একটা কথা সবাই বলে, তা হলো বাংলাদেশ অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভালো করছে। তবে সেই সঙ্গে এ কথাও সবাই বলে যে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগাতে পারছে না। সম্ভাবনা কাজে না লাগানোর ব্যর্থতার ক্ষেত্রে কিছু অর্থনৈতিক নীতির অবস্থান বা দুর্বলতা দায়ী, কিছু ক্ষেত্রে সমস্যাটা হলো রাজনৈতিক। রাজনীতি অন্য অনেক দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। তবে বাংলাদেশে এটি এক বড় বাধা। রাজনীতিতে বিভাজন ও হানাহানি কম হতো। প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যদি একটা নির্ভরযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি কাজ করত, তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থাটা এরই মধ্যে অনেক উজ্জ্বল হতো। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি থাকলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও অনেক কমে যেত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও তখন সমুন্নত থাকত। একটা চাপা ক্ষোভের পরিবেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সূচকগুলো ঘুরতে গিয়ে বেগ পেতে হতো না। কারণ অর্থনৈতিক সূচকগুলো ততটাই জোরে ঘুরবে, যতটা মানুষ আশায় উজ্জীবিত হবে। আর সেই উজ্জীবিত আশার জন্যই প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং দক্ষ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন। প্রাতিষ্ঠানিক ভিতগুলো যদি দক্ষ, নিরপেক্ষ হতো, তাহলে মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মাত যে তারা কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা পাবে না, বৈষম্যের শিকার হবে না, তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ, তাদের ওপর অবিচার হলে তারা কোর্টে গিয়ে বিচার পাবে। তারা মুক্ত ও স্বাধীন, যে সরকারই ক্ষমতায় থাক, সেই সরকারই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহ দেবে এবং বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সরকারি দলের সমর্থক হওয়া না হওয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। যাঁরা মন্ত্রী ও অন্য পর্যায়ে প্রশাসনে আছেন তাঁরা হবেন সবার মন্ত্রী ও সবার প্রশাসক। কিন্তু সত্য হলো, বাংলাদেশের চিত্র এসব ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষার স্তরের অনেক নিচে। ফল হচ্ছে আশাবাদের চূড়ান্ত প্রকাশ সমাজে ঘটছে না। ঘটছে না বলেই উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, ভোক্তা সবাই যেন একটু ধীরে চলাকেই স্থির করে নিয়েছে। সবাই বিকল্প নিরাপত্তা খুঁজতে চাইছে। অর্থনীতির চাকাগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থনীতি এক ক্ষেত্রে ধীরে চললে অন্য ক্ষেত্রেও ধীরে চলতে বাধ্য। কোনো দেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে না বা ধীরে এগোচ্ছে, এর মানে কী? মানে হলো উৎপাদনের উপকরণগুলো পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগছে না বা ওইগুলোকে পূর্ণ ক্ষমতায় ব্যবহারের কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। সাধারণত উদ্যোক্তা শ্রেণি অন্য উপাদানগুলোকে কাজে লাগানোর কাজটা শুরু করে। বাজার অর্থনীতি আপনা থেকেই বিনিয়োগের সংকেতগুলো দিতে থাকে। উদ্যোক্তা ওই সব বাজার সংকেতগুলোকে ব্যবহার করে বিনিয়োগের ক্ষেত্র নির্বাচন করে এবং কতটা বিনিয়োগ করা যাবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো অর্থনীতি কিছুদিন দ্রুত চলে আবার ধীরে চলার চক্রে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে ধীরে চলার চক্র অতিদ্রুত আসার কথা নয়। আশার উল্লম্ফন থেকে অর্থনীতি উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে প্রবেশ করে বেশ কয়েক বছর চলার পর একপর্যায়ে গতি ধীর হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্তর আসেনি। বরং বাস্তবতা হলো, আশার উল্লম্ফনে গতি আসেনি বলে এই অর্থনীতিতে ৭-৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির জন্য যে বিনিয়োগ মাত্রা দরকার, তা কোনো দিনই এই অর্থনীতি লাভ করেনি। দুর্নীতি, বাজার এবং ব্যবসায়িক ব্যয় বরং এই অর্থনীতি থেকে প্রতিবছর বিনিয়োগযোগ্য মূলধন বিদেশে চলে যাচ্ছে। এক হিসাবে সেই অর্থের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর। কারণ হলো, যাদের অর্থ আছে সেই অর্থ যে করেই হোক তারা সংগ্রহ করেছে; তারা মনে করে তাদের অর্থের জন্য নিরাপদ স্থান হবে বিদেশ। আমরা এই দেশে বসে বসে তাদের শুধু বলেই যাচ্ছি, তারা হলো অর্থ পাচারকারী, তারা দুর্নীতিবাজ, তারা ঋণখেলাপি, তারা ট্যাক্সখেলাপি। কিন্তু এসব আপ্তবাক্য আমাদের অর্থনীতি থেকে কথিত টাকা পাচারের ব্যবস্থাকে বন্ধ করতে পারবে না। যেটা বন্ধ করতে পারবে সেটা হলো সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত না হলেও কম দুর্নীতির সমাজ। আজকে দুর্নীতির ব্যাপারে সাধারণের ধারণা হলো, যার পদ আছে, ক্ষমতা আছে, সম্পর্ক আছে, তারা সবাই দুর্র্নীতিবাজ এবং এই সমাজে দুর্র্নীতির বিচার বলতে তেমন কিছু হবে না। দুর্নীতির বাজারীকরণ এরই মধ্যে হয়ে গেছে। শুধু যেটা দৃশ্যমান নয় সেটা হলো দুর্নীতির বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে মূল্যটা প্রকাশ্য বাজারের মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে না। এই মূল্যটা নির্ধারিত হচ্ছে একটা অদৃশ্য বাজারে। এ ক্ষেত্রেও বাজার একটা নয়, অনেক বাজার। প্রত্যেক ক্ষমতাবান ব্যক্তিই সামর্থ্য অনুযায়ী দুর্নীতির মূল্য হাঁকাচ্ছে। দুর্নীতি হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কেনার ক্ষেত্রে মূল্য দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া। ফলে এই অর্থনীতিতে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো, এ ব্যয়টা বহন করার জন্য সমাজও যেন তৈরি হয়ে গেছে। ফলে এখন দুর্নীতিবাজদের বাজার বেশ রমরমা। কারণ দুর্নীতিকে এখন মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। যে যত বেশি মূল্য দিতে পারে, সেই জিতছে, অন্যরা হেরে যাচ্ছে। সৎ লোকদের লোকে এখন খোঁজে বলে মনে হয় না। কারণ হলো, সততার যেহেতু বাজারমূল্য নেই, সৎ লোকদের খুঁজে তাই কারো কোনো লাভও নেই। সৎ লোকগুলোর ক্ষমতা ও পদও তেমন নেই। কারণ হলো, যে গুণের কোনো বাজারমূল্য নেই, সেই গুণসম্পন্ন লোকদের কেউ ক্ষমতায় ও পদে বসাতে চাইবে না। পদের জন্য সৎ ও দক্ষ লোক খোঁজার সেই ধারণাও এখন অনেকটা পেছনের সারিতে চলে গেছে। জানি না, এখন সততার ওপর কেউ কোনো বক্তৃতা দেয় কি না। যাহোক দুর্নীতির কারণে যেহেতু এটা কিনতে অর্থ ব্যয় করতে হয়, তাতে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের অর্থমন্ত্রীও বলেছেন। আর বিশ্বব্যাংকসহ অন্য গ্লোবাল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রতিবছরই এসব বলে আসছে। কিন্তু কেউ বলছে বলে বা কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছে বলে দুর্নীতির কেনাবেচা কি কমেছে? বরং বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও দুর্নীতির এহেন অপ্রকাশ্য ভালো বাজার থাকলে বিশ্বব্যাংক এত দিনে এই দুর্নীতি নামের একটা প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান বাজারের জন্য কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারে ওই সব দেশকে পরামর্শ দিত। এই সমস্যার দুটি সমাধান অর্থনীতিশাস্ত্র দেয়। এক. সব লোকের প্রজন্ম অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ হয়ে যাওয়া, যাতে এ জন্য যে মূল্যটা হাতবদল হচ্ছে সেটার সমবণ্টন হতো। একে বাজারভিত্তিক সমাধানও বলা হয়। অন্য সমাধান হলো, সমাজে সরকার-প্রতিষ্ঠান বলতে কিছু না থাকা। এসব না থাকলে কাজকর্মে কোনো বাধা আসবে না। বাধা না এলে যারা সরকার ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাধার সৃষ্টি করে তাদের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে না। অবস্থাটা হলো একেবারে মুক্ত। বাধাহীন সমাজ। একসময় এহেন সমাজ হয়তো ছিল। কিন্তু পরে মানুষ ন্যায় ও বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়ে এলো সরকার-প্রশাসন। আর এসব কারণে এলো কর। এখন এসবকে পুষতে কর দিতে হয়। এসবের প্রয়োজন হবে না এ জন্যই যে একেবারে বাধাহীন সমাজে যার জোর আছে সে অন্যকে মেরে ফেলবে, সব সম্পদ নিজের আয়ত্তে নিতে চাইবে। তাই এখন কথিত সভ্য সমাজে সরকার আছে, প্রশাসন আছে, বিচারের জন্য ব্যবস্থা আছে, মানুষের সম্পদ ধারণের অর্থনীতিকে শর্তসাপেক্ষ করা হয়েছে। তবে কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে তারা জনগণকে রাষ্ট্রের দাস বানাতে অস্বীকার করেছে। এর কারণ হলো, জনগণ তাদের মতপ্রকাশের মাধ্যমে কিছু স্বাধীনতাকে যেমন বিসর্জন দিতে রাজি হয়েছে, সম্পদ ধারণ ও ভোগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাগুলোকে অক্ষুণ্ন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব সমাজ চলবে বাজার ও প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। সমাজের এজেন্টগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে তাদের মূল্য ঠিক করার জন্য বাজারের শক্তিকে কাজে লাগাবে। বাংলাদেশ বাজারব্যবস্থার ক্ষেত্রে অন্য অনেক ছোট অর্থনীতি থেকে অনেক এগিয়ে। এই অর্থনীতিতে ৮০ শতাংশ অর্থনৈতিক কাজকর্ম ব্যক্তি খাতের মাধ্যমেই চালিত হচ্ছে। ব্যক্তি খাত আবার বাজার শক্তি দ্বারা প্রভাবিত ও চালিত। চাহিদা-সরবরাহ শক্তিদ্বয় হলো বাজারের নির্ধারক শক্তি। চাহিদা বাড়লে মূল্য বাড়ে, আবার সরবরাহ বেড়ে গেলে মূল্য পড়ে। বাজার সব সময় উন্মুক্ত থাকে না। উন্মুক্ত রাখার দায়িত্ব হলো সরকারের অথবা সরকার কর্তৃক গঠিত কোনো কমিশনের। উন্মুক্ত থাকলে প্রতিযোগিতা থাকবে। প্রতিযোগিতা থাকলে ন্যায্য মূল্য স্থির হতে সুবিধা হয়। এতে কোনো পক্ষ ঠকার আশঙ্কা কমে যায়। তবে বাজারে পণ্যের মূল্য কত হবে তা উৎপাদন ব্যয় ও করারোপের ওপরও নির্ভর করে। দুর্নীতির উপাদান বেশি থাকলে বা দুর্নীতির প্রাইসিংটাও যদি উৎপাদন মূল্যে এসে যায়, তাহলে পণ্যকে অবশ্যই বেশি দামে বাজারে বেচতে হবে। সে জন্য বলে দুর্নীতি ব্যবসায়িক ব্যয়কে বাড়িয়ে দেয়।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন