শুধু অর্থবিত্তই কি সম্পদ?
12 October 2014, Sunday
অধিকাংশ মানুষের ধারণা, সম্পদ হল অর্থ-কড়ি, বাড়ি-ফ্ল্যাট, গাড়ি, জমি-জমা, শেয়ার-বন্ড ইত্যাদি। এসব সম্পদ জোগাড় করার জন্য মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ সৎ পথে পরিশ্রম করে এসব সম্পদ জোগাড় করতে ব্যস্ত, কেউ বাঁকা পথে, অসৎ পথে, ক্ষেত্র বিশেষে লুণ্ঠনের মাধ্যমে এসব সম্পদ জোগাড় করতে ব্যস্ত। এসব সম্পদ অর্জন করা ও জোগাড় করার মধ্যেও পার্থক্য আছে। অর্জন করলে লোকে বলে আর্থিকভাবে সফল লোক, আর লুণ্ঠন ও প্রতারণার মাধ্যমে ওই সব সম্পদ জোগাড় করলে তাকেও আজকের দিনে সফল লোকই বলা হচ্ছে। সম্পদ জোগাড় করার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে খুব কম লোকই প্রশ্ন তোলে। সম্পদ জোগাড় করার যে নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা সমাজে শুরু হয়েছে, এর মূলে আছে ভোগবাদের উত্থান। এখন সমাজের অধিকাংশ লোক মনে করে, সম্পদ সম্মান আনে, সম্পদ উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করে, সম্পদ মানবীয় প্রতিভা ও গুণ বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। তারা এও ভাবে, সম্পদ সবকিছু করতে পারে। ফলে সমাজ থেকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য তিরোহিত এবং নীতি-নৈতিকতার মূল্যবোধ বিদায় নিয়েছে।
সম্পদ আহরণের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা থেকে সমাজে যে এত ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেটাও অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক কথিত ধনী লোক আরও ধনী হতে চায়। সেটা যেভাবেই হোক না কেন। এর ফল হল, অন্যরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে অথবা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের শ্রম ও মেধার মূল্য পাচ্ছে না।
সম্পদের ভুল সংজ্ঞার কারণে প্রতিটি পুঁজিবাদী সমাজেই উৎপাদন ও ভোগের ওপর শতভাগ গুরুত্বারোপ করা হয়। এমনকি সুখকে পরিমাপ করা হয় কত ভোগ করা হল তার দ্বারা। তাই এসব সমাজের স্লোগান হল, বেশি বেশি উৎপাদন করো, বেশি বেশি ভোগ করো।
অর্থ-কড়ির পরিমাণকে সম্পদ আখ্যায়িত করার ফল হল- মানুষের অন্য গুণগুলোকে আমরা মূল্যহীন করে তুলেছি। আমরা সম্পদের পরিমাণকে মাপতে শিখেছি বাজারমূল্য দ্বারা। যে বস্তুর বা গুণের বাজারমূল্য নেই, সেটা পুঁজিবাদী সমাজে কোনো সম্পদই নয়। ওদের কথা হল, কোনো কিছু প্রয়োজনীয় হলে তো তার একটা মূল্য থাকবে। যেমন, মানুষের শ্রমের বাজারমূল্য আছে, তাই সে অর্থে একজন শ্রমিকও সম্পদ, যাকে বলা হয় শ্রমসম্পদ। কিন্তু যে লোকটা বেকার তার কি মূল্য আছে? আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো মূল্য নেই। কারণ বাজার তাকে কোনো মূল্য দিচ্ছে না। কিন্তু বেকার লোকটার নিজের কি কোনো সম্পদ নেই? আছে, তবে সেই সম্পদ বাজারে বিক্রি হয় না বলে আমরা তাকে সম্পদ বলছি না। যেমন, একজন বেকার লোকের সততা। সততার কি কোনো মূল্য নেই। মুশকিল হল, বেকার লোকটা যতক্ষণ পর্যন্ত একটা কাজে লেগে যেতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সততার জন্য সে আলাদা করে কোনো মূল্য পাবে না। সৎ সমাজে সততার মূল্য অনেক। কিন্তু মাফিয়া শাসিত সমাজে সততার তেমন মূল্য নেই। কিন্তু সৎ লোকটা যদি সততার গুণকে মানবজীবনের জন্য একটা মূল্যবান উপাদান মনে করে, তাহলে সে তার সততার গুণ থেকে অনেক তৃপ্তি পাবে। মুশকিল হল, অর্থ-বিজ্ঞান তৃপ্তি বা সন্তুষ্টিকে পরিমাপ করতে জানে না এবং সে জন্য এই গুণ থেকে উৎসারিত তৃপ্তির কোনো বাজারমূল্যও নির্ধারণ করে না। একজন লোক শিক্ষিত, অন্যজন অশিক্ষিত। কিন্তু শিক্ষিত বেকার লোকটার আপাতত কোনো বাজারমূল্য নেই, যতদিন সে বেকার থাকবে। অন্যদিকে অশিক্ষিত লোকটার বাজারমূল্য আছে, যদি সে কাজে নিয়োজিত থাকে। একজনের চার ছেলেই শিক্ষিত। এক হিসেবে এই ব্যক্তির পরিবার অনেক সম্পদশালী। কিন্তু টাকা-পয়সার পরিমাপে সেই পরিবার সম্পদশালী নাও হতে পারে। অনেক পিতা তার সন্তানের হাতে অনেক অর্থ তুলে দেয়ার জন্য সদা উদগ্রীব থাকেন। আবার অনেকে তার সন্তানকে সম্পদ না দিয়ে তার জন্য ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করে যান।
একজন শিক্ষিত লোক এক অর্থে সম্পদশালী। শিক্ষার কারণে তার যে মানবীয় গুণের বিকাশ ঘটেছে, সে গুণের জন্য যদি মূল্য ধরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে শিক্ষিত লোকটার জমায়িত অর্থ না থাকলেও সে সম্পদশালী। আমরা ভালো চরিত্রের কথা বলি। কিন্তু ভালো চরিত্রের মূল্য কত? ভালো চরিত্রের বাজার আছে কি, যে বাজারে এ গুণের জন্য একটি মূল্য পাওয়া যাবে? সুতরাং সবকিছু বাজারমূল্যে পরিমাপ করা যায় না। মানুষের সৌন্দর্য, মুখের মিষ্টি হাসি, ভালো অভিজ্ঞতা- এসবের বাজার আছে কি? থাকলে এসবের মূল্য কত? নগদ অর্থ-কড়ি, বাড়ি-গাড়ি থেকে মানুষের এ গুণগুলো অনেক অর্থেই বেশি মূল্যবান।
মানুষ কি অর্থ ব্যয় করে কারও কাছ থেকে তার জন্য মিষ্টি হাসি কিনতে পারবে? অর্থাৎ সে কি তার সম্পদের মাধ্যমে মিষ্টি হাসির লোক হতে পারবে?
অর্থ অনেক কিছু কিনতে পারে; কিন্তু অর্থ পরিবারের জন্য সুখ কিনতে পারে না। সুখের মাত্রার ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য অনেক কম। মানুষকে আপনি জিজ্ঞেস করুন, তারা যেসব রোগ-শোকে ভুগছেন এগুলোর বিনিময়ে তারা কী দিতে প্রস্তুত। অধিকাংশই বলবে, তাদের অনেক সম্পদ সত্ত্বেও তারা সুস্থতা চান। তাহলে সুস্থতা ও ভালো স্বাস্থ্য হল সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু এ সম্পদেরও বাজারমূল্য নেই। আর সে জন্যই সুস্থ লোকটাকে আমরা বলছি দরিদ্র, আর হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি হওয়া লোকটাকে বলছি ধনী। এখানেই আমাদের ভুল। অর্থ সুখ কিনতে পারে না সেটা তো পুরনো কথা। তাহলে যেটা সুখই কিনতে পারে না, সেটা জোগাড় করার জন্য এত ইঁদুর দৌড় কেন?
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন