দেশ স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশকে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দিয়েছে, সেটার কারণ হলো বাংলাদেশ দরিদ্র অর্থনীতির কাতারে আছে বলে। নিজ ক্ষমতায় বাংলাদেশ কোথাও তার পণ্য নিয়ে অবাধে প্রবেশ করতে পারেনি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিমাণ এখন ২০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। তবে এই পরিমাণ এত দিনে ২৫০ বিলিয়ন ডলার হতে পারত যদি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করত। বাংলাদেশের সামনে সূর্যের আলো যেন অন্ধকার থেকে বের হয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর আলো বিকিরণ করা শুরু করেছে। তবে ভয় হয়, সেই আলো আবার কবে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে। বাংলাদেশের অসুখ কী? এই দেশের তো অসুখ থাকার কথা নয়। তবে দুর্ভাগ্য হলো, এ দেশের অসুখ যেন এ দেশের লোকেরাই নিয়ে আসছে। জনগণের মধ্যে আগের বিভক্তি এখন যেন আরো শাণিত হয়েছে। বিভক্তি একেবারেই তৃণমূল পর্যায়ে চলে গেছে। আমরা যদি পারস্পরিকভাবে দলীয় পরিচয়ে বা অন্য কোনো নামে বিভক্ত হতে থাকি, তাহলে সামাজিক সংঘাত শুধু বাড়বেই। একপর্যায়ে আমরা পাশের লোকটিকে শত্রু বলে ভাবা শুরু করব। পারস্পরিকভাবে শত্রুতার একটা আবহ সৃষ্টি করে যদি আমরা লড়তে থাকি, তাহলে সেই অবস্থা থেকে আমাদের কেউ উদ্ধার করবে না। একটা অস্থিতিশীল সুচিন্তায় ভরা সমাজের লোকেরা একে অপরকে পেছনেই শুধু টানবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো সবাইকে আপন ভাবা। দলীয়ভাবে চিন্তা না করে সবাইকে নিয়ে চিন্তা করা। এ চিন্তাটা নেতৃত্বের ওপর থেকে শুরু হলে ভালো হয়।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ কালেরকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন