শিক্ষক- সেকালের এবং একালের
29 November 2014, Saturday
আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মাস্টার আবদুর রশিদ আমাকে সাইকেলে করে আমার বাড়ি থেকে চার মাইল দূরে দাগনভঁূঞার কামাল আতাতুর্ক হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। পথে ছোট ফেনী নদী। বাঁশের সাঁকো। আমি সাঁকো পার হতে পারি না। সাঁকোতে উঠলে আমার পা কাঁপে। রশিদ স্যার এক হাতে সাইকেল আলগে কাঁধে তুললেন, অন্য হাতে আমাকে ধরে সাঁকো পার করলেন। পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার কলম নেই। সেই কালে, ১৯৫৯ সালে দোয়াতের মধ্যে কলম চুবিয়ে লিখতে হতো। কলম একটু দামি হলে কলমের পেটে কালি ভরা যেত। স্যার আমাকে কালি ভরা একটি কলমও কিনে দিয়েছিলেন। আমার প্রাইমারি স্কুলের আরেক শিক্ষক মাস্টার সুলতান আহমেদ আমাকে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করাতে কিছু দিন নিজ বাড়িতে রেখে পড়িয়েছিলেন। পড়ানোর ও খাওয়ানোর জন্য কোনো অর্থ নেননি। এভাবে আরো কত শিক্ষকের কথা বলব যাঁরা প্রাইমারি থেকে হাই স্কুল, তারপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার গুণের মধ্যে ছিল আমি ভালো ছাত্র ছিলাম।
প্রাইমারি, অষ্টম শ্রেণি থেকে বৃত্তি নিয়ে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যন্ত বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করেছিলাম। তখন বৃত্তির যে টাকা দেওয়া হতো, তাই দিয়ে একজন মেধাবী ছাত্রের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যেত। আরো ভালো চলতে চাইলে একটা টিউশনি করলেই হতো। টিউশনি তখন সহজেই পাওয়া যেত। উচ্চতর শিক্ষার জন্য অর্থনীতিকেই বরণ করেছিলাম। তখন এবং এখনো অর্থনীতির একটা আলাদা কৌলীন্য আছে। ভালো ছাত্ররা অর্থনীতি, ইংরেজি ও ইতিহাস পড়ত। কেন যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সময়ে সেই ১৯৬৭ সালে অর্থনীতি আরো মূল্যবান হয়ে পড়ে। সেই সময়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ভর্তি পরীক্ষা হতো না। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে যে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা হতো সেই ফলের ওপর ভিত্তি করে ছাত্রদের ভর্তি করানো হতো। আমার যেহেতু উভয় পরীক্ষার ফল অতি ভালো ছিল, সে জন্য অর্থনীতিতে ভর্তি হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ভালো ফলের কারণে প্রথম বর্ষ থেকে হলে সিট পেতেও কোনো অসুবিধা হয়নি। অর্থনীতিকে মন দিয়ে পড়েছি, বলা চলে একপর্যায়ে প্রাণ দিয়ে পড়েছি। যতই পড়তাম ততই পড়তে ইচ্ছা করত। একেক অর্থনীতিবিদের একেক ব্যাখ্যা। তবে উচ্চতর পর্যায়ে অর্থনীতি পড়তে গিয়ে একটা বিষয় ভাবতাম, অঙ্কে যদি আরো ভালো হতাম তাহলে আরো ভালো হতো। সত্যি কথা কী ষাট ও সত্তরের দশকে অর্থনীতিতে অনেক অঙ্ক প্রবেশ করেছে, যেগুলো অবশ্যই বুঝতে হতো। যেসব শিক্ষক প্রথমে অঙ্ক ও প্রকৌশল পড়ে পরে অর্থনীতি পড়েছেন, তাঁরাই পরবর্তী সময়ে নামকরা অধ্যাপক হয়েছেন। তাঁদের মধ্যেই অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সংখ্যা অধিক। পরে আমিও অর্থনীতির শিক্ষকতাকে বেছে নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি ১৯৭৬ সালে। বলা চলে ৩৮-৩৯ বছর আগে। এরই মধ্যে এত বছর ক্লাসরুমে ছাত্র পড়িয়ে ফেলেছি। সময়টা কিভাবে চলে গেল যেন টেরই পাইনি। আজকে আমার অবসরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এটা নিয়ে আফসোস নেই। সবাইকে একদিন অবসরে যেতে হয়। আমার থেকে অনেক মেধাবী ছাত্র-শিক্ষকও অবসরে চলে গেছেন। কেউ কেউ এই দুনিয়া থেকেও বিদায় নিয়েছেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ফলে কোনো দিন মনে এ কথা জাগেনি যে আমি একটা ভুল পেশাকে গ্রহণ করেছি। বরং বলা চলে গর্ব অনুভব করেছি এই পেশার একজন সদস্য হতে পেরে। যতই সামনে এগিয়েছি ততই শিক্ষকতাকে উপভোগ করেছি। ঘণ্টার কাঁটায় কাঁটায় ক্লাসে যেতাম। ঘণ্টা শেষ হওয়ার পর ক্লাস ত্যাগ করেছি। ত্যাগ করার সময় কখনো কখনো একটু বেশি সময় দিয়েছি। দরজায় পরের ঘণ্টার জন্য আরেক শিক্ষক দাঁড়িয়ে আছেন টের পেলে তাড়াতাড়ি নিজের বক্তব্য শেষ করেছি। ছাত্রদের কোনো কিছু বোঝার থাকলে আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার বসার রুম পর্যন্ত আসতে বলতাম। যখন যে কোর্স আমাকে পড়ানোর জন্য বলা হয়েছে সেই কোর্সই পড়ানোর চেষ্টা করেছি। অবশ্য আমার যে বিষয়গুলোতে দক্ষতা বা মনোযোগ ছিল সেটা তো অবশ্যই দেখেছি। শিক্ষকতা জীবনে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়োগ পেতে হলে কিছু গবেষণা কর্ম ও প্রকাশনা দেখাতে হয়। সেই সব কিছুর আমার কমতি ছিল না। যথাসময়ে আমি সহকারী, সহযোগী এবং অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়েছি। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো তদবির দরকার হয়নি। আমার জন্য তদবির করার কেউ ছিলও না এবং আমি নিজেও তদবিরে কাঁচা ছিলাম। যা হোক, অবশ্যই আমি একটা ন্যায় আচরণ পেয়েছি। সহকর্মীদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে অনেকবারই নির্বাচন করেছি এবং প্রায় প্রতিবারই ভালো ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছি। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বিভাগের চেয়ারম্যান, ফ্যাকাল্টির ডিন, অর্থ কমিটির সদস্য, সিনেট ও শিক্ষক সমিতির সদস্য নিয়োগ বা নির্বাচিত হয়েছি। শিক্ষক হিসেবে সব সময় সৎ থাকতে চেষ্টা করেছি। আমার ছাত্রদের জানতে চেষ্টা করেছি।
যতটা পড়িয়েছি তার থেকে বেশি চেষ্টা করেছি তাদের মানসম্মত বই রেফার করতে। আমি মনেপ্রাণে চাইতাম অন্তত আমার ছাত্ররা মানসম্মত অর্থনৈতিক এবং অর্থনীতির লিটারেচারগুলোর সান্নিধ্যে আসুক। অন্তত তারা বুঝতে পারবে তাদের কতটুকু জানতে হবে, শিখতে হবে। তার পরও যে সব কিছু তাদের জানাতে পেরেছি সেটা বলব না। অপূর্ণতা এবং অস্পষ্টতা থেকে গেছে এখানে সেখানে। অনেক সময় ক্লাসগুলো ঠিকমতো অনুষ্ঠিত হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ থাকলে ব্যথা পেতাম। ছাত্ররা অতি সহজেই আমার থেকে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশংসাপত্র পেয়েছে। আমি সময় ক্ষেপণ না করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিতে চেষ্টা করেছি। শিক্ষকতার পাশাপাশি অর্থনীতির অতি প্রয়োজনীয় ইস্যুগুলো নিয়ে আমি ব্যাপকভাবে সংবাদপত্রগুলোতে লিখেছিও। শেয়ারবাজার বিষয়ে বেশি বক্তব্য দেওয়ার কারণে লোকে আমাকে একজন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ মনে করে। যত দিন শরীর-স্বাস্থ্য ভালো ছিল তত দিনই সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছি। লোকে আমাকে শেয়ারবাজার অর্থনীতি নিয়ে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানালে আমি সানন্দে রাজি হয়ে যেতাম। আমার একটা আত্মবিশ্বাস ছিল এবং এখনো আছে যে অর্থনীতির নীতিবিষয়ক ইস্যুগুলো নিয়ে আমার পরিষ্কার ধারণা আছে। বিপরীতমুখী ব্যাখ্যাগুলোর ক্ষেত্রেও আমার কিছু জ্ঞান ছিল।
শিক্ষক- সেকালের এবং একালের
শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক পাঠদান তো করবেনই। কিন্তু ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করা, তাদের মধ্যে নৈতিকতার একটা মজবুত ভিত তৈরি করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অনন্য। কোনো পুরনো ছাত্র পেলে আমি এখনো তাকে বলি পরিশ্রম করো আর সৎ থেকো। আজকে কোনো কোনো শিক্ষকের অধঃপতন দেখলে ব্যথা পাই। শিক্ষক কিভাবে টাকার বিনিময়ে ছাত্রদের নম্বর প্রদান করেন। তারা শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার। শিক্ষক নিজ ছাত্রকে অর্থের বিনিময়ে পড়াতে পারেন না। কারণ তাঁর কাছে যে প্রাইভেট পড়ল আর যে পড়ল না এই দুই ছাত্রের মধ্যে শিক্ষক তো তফাত করতে পারেন না। কিন্তু আজকে শুনি শিক্ষক টাকার বিনিময়ে ছাত্রদের বেশি বা কম নম্বর দিচ্ছেন। এটাও শুনি শিক্ষকরা আজকে টাকার বিনিময়ে চাকরি নিচ্ছেন। যারা টাকার বিনিময়ে চাকরি নিচ্ছেন, তাঁরা কিভাবে ছাত্রদের উচ্চ নৈতিকতার বিষয়ে শিক্ষা দেবেন! দুঃখ এই যে আজকে সর্বত্রই দুর্নীতির কালো হাত বিস্তার লাভ করেছে। ভালো শিক্ষকরাও এখন তাঁদের ছাত্রদের সৎ থাকতে এবং পরিশ্রম করতে বলে ফল পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন। নামি স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষগুলোতে পাঠদানে অমনোযোগী। তাঁরা ব্যস্ত কোচিং ব্যবসা নিয়ে। ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে অর্থের লেনদেনের একটা ব্যাপার এসে গেছে। যার ফলে এখন আর শিক্ষক সেই আগের আসনে নেই। কিন্তু আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন শিক্ষক নিজ ছাত্রকে প্রাইভেট পড়িয়ে অর্থ নেবেন সে বিষয়টি ছিল অচিন্তনীয়। অন্য একটি বিষয় হলো, শিক্ষার প্রসারতা বৃদ্ধি পেয়েছে সত্যি। কিন্তু শিক্ষার মান ভয়ানকভাবে কমে গেছে। গরিব-মেধাবী ছাত্রদের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়া আজকে কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের সময়ে শিক্ষার যদি এই হাল হতো, তাহলে আমার মতো অনেক ছাত্র পড়তে পারত না। তখন মেধাবীদের একটা মূল্য ছিল। মেধাবীদের জন্য শিক্ষার ব্যয় সরকারই বহন করত। আজকে মেধাবীরা যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের নিচে পড়ে যাচ্ছে বারবার। তাদের বাবার অর্থ না থাকলে তাদের পক্ষে তীরে আসা দুস্তর কঠিন ব্যাপার। আগের মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার শিক্ষকও কমে গেছে। আমার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ বি এম তালেব আলী এসএসসি পরীক্ষার পর আমাকে নিয়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা কলেজ চট্টগ্রাম কলেজে গেলেন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করানোর জন্য। যত দিন আমার হোস্টেলে জায়গা হয়নি তত দিনের জন্য থাকার ব্যবস্থাটিও করে দিয়েছিলেন। আমার হাই স্কুলের অন্য শিক্ষক ললিত মোহন দত্ত গুপ্ত আমার এসএসসি পরীক্ষার দিন পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমি বের হলে পরীক্ষা কেমন হয়েছে সেটা জিজ্ঞাসা করার জন্য। এমন শিক্ষকরা কি আজও আছেন? আছেন তো বটে, তবে সংখ্যায় অনেক কমে গেছেন। আজকে জাতি শিক্ষিত হচ্ছে বটে, সেই সঙ্গে বেশি দুর্নীতিবাজও হচ্ছে। তাহলে কোথায় আমরা শিক্ষকরা ব্যর্থ হলাম। আমরা সফল হলে তো শিক্ষিত লোকেরা চোর হতো না!
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
( কালের কণ্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন