জাকাত নিতে গিয়ে ২৭ জন নারী-শিশু পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা গেল। এটা জানার পর মুসলমানদের এহেন জাকাতের ব্যাপারে অমুসলিমদের বা একেবারে ধর্মহীন ধর্মনিরপেক্ষবাদীর কাছে ইসলামের এই মহান অনুশাসনের ব্যাপারে কী ধারণা হতে পারে, একবার ভাবুন। দান-চ্যারিটি অন্য ধর্মেও আছে। কিন্তু দান-চ্যারিটি নিতে গিয়ে ওই সব ধর্মের এত লোক পায়ের তলায় পড়ে মরে গেছে, এমন তো শুনিনি। তাহলে আমাদের জাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে কোথাও কি ত্রুটি আছে? নাকি আমাদের লোকগুলো বেশি গরিব যে, তাদের জাকাতের এক টুকরো কাপড় চাই-ই। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এতই এগিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করি, তাহলে তো জাকাত নেয়ার জন্য এত লোকের ভিড় হওয়ার কথা নয়, বরং জাকাত নেয়ার উপযুক্ত লোকগুলোকে খুঁজে বের করার প্রয়োজন হওয়ার কথা। সত্য হলো, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে বটে, তবে বাতির তলের অন্ধকারটা এখনো সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়নি। এখনো অনেক লোক দরিদ্র শ্রেণীতে আছে, যাদের মতো লোকদের আমাদের ছোটবেলায় রেশন কার্ড দিয়ে সস্তায় চাল, চিনি, গম ইত্যাদি দিয়ে রাষ্ট্র থেকে সহায়তা করা হতো। এখন বয়স যাদের ৬০ বছরের বেশি, তারা প্রত্যেকেই নিয়ন্ত্রিত মূল্যের রেশনপদ্ধতি দেখেছে। তখন গরিবদের সেবার অন্যতম উপায় ছিল রেশনে সস্তায় চাল-গম দেয়া। সেই রেশনপদ্ধতি যাকে ইংরেজিতে পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (Public Food Distribution System) বলা হতো। তা দেশ থেকে উঠে গেছে অনেক আগেই। কিছুকাল সরকার ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামের গরিব লোকদের সহায়তা করেছে। এখনো ওই স্কিমটা আছে। তবে অতটা গুরুত্ব দিয়ে এই কর্মসূচিকে এখন আর কেউ দেখে না। এখন শুনি সেই কাবিখা সরকারি অর্থ লোপাটের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। যাক, সরকার এখন গরিব সেবার জন্য ভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাজেটের মাধ্যমে প্রবর্তিত বিভিন্ন সোশ্যাল সেইফটি নেট (ঝড়পরধষ ঝধভবঃু হবঃং) উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে খুব গরিব লোকের সংখ্যা কমেছে বটে, তার পরও কিছু লোক অতি গরিব; উন্নয়ন ও প্রগতি তাদের স্পর্শ করতে সক্ষম হয়নি। এবার জাকাতের কাপড় নেয়ার জন্য শত শত মানুষ ময়মনসিংহে জর্দা কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে ভিড় করেন। জাকাত হলো মহান ইসলাম ধর্মের অন্যতম অবশ্যকরণীয় একটি অনুশাসন। আজকাল সম্পদের ধরনের ভিন্নতা এসেছে। নতুন ধরনের সম্পদের ওশোর ও জাকাতের হিসাব কী হবে এই ব্যাপারে অনেক ইসলামি পণ্ডিত ইতোমধ্যে ভালো নির্দেশনা দিয়েছেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা তাদের সম্পদকে পবিত্র করতে চায় জাকাত দিয়ে। কিন্তু জাকাত কাকে দেবে এ ব্যাপারে আমাদের ধর্মগ্রন্থে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকলেও জাকাত নেয়ার জন্য উপযুক্ত লোক খুঁজতে গিয়ে অনেকেই অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে জাকাত দেয়া যেতে পারে। তবে চুপে চুপে দিলেই ভালো। একটি লোককে জাকাত দিয়ে হেয় করা কোনো ভালো মুসলমানের কাজ হতে পারে না। দেয়ার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আরেক ভাইকে সাহায্য করা। জাকাত দিচ্ছে এটা বলা আবশ্যকীয় নয়। যিনি সমাজে পিছিয়ে আছেন বা যে ছাত্র অর্থের অভাবে পড়তে পারছে না তাকে সাহায্য করতে হবে এইভাবে যে, সে বুঝতে পারবে না তাকে করুণা করা হচ্ছে। জাকাত-দান-সাদাকা- এসব হচ্ছে সমাজে সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কেউ অনেক বেশি জাকাত দিচ্ছে ঘোষণা করা বোধ হয় ধর্মের নিরিখে শুদ্ধ হচ্ছে না। ভালো হতো যদি সৎ এবং উদ্যোগী লোকদের এই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাকাত বণ্টন করা হতো। তাতে ব্যক্তিগতভাবে জাকাতপ্রার্থীকে খোঁজার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আর ব্যক্তিগতভাবে ব্যক্তিকে জাকাত দিলে জাকাতের উদ্দেশ্যও ভালোভাবে সফল হয় না। বাংলাদেশে কিছু সৎ ও উদ্যোগী লোক এক হয়ে জাকাত সংগ্রহ এবং বিতরণের উদ্দেশ্যে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন, নাম দিয়েছেন Centre for Zakat Management বা CZM। এই প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে জাকাতের অর্থে গরিব ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য বৃত্তিসহ অনেক কর্মমুখী পরিকল্পনা নিয়ে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র লোকদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের দরিদ্রতাকে বিদায় করার কাজে ব্রতী হয়েছে। আমি মনে করি, সিজেডএমের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের অর্থকে পরিশুদ্ধ করার এই ধর্মীয় অনুশাসন আমরা পালন করতে পারি। এতিমদের অধিকার সম্বন্ধে আল কুরআন অনেকবারই বলেছে। এরা জাকাত-সাদাকা পাওয়ার উপযুক্ত। আজকাল অনেক এতিমখানার সাইনবোর্ড এখানে-সেখানে দেখা যায়। তবে মনে হয় না সর্বত্র এত এতিম আছে। দেশে এত এতিম থাকার কথা নয়। বেশি আছে গরিব ছাত্র। এদের জাকাতের অর্থ দেয়া যেতে পারে। তবে আজকাল মাদরাসার গরিব ছাত্রদের মুক্তভাবে কিছু দেয়াও প্রায় অসম্ভব। একবার নিজে মসজিদের এক অংশে স্থাপিত মাদরাসা ও এতিমখানায় এতিম তালাশ করতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা মোটেই সুখকর নয়। গেলাম এতিমদের হাতে সামান্য কিছু অর্থ নিজ হাতে তুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু মাদরাসার হুজুরের হস্তক্ষেপের কারণে তা আর সম্ভব হলো না। শেষ পর্যন্ত আমাকে হুজুরের হাতেই দিয়ে আসতে হলো। কারণ হলো তিনি চান না কেউ বেছে বেছে তার পছন্দমতো কোনো ছাত্রকে কিছু অর্থ দিক। তাদের কথা হলো, ছাত্রদের নামে যে অর্থই কেউ দেবেন, তা কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দিতে হবে। সে জন্যই বলছিলাম, আপনি যাকে জাকাত দিতে চাইবেন তাকে এত সহজে দেয়াও যায় না। আমাদের সমাজে সর্বত্রই একটি কৃত্রিমতা সৃষ্টি হয়েছে, যার কাছে সরলতা-নিষ্ঠা মার খাচ্ছে। আমরা কুরআন পড়তে ভালোবাসি কিন্তু অর্থ জেনে পড়তে নারাজ। আমরা মসজিদ নির্মাণে উৎসাহী কিন্তু মসজিদকে যে সুন্দর ও পরিষ্কার রাখতে হবে, সেটা যেন ভুলে গেছি।
সত্য হলো বিশ্বে যত কিতাব-বই রচনা হয়েছে বা ঐশীবাণীর মাধ্যমেও যত কিতাব মানুষের হেদায়াতের জন্য এই পর্যন্ত এসেছে তার মধ্যে আল কুরআন সর্বোত্তম। আল কুরআন হলো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা থেকে মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা। কুরআন জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার। কুরআনকে যত পড়া হয়, ততই পড়তে ইচ্ছে করবে। দুর্ভাগ্য তাদের যারা মহাগ্রন্থ কুরআনকে উল্টিয়ে দেখার সময় পাননি। দুনিয়ার তাবৎ বই, জ্ঞানের অন্য সব উৎস অনেকেই খুঁজে ফিরছেন, কিন্তু কুরআন শরিফ পড়ে দেখেননি। এরাই প্রকৃত হতভাগ্য। মানুষের জীবনটা অতি সংক্ষিপ্ত। কী জন্য সে এই পৃথিবীতে এসেছে, কী করতে হবে এখানে এসব ব্যাপারে কুরআন অতি স্পষ্ট ভাষায় আমাদের সামনে অনুশাসনগুলো তুলে ধরেছে। এক দল লোক আছে যারা অর্থ জমিয়ে ধনী হতে খুব ব্যস্ত। এরাও একধরনের মূর্খ। এরা যদি ভাবত, প্রকৃতপক্ষে মানুষ কোনো কিছুরই মালিক নয়, সব কিছুর মালিক তাদের সৃষ্টিকর্তা; তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং যিনি সব কিছুর ধারক ও বাহক, তাহলে ওই লোকেরা লুট করে দুর্নীতি করে সম্পদের স্তূপ জমা করত না। যারা পিষ্ট হয়ে মরেছে তাদের অত কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ওদের, যারা নিজেদের ধনী মনে করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন, যারা অন্যের সম্পদ লুট করছে, যারা অপচয় করে তারা।
চার দিকে মুসলমানদের আচরণ দেখলে হতাশ হতে হয়। জানার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিলেও তারা জানতে নারাজ। সাম্রাজ্যবাদী মাফিয়া চক্র তাদের সম্পদগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেও সমাজে অনেক লোক ওই সব মাফিয়া ডাকাতের পক্ষে কাজ করে। ইরাক-লিবিয়াকে কারা ধ্বংস করল। ওদের সোনার দেশকে শেষ করে দিয়ে তাদের মধ্যে উপদলের সৃষ্টি করা হয়েছে। যেসব দেশ আগে বিদেশীদের চাকরি দিত, আজ বাঁচার তাগিদে সেসব দেশের লোকেরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে প্রাণ বিপন্ন করে। আর সেই মাফিয়া চক্রের অংশীদারেরা আশ্রয়প্রার্থী এই অসহায় লোকগুলোকে আবার সাগরে ঠেলে দিচ্ছে। বলছে, এসব রিফিউজিরই যত আপদ। সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে যত লোক শরণার্থী হয়ে অন্য দেশে আশ্রয় চাচ্ছে, তাদের ৮০ শতাংশ মুসলমান। কারা মুসলিম সমাজগুলোকে ধ্বংস করে দিলো? কারা তাদের সম্পদগুলোকে নামমাত্র মূল্যে লুণ্ঠন করছে? এসবই অনেক মুসলমান জানে-বোঝে। কিন্তু বৈরী বাস্তবতার কাছে আজ তারা বন্দী। মুসলমানেরা ইসলামের কথা অনেক বলে। কিন্তু বাস্তবে তাদের বড় অংশই এই ধর্মের অনুশাসন থেকে অনেক দূরে। তারা যদি ইসলামই মানত, তাদের তো বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে একে অন্যের প্রাণের জন্য এত তৎপর হতো না। মাজহাবের ভিত্তিতে বিভক্তি এবং যুদ্ধ- এসব কি কোনো ভালো মুসলমানের, যারা কুরআন পড়েছে তাদের কাজ হতে পারে? শুধুই শক্তি আছে বলে অন্য দেশের মুসলমানদের ওপরে বিমান হামলা চালাতে হবে; তাই তো হচ্ছে। ইয়েমেনের মুসলমানদের অপরাধ কী? ফিলিস্তিন যখন জ্বলে তখন মুসলমানদের অর্থ সম্পদ-ক্ষমতা কোথায় থাকে? আজকে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনতা তো এত অভাবের মধ্যে থাকার কথা নয়। ফিলিস্তিনের শিশুরাই তো জাকাত-সাদাকার বড় হকদার। কিন্তু মুসলমানেরা তাদের সাহায্য করার কথা ভাবে কি?
বাংলাদেশের অনেক মার্কেটে জাকাতের কাপড় পাওয়া যায় বলে ব্যানার টাঙানো হয়। কিন্তু একবার ভাবুন তো, জাকাতের কাপড়ের অর্থ কী? সস্তা, পাতলা কাপড় কি জাকাতের কাপড় হতে পারে? শাড়ি-লুঙ্গি কেন জাকাত দেয়ার চিরায়ত নিয়ম হয়ে থাকবে? অনেক লোককে জাকাতের অর্থ ভাগ করে দেয়ার মধ্যে কি আমাদের জন্য বেশি পুণ্য নিহিত আছে? মসজিদগুলোতে অনেক মুসল্লি যাচ্ছে বটে; তবে নামাজের বা সালাতের গুণগত মান নেমে গেছে। শুধু পশ্চিমমুখী হয়ে, উপুড় হয়ে দোয়া পড়ার নামে সালাত হতে পারে না। যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কিভাবে সালাত আদায় করেছেন সেটা আমাদেরকে জানতে হবে। আমরা যদি পূর্ণভাবেই আমাদের আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসর্পণ করি, তাহলে সমাজে অস্থিরতা ও অকল্যাণ বাড়ছে কেন? ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম নয়। এই দ্বীন হলো বোঝার আর অনুভবের দ্বীন। যে-কেউ ধর্মবিরোধী সেকুলার থাকতে পারে, সেটা তার ব্যাপার। তাকে হেয় করার অধিকার আমাদের নেই। মুসলমানেরা অত্যাচার তো করবেই না, অত্যাচারিতও হবে না। আমাদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য থাকতে হবে। সব মানুষকে একই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। ওদের সবাইকে রিজিকও দিচ্ছেন একই সৃষ্টিকর্তা। পার্থক্য হচ্ছে দ্বীনের ওপর যারা কায়েম আছেন, তারা আল্লাহর দেয়া মেসেজ বুঝতে পেরেছেন; অন্যরা পারেননি। আমরা যদি সৎ মুসলমান হতাম তাহলে এই সমাজে এত দুর্নীতি-লুটপাট হতো না। অনেক জ্ঞানী লোক বলে গেছেন, ইসলাম আছে কুরআনে আর মুসলমানেরা আছে কবরে। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া আমাদের কর্তব্য।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
“Those are ill-fated persons who didn’t get time to open the Quran in their lifetime; whereas, in search of truth and knowledge they have gone through all sources of knowledge , except studying the Quran, they are really unfortunate” - Prof. Abu Ahmed
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন