কয়েক দিন আগে টেলিভিশনে পশ্চিম বাংলার একটি বাংলা সিনেমার আংশিক দেখছিলাম। আংশিক এই জন্যই যে, রাতে এখন পুরো সিনেমা দেখতে পারি না, রাত ১০টা বেজে গেলে মনে হয় বিছানা টানছে। সিনেমা যতটা দেখি তা টেলিভিশনের পর্দায়ই। দেখলে হলিউডের ইংরেজি সিনেমায়ই বেশি দেখি। হিন্দি সিনেমাও দেখি, তবে কম, আর বাংলা সিনেমা এর থেকে আরো কম। আমার একটা ধারণা জন্মে গেছে, বাংলা সিনেমা হালকা বিষয় নিয়ে নির্মিত হয় এবং সে ক্ষেত্রে মনে রাখার জন্য কোনো মেসেজ থাকে না। তবে সম্প্রতি কলকাতার 'নোবেল চোর' নামের একটা সিনেমা দেখলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল মেডেলটি চুরি করে চোরের সে কী বিপদ! আমার কাছে ভালো সিনেমা হলো ওইটি, যেটি শেষ পর্যন্ত দর্শকদের ধরে রাখতে পারে। আর মন্দ সিনেমা হলো ওইটি, যেটি বিজ্ঞাপন বিরতিতে দর্শক চ্যানেল পরিবর্তন করে অন্য চ্যানেলের ভালো প্রোগ্রাম খুঁজতে থাকে।
ভালো লাগা-না লাগার এই মাপকাঠি নাটকের ক্ষেত্রেও সত্য। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে যেসব নাটক প্রচারিত হয় সেগুলোর পুরোটা খুব কমসংখ্যক দর্শকই দেখে। বিজ্ঞাপনের নির্যাতনের সময় তারা অন্য চ্যানেলে চলে গেলে আর ফেরত আসে না। ওই দিক দিয়ে ভারতের চ্যানেলগুলো একটু ব্যতিক্রম। তাদেরও বিজ্ঞাপন বিরতি হয়, তবে লম্বা বিরতি নিয়ে। যাক, কলকাতার সেই বাংলা সিনেমার নামটি আমার মনে পড়ছে না। তবে সিনেমার যে অংশটা আমি দেখেছি সেটাতে নায়কের কষ্ট এবং বন্ধু-আত্মীয়দের কাছে ছোটাছুটি এবং ধার চেয়ে টাকা না পাওয়ার যন্ত্রণা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। নায়ক একটা ছোট চাকরি করে। ঘরে বউ আছে, সুন্দরী, তবে হাউসওয়াইফ। নায়ক একটি ছোট ফ্ল্যাট কেনার জন্য অর্ধেক টাকা ফ্ল্যাট নির্মাতাকে অগ্রিম দেয়। আর দরকার আড়াই লাখ টাকা। এই আড়াই লাখ টাকা না দিলে নির্মাতা তাকে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করবে না এবং ওই ফ্ল্যাট অন্যত্র বিক্রি করে দেবে। ক্রেতা নায়কের ফ্ল্যাট কেনা তো আর হবেই না, উল্টো তার দেওয়া অগ্রিম টাকার একটা অংশ হারাতে হবে। অন্য কোনো উৎস থেকে টাকা জোগাড় করতে না পেরে নায়ক বউয়ের পরামর্শ মোতাবেক গেল ধনী ব্যবসায়িক বন্ধুর কাছে ফ্ল্যাটের জন্য বাকি টাকা ধার চাইতে। বন্ধু সব শুনে বলল, টাকা দিতে রাজি আছি, তবে তোমার বউকে আমার কম্পানির বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করতে হবে। নায়ক এ প্রস্তাব শুনে অতি অপমান অনুভব করল এবং বন্ধুকে কয়েকটা কটুবাক্য শুনিয়ে ঘরে চলে এলো। বউকে বলল, টাকা কোথাও ধার না পেলেও আমি তোমাকে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে দেখতে চাই না। নায়ক আরো বিধ্বস্ত হয়ে এবার গেল এক ধনী আত্মীয়ের কাছে।
আত্মীয়ের বাড়িতে ঢুকতেই দেখে তাদের বাড়ির লনে অনেক লোক গ্লাস হাতে নিয়ে দামি পানীয় পান করছে। নায়ক আত্মীয়কে বোন বলে সম্বোধন করে বলল, কী ব্যাপার, এখানে এত লোক কেন, কোনো পার্টি হচ্ছে নাকি? আত্মীয় বোন বলল, হ্যাঁ, পার্টি তো বটেই, সে চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছে, এ উপলক্ষে অফিসের বন্ধু, বস এবং অন্য আত্মীয়দের সম্মানে এই পার্টি থ্রো করেছে। নায়ক নিমন্ত্রণ পায়নি। কারণ সে অতটা উঁচু স্তরের আত্মীয় নয়। সে হঠাৎই এসে উপস্থিত হয়েছে, তাই আত্মীয় বোন পার্টিতে শামিল হওয়ার অনুরোধ করল। খবর পেয়ে আত্মীয়র ব্যবসায়িক স্বামী একটি মদের গ্লাস এই গরিব আত্মীয়র দিকে এগিয়ে দিল। তার বোনও তাকে অনুরোধ করল এই খুশির দিনে তুমি একটু পানই কোরো না! শেষ পর্যন্ত নায়ক কড়া মদ পান করতে অস্বীকার করল, গরম বিয়ার পান করতে রাজি হলো। বেচারা এই গরিব আত্মীয় আগে কখনো মদ-বিয়ারের বোতল-গ্লাস হাতেই নেয়নি। গ্লাস হাতে নিয়ে ইতস্তত করতে শুরু করল। শেষে বোন সম্পর্কের আত্মীয়া এসে তাকে আবার উঁচু গলায় বলল, আরে এক গ্লাসে কী আসে-যায়, দেখছ না অন্যরা কী করছে। নায়ক দুঃখে আছে। হতাশা তাকে পেয়ে বসে আছে। ক্ষুব্ধ থাকার চেতনাটা হারিয়ে গেল। শুরু করল গ্লাসে মুখ রাখার। একে একে চার গ্লাস পান করল। কিন্তু হুঁশ হারায়নি। পার্টি প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় নায়ক বোনকে বলল, তোমরা তো আগে আমাকে অনেক টাকা ধার দেবে বলতে। এখন যে আমার আড়াই লাখ টাকা দরকার। যাক তোমরা কত দিতে পারবে আমাকে বলো। আমি বাকি টাকা অন্য সূত্র থেকে জোগাড় করার চেষ্টা করব। বোন তার স্বামীর কাছে গেল কত টাকা এই গরিব আত্মীয়কে দেওয়া যায় জানার জন্য। ফিরে এসে বলল, ও তো তোমাকে ১০ হাজার টাকা দিতে বলেছে।
নায়ক ক্ষোভে-দুঃখে আর কোনো কথা না বলে সেই স্থান ত্যাগ করল। বাসে যেতে যেতে ভাবল তার এই আত্মীয় শুধু একটি পার্টিতে যে ব্যয় করছে তার একটা অংশও যদি তাকে ধার হিসেবে দিত, তাহলে তার ফ্ল্যাটটা কেনা হয়ে যেত। নায়কের বিশ্বাসে ছেদ পড়েছে। সে ঘরে গিয়ে টাকার সংকট এবং আত্মীয়ার ব্যবহারের কথা বউয়ের সঙ্গে আলাপ করল। বউ তাকে বলল, এমনি এমনি ধার তাকে কেউ দেবে না, হোক না তোমার বন্ধুরা অনেক ধনী, হোক না তোমার আত্মীয়া এক পার্টিতেই অনেক টাকা ব্যয় করছে।
ধনীরাই বেশি অভাবী!
বউ শেষ পর্যন্ত নায়কের বন্ধুর কম্পানিতে বিজ্ঞাপনের মডেল হতে রাজি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সব জড়তা পেছনে ফেলে অর্থের উৎসের সঙ্গে বউ নিজেকে জড়িয়ে দিল। আমার সিনেমা দেখা এই পর্যন্তই শেষ। শেষ অবধি নায়ক ও তার বউয়ের সংসারের কী হয়েছে জানি না। কারণ রাত হয়ে যাচ্ছিল বলে বিজ্ঞাপন বিরতিতে আমিও আর এই সিনেমার শেষ অংশ দেখতে ফেরত আসিনি। এই সিনেমার গল্পের মাধ্যমে আমি আবার যা দেখলাম সেটা হলো ধনীরাই বেশি অভাবী। তাদের আরো চাই। কারণ আরো পেলে আরো বড় পার্টি দিতে পারবে। গরিব আত্মীয়কে দূর থেকে অতি আদরের সঙ্গে ডাকে। কিন্তু গরিব আত্মীয় অতি প্রয়োজনে তাদের কাছে ধার চাইলে বিরক্তি অনুভব করে। সামান্য দিলেও তা এত যে নগণ্য, গরিব আত্মীয় ওই অর্থ দিয়ে সংসারের জন্য অর্থবহ কিছুই করতে পারে না। সত্যিই তো, চারদিকে ধনী লোকের ব্যবহারের প্রতি লক্ষ করুন। তারা ধনী বটে, তবে আরো ধনী হতে চাইছে। উন্নতির জন্য হেন কোনো কাজ নেই, যা তারা করতে চাইছে না। তাদের দরকার টাকা।
কত টাকা হলে তারা সন্তুষ্ট হবে তা তারা নিজেরাও জানে না। তারা টাকার কাছে যে ভৃত্য হয়ে বসে আছে সে জ্ঞান ও ভাবনাটুকু নেই। অল্প অর্থেও যে ভালো এবং অধিক ভালো জীবনযাপন করা যায়, সেটা তারা ভাবতেও অপারগ। ওই যে আমার ছাত্রটা, সে তার পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য এক বছর ধরে 'O' লেভেলের একটি ছাত্রকে পড়িয়েছে। শেষ মাসে ছাত্রের পরীক্ষার কারণে ২০ দিন পড়িয়েছে। আশা করেছিল ছাত্রের মা পূর্ণ এক মাসের বেতন তাকে দেবে। কিন্তু মাস শেষ হওয়ার দুই দিন আগে ছাত্রের মা টিউটরকে ফোনে জিজ্ঞাসা করল শেষ মাসের কত দিনের জন্য তাকে পে করতে হবে। ছাত্র (টিউটর) বলল, আপনার যে কয় দিনের খুশি তত দিনের পে করুন। ঠিকই মহিলা তাকে ২০ দিনের জন্য পে করল। আমার ছাত্রের পূর্ণ মাসের বেতন পাওয়া আর হলো না। সেও আমার কাছে জানতে চাইল, ধনী লোকরা এত কৃপণ কেন? আমি তাকে বললাম, সবাই নয়। তবে কৃপণ ধনী লোক তুমি অনেক দেখবে। অন্য বিষয়টি হলো, তারা নিজের জন্য যখন ব্যয় করে, তখন অতটা কৃপণ নয়। কিন্তু অন্যকে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড়ই কৃপণ। দেখো না, ধনী লোকদের অর্থকড়ি জোগাড় করার ধরন কেমন। তারা কিন্তু ঠেকায় পড়লে বড় রকমের অর্থ দিতে রাজি হয়ে যায়। অথবা তারা লাভটা হিসাব করে ওইভাবে, কত দিলে কত পাওয়া যাবে। তোমাকে বাড়তি ১০ দিনের জন্য পে করলে তো বিনিময়ে তারা কিছুই পাচ্ছে না। সুতরাং তুমি যে পে পেয়েছ তা নিয়েই সন্তুষ্ট থেকো। আর তোমার বয়স তো কম। জীবনে চলার পথে এ রকম লোক আরো অনেক পাবে। আসলে কী জানো, দেশে যে করপোরেট সংস্কৃতির ল্যাংটা দৌড় চলছে, ওই ল্যাংটা দৌড় লোকজনকে শুধু নিজকে নিয়ে ভাবা শেখাচ্ছে। আস্তে আস্তে লোকগুলো কেমন যেন অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে। কাউকে মন খুলে কিছু দিতে চায় না। সর্বত্র একটা কৃত্রিমতা যেন বাসা বেঁধেছে। প্রেম-ভালোবাসাতেও যেন একটা কৃত্রিমতা এসে গেছে। অর্থের লেনদেন সর্বত্রই মূল্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। লোকজন শিক্ষিত হচ্ছে বটে, তবে ভালো মানুষ বলতে আমরা আগে যা বুঝতাম, এখন সেই ভালো মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ধনীর পেছনে একটা কদর্য ইতিহাস আছে। তবে এ-ও ঠিক, অনৈতিক কাজ সমাজে এত বেশি প্রচলন হয়ে গেছে যে অনৈতিকতাকে ওই সব লোক আর পাত্তাই দেয় না। ঘুষখোর ব্যক্তির কাছে ঘুষ গ্রহণ করা কোনো ব্যাপারই নয়। আর যে ঘুষ দিচ্ছে তারও ভাবনা হলো ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। ফলে আমরা যে আদর্শ মানুষকে এখনো খুঁজে বেড়াই, তাদের দেখা পাওয়া কঠিন। অনেক লোক আছে যারা যতক্ষণ ক্ষমতার অংশীদার হতে পারে না, ততক্ষণ মনে হয় তারা ভালো। কিন্তু পদ আর ক্ষমতা পেলেই তাদের আসল রূপটা বের হয়ে পড়ে। আমি এমন লোকও পেয়েছি যে পদে বসে ঘুষের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। এখন বোঝো, এমন লোকদের মধ্যে কি আদর্শ লোকদের সন্ধান পাবে? ধনী লোকরা যে বেশি খেতে পারে, বেশি ভোগ করতে পারে, তা নয়। তবে তারা বেশি ব্যয় করে, যে ব্যয়ের একটা বিরাট অংশ অপচয়। ধনী লোকদের অভাব নেই, তবে অভাববোধ বেশি। ওই অভাববোধের কারণেই তারা কৃপণতার বৃত্তের মধ্যে আটকে থাকে। ধনী লোকদের অন্য দুটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সব প্রতিবাদী শক্তি হারিয়ে ফেলে, তারা শক্তিকে কৃপা করে এবং ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে কাতর থাকে। কিন্তু এভাবে চলে এবং এই অনৈতিকতা চর্চা করে যে সম্পদ তারা স্তূপ করছে ওইগুলোর উপযোগিতা কী? শেষেও বলতে চাই সব ধনী লোক এক নয়। অনেকে প্রতিভা ও পরিশ্রমকে এক করে সব নীতিনৈতিকতা মেনে ধনী হয়েছে। তারা অবশ্যই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
আমিও কিছু corporet compani & media house থেকে সহযোগিতা চেয়ে পএ দিয়েছিলাম ? ফলাফল শুণ৽ !!!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন