বাজার বড়ই নিষ্ঠুর, এই হাসায় তো ওই কাঁদায়
29 August 2015, Saturday
২৪ আগস্ট সোমবার স্টক মার্কেটের ইতিহাসে আরেক ব্ল্যাক মানডের যোগ হলো। এর আগেও অনেক ব্ল্যাক মানডে এসেছিল, সেসব ব্ল্যাক ডেতেও লোকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। লাখ লাখ ছোট স্টক ইনভেস্টর অর্থ হারিয়ে রাস্তায় নেমে আসার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তাদের প্রতিবাদ আর ক্ষোভ প্রকাশ তাদের হারানো অর্থ ফেরত দিতে পারেনি। পতনের মুখে সরকার শুধু আশ্বস্ত করেছিল, বাজার যাতে আর না পড়ে সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের আশ্বাসবাণী পতনকে শুধু একটু ধীর করেছিল। বাজার ওই স্তরেই পড়েছিল, যে স্তরে পড়ার কথা। স্টক বা শেয়ারবাজারের এক দিনের বড় পতনকে ক্রাশ বা বাংলায় আমরা ধস বলি। ২৪ আগস্ট সোমবারও চীনের স্টক এক্সচেঞ্জে এক মহাধস সংঘটিত হয়ে গেল। চীনের শেয়ারবাজার অতি অল্প সময়ে অতি তেজিতে পৌঁছে গিয়েছিল। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ওই বাজারের মূল্যসূচক বেড়েছিল ১৩০ শতাংশ। লাখ লাখ চীনা নাগরিক ধনী হওয়ার ক্ষেত্র হিসেবে স্টক মার্কেটকেই বেছে নিল। তাদের মনে এটা গেঁথে গেল যে শেয়ারবাজার শুধু উঠবে আর তারা বিনিয়োগ করে শুধু ধনীই হবে। সেটাই হলো তাদের জন্য কাল। যখন সবাই মনে করতে থাকবে যে শেয়ারবাজার শুধু একদিকে যাবে তখন তা-ই ঘটবে। কিন্তু কত দিন! বাস্তবতা একদিন আঘাত হানবেই। চীনের শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। বাস্তবতা যখন আঘাত হানা শুরু করল তখন চারদিকে হইচই পড়ে গেল। সবাই শেয়ারের দরপতনের জন্য সরকারকে দায়ী করল। অন্যরা বক্তব্য দিতে শুরু করল দরপতন ঠেকাতে সরকারের কিছু করা উচিত। জনগণের ক্ষোভের মধ্যে পণ্ডিতরা জনস্বার্থ দেখতে গেলেন। চীনের সরকারও সায় দিল। শুরু হলো দরপতন ঠেকানোর জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা IPO ইস্যুকে বন্ধ করা হলো। ঋণের সুদের হার কমিয়ে মার্জিন ঋণকে (margin loan) সহজ করা হলো। বড় বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। উদ্দেশ্য একটাই, শেয়ারের মূল্যপতন ঠেকানো। আপাতত মনে হচ্ছিল সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কাজ দিচ্ছিল। কিন্তু সমুদ্রের ওপরের ঢেউ ছোট হয়ে এলেও পরের স্রোত শুধুই বাড়তে থাকল। হঠাৎ করে আঘাত হানার জন্য ঈশান কোণে কালো মেঘ জমা হতে থাকল। তার সঙ্গে যোগ হলো প্রবল বেগে বাতাসের একমুখী প্রভাব। দরপতনকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না। সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক এক দিনেই ৮ শতাংশের ওপর পড়ে গেল। লোকে আবার বলা শুরু করল, আবার ব্ল্যাক মানডে বা কালো সোমবার এসে গেল।
বাজার বড়ই নিষ্ঠুর, এই হাসায় তো ওই কাঁদায় চীনের শেয়ারবাজারের পতনের ধাক্কা এত দিন বিশ্বের অন্য শেয়ারবাজারে অনুভূত না হলেও ব্ল্যাক মানডের সেই ধাক্কার ধাক্কা বিশ্বের সর্বত্র অনুভূত হলো। অস্ট্রেলিয়া থেকে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সর্বত্র শেয়ারবাজার ৪ থেকে ৮ শতাংশ পড়ে গেল। সর্বত্র ব্ল্যাক মানডে। ইতিহাসের ঘটনা আবার পুনঃসংঘটিত হলো। শেয়ারবাজার তেজি হবে, আবার সেই বাজারে ধস আসবে না, এটা হতেই পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে কত ব্ল্যাক মানডে এসেছে, গেছে। বস্তুত স্টকের সব ট্রেডিং ডেই এখন ব্ল্যাক ডের রেকর্ডে চলে এসেছে। কখনো ব্ল্যাক মানডে হয়েছে, কখনো ব্ল্যাক টুইসডে হয়েছে, কখনো ব্ল্যাক থারসডে হয়েছে, ধস এসেছে ১৯২৯ সালে, ১৯৬২, ১৯৮৭, ২০০১, ২০০৭, আবার হলো ২০১৫-তে। প্রতিবার ধসের চিত্র ও রকম ভিন্ন ছিল। তবে সাধারণ মিল হলো শেয়ারমূল্যের ব্যাপক দরপতন। অনেক লোক অনেক অর্থ হারিয়ে নিজের কপাল আর তাদের সরকারকে ধিক্কার দিয়েছে। আবার কিছু লোক খুশিও হয়েছিল। খুশি হয়েছিল ওরা, যারা ঝড়ের পূর্বাভাসকে আঁচ করতে পেরেছিল। নিজের পুঁজি বা বিনিয়োগ সময় থাকতে নতুন করে বিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। সব স্টক এক্সচেঞ্জেই যখন শেয়ারমূল্যের ধস নামে তখন পরে যারা বাজারে প্রবেশ করে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে শেয়ারবাজারের কথা ধরুন। ২০১০ সালে, যখন শেয়ারমূল্যে ধস নেমেছিল তখন কি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? সবাই অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ওরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যাদের বাজারে প্রবেশ ছিল ২০১০ সালের জুন-জুলাইয়ের পরে। আবার এরাই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে, এই আশায় সামান্য লোকসান দিয়ে শেয়ারবাজার থেকে বের হয়নি। কিন্তু এরা বের হয়েছে ঠিকই, তবে ২০১১ ও ২০১২ সালে বড় রকমের লোকসান দিয়ে। যেকোনো দেশের শেয়ারবাজারেই বড় রকমের ধস নামলে বাজারের কারসাজিকারীদের চিহ্নিত ও ধরতে উঠেপড়ে লাগা হয়। কিন্তু ফল হয় সামান্যই। যখন শেয়ারবাজার ওপরে উঠতে থাকে তখন সরকার ও রেগুলেটর বেশ কৃতিত্ব নিতে থাকে। আর যখন ধস নামে তখন কে এই ঘটনা ঘটাল তার আলাপ করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। শুরু হয় তদন্ত কমিশন গঠনের। শুরু হয় আশ্বাস দেওয়ার। বলা হয় খুব শিগগির সব ঠিক হয়ে যাবে। বলা হয় বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। সরকার এই করছে, ওই করছে। এসব বলে চীনের শেয়ারবাজারের পতনকেও ঠেকানো যায়নি, বাংলাদেশেও পারা যায়নি এবং পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও অবশ্যম্ভাবী দরপতনকে ঠেকানো যায়নি। শেয়ারবাজারে কখন ধস নামে? যখন ওই বাজার প্রকৃত অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবলই বাড়তে থাকে। চীনের ক্ষেত্রে এটাই হয়েছিল। চীনের অর্থনীতি অনেকটা শীতল হয়ে এসেছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে ধসের মাধ্যমে সেই প্রতিফলন ঘটে গেছে ২৪ আগস্ট কালো সোমবারে। বিশ্বের অন্য শেয়ারবাজার পরের দিন ঘুরে দাঁড়ালেও চীনের শেয়ারবাজার পরের দিনও পড়েছে। এর অর্থ কী? অর্থ হলো এক দিনের ধস ওই বাজারকে পুরো শুদ্ধ করতে পারেনি। আরো কয়েকটি ছোট ধস প্রয়োজন হবে ওই বাজারকে বাস্তবতার কাছাকাছি আনতে। একটা কথা অতি উচ্ছ্বাসের বিনিয়োগকারীরা ভুলে যায়, যে বাজার অতিদ্রুত বাড়তে থাকে, সেই বাজার অতিদ্রুত পড়তেও থাকে। বিনিয়োগকারীরা গ্রিভ বা লোভে ভোগে। তারা একসঙ্গে চলে। কিন্তু যারা গবেষণা করে, বাজারের শিখর কোথায় তা পড়তে জানে, তারা লোভ সংবরণ করে এবং তারা হার্ডের সঙ্গে বা দলের সঙ্গে চলার নীতি পরিহার করে সময় থাকতে নিজের পোর্টফোলিও পুনর্বিন্যাস করে। একটা প্রশ্ন কেউ কেউ করতে পারে, চীনের শেয়ারবাজারের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক ও লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জেও ধস নামল কেন, তাহলে ওই বাজারগুলোও কি অতি মূল্যায়িত ছিল? হ্যাঁ ছিল তো। তবে চীনের বাজারের তুলনায় অতটা অতি মূল্যায়িত ছিল না। নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে যেটা ঘটেছে সেটা হলো বড় রকমের কারেকশন বা বাজার শুদ্ধতা। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক Quantitative Easing (QE)-এর নামে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করে অর্থপ্রাপ্তিকে সস্তা করে দিয়েছে। সেই অর্থের একটা বড় অংশ শেয়ারবাজারে প্রবেশ করেছে এবং বাজারকে বেশ ওপরে নিয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে ওই সব বাজারের ধস নামার অন্য কারণ হলো অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক। আজকের বড় শেয়ারবাজারগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। এক শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলিত হলে তার ধাক্কা অন্য শেয়ারবাজারে লাগতেও বাধ্য, একই ফান্ড ম্যানেজাররা বিভিন্ন বাজারে কাজ করছে। তারা দেখে কোন বাজার থেকে বেশি লাভ ঘরে তুলতে পারবে। এক বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি হলে তা সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বিনিয়োগকারীদের সাধারণ আচরণ সর্বত্র একই। তারা পুঁজি হারানোর ভয়ের চক্রের মধ্যে পড়ে যায়। যারা তাদের অর্থ ম্যানেজ করছে তারা জবাবদিহির ভয়ে শেয়ার বেচতে থাকে। ফলে বাজার আরো পড়ে যায়। একই দিন মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জেও সূচক ১৬০০ পয়েন্ট পড়ে যায়। ভারতের উঠতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের মুদ্রা রুপিও এক দিনেই ডলারের বিপরীতে এক রুপি মূল্য হারায়। ভারতের শেয়ারবাজারও কি তাহলে অতি মূল্যায়িত ছিল? ছিল তো বটেই। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস আগ থেকেই মুম্বাই শেয়ারবাজারের সূচক শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে থাকে। সেই বৃদ্ধি ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে অতি খুশিই করেছিল। কিন্তু প্রতিটি বাজারেরই একটা সীমা আছে। বিনিয়োগকারীরা দেখল মোদি সরকার যতটা ভালো করবে আশা করা গিয়েছিল ততটা ভালো করছে না। তখন তারা অতি উচ্ছ্বাসের অবস্থান থেকে সরে আসতে লাগল। আর গত ২৪ আগস্ট বিশ্বের অন্য শেয়ারবাজারের সঙ্গে ভারতের শেয়ারবাজারেও আরেক ব্ল্যাক মানডে ঘটে গেল। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারগুলো এখন টালমাটালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকে ভয় পাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি আবার না আরেকটা সামগ্রিক মন্দায় প্রবেশ করে। তেলের মূল্য পড়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি আবারও কোনো মন্দায় পড়বে? এক সময়ে মন্দার জন্য তেলের মূল্যকে দায়ী করা হতো। এখন কোন উপাদানকে দায়ী করা হবে?
আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি যত দিন অতি ল্যাংটা হয়ে টলতে থাকবে, এমন অনেক ব্ল্যাক মানডে আসতে থাকবে। আজ এসেছে চীনে। অন্য সময় আসবে অন্য দেশে, অন্য বাজারে। বাবল সৃষ্টি যারা করে তারাই আবার মাতম করতে শুরু করে- এ কী হলো, কেন হলো?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন