আমার আত্মীয়দের মধ্যে আগে যারা গরিব ছিল তাদের ছেলেমেয়েরা কিছুটা শিক্ষিত হয়ে ছোট ব্যবসা করে এবং বিদেশ গিয়ে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছে। আবার দ্বিতীয় জেনারেশনের কম শিক্ষিত কিন্তু আর্থিকভাবে সচ্ছল, তাদের ছেলেমেয়েরা আরো শিক্ষিত হয়েছে বা হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় লক্ষ করলাম, তাদের ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ ইংলিশ মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। আমি তাদের এই উন্নয়ন দেখে খুশি হলাম। ভাবলাম, এত দিন আমি যা বলে আসছিলাম এরা তা-ই করছে। আমি বলে আসছিলাম, দরিদ্রতাকে পেছনে ফেলতে হলে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষাই কেবল পারে দরিদ্র কাউকে ওপরে তুলতে। আজকে বাংলাদেশের দরিদ্র শ্রেণির লোকদের মধ্যে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ঘরে দুই ঘণ্টার জন্য যে বুয়া কাজ করে, তার ছেলেমেয়েরাও স্কুলে পড়ে। দেখে মনে হলো, বুয়া একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। অন্য যে ব্যাপারটি লক্ষণীয় তা হলো, যাদের সামর্থ্য আছে তারা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে পছন্দ করছে। সমাজে এখন ইংলিশ মাধ্যমের স্কুলের রমরমা ব্যবসা। এই ব্যবসায় কেউ ফেল করেছে বলে আমার জানা নেই। বলা চলে সামর্থ্যবানরা অর্থ দিয়ে বিদ্যা কিনতে রাজি। অর্থ যতই যাক না কেন, তারা চাচ্ছে তাদের সন্তানরা ইংরেজি শিখবে, ইংরেজি বলবে, স্মার্ট হবে, কোনো ব্যাপারেই পিছিয়ে থাকবে না। সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তানদের একটা বড় অংশ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে। ব্যয়টা বাংলাদেশ থেকেই হচ্ছে। বাংলাদেশের ভাণ্ডারে এখন অনেক বৈদেশিক মুদ্রা জমা আছে। লেখাপড়ার ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উদারভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অবমুক্ত করছে। অবস্থাটা হলো, প্রতিযোগিতায় ওপরে থাকতে হবে। হ্যাঁ, সমাজে বিভিন্ন রকমের শিক্ষা বিক্রেতা আছে। ওই সব বিক্রেতাকে আমরাই সৃষ্টি করেছি। অনেকে বলেন, একই রকমের শিক্ষা হলে দেশে অসুবিধা কোথায়। আমি বলি, এটা বাস্তবসম্মত নয়। বাজার অর্থনীতিতে বিভিন্ন রকমের শিক্ষা থাকবেই। বিদেশেও আছে। সবাই একই রকম শিক্ষা নিতে চাইবে না। যারা ইংরেজি মাধ্যমে 'O' লেভেল, 'A' লেভেলের জন্য পড়ছে তাদের কি বাংলা মাধ্যমের আমাদের বোর্ডগুলোর সিলেবাস ও শিক্ষাব্যবস্থা যে ভালো সেটা কি বোঝানো যাবে? আসলে শিক্ষাটাও এখন গ্লোবাল হচ্ছে। অনেক পরিবার ব্যবসা করে জেলা শহরে, কিন্তু বাসাভাড়া নিয়ে থাকে ঢাকায়, শুধু সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য। ভালো স্কুল মানে ভালো শিক্ষা তাও নয়। তবু মনের একটা সন্তুষ্টি পাওয়া যায় তাদের সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়ছে।
এই যে সবাই ঢাকামুখী হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হলো ভালো শিক্ষা নেওয়ার জন্য অনেকেই ঢাকায় আসছে। এখন টিউশন বাণিজ্যসমেত শিক্ষা-বাণিজ্যের টার্নওভার হিসাব করলে টাকার অঙ্কে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য দাঁড়াবে। শিক্ষা-বাণিজ্য হয়ে পড়েছে অর্থনীতিতে অন্যতম বড় বাণিজ্য। এই বাণিজ্যে মুনাফার হার অনেক বেশি। এই মুনাফার বিষয়টি সবাই এখনো টের পায়নি। টের পেলে অনেকে আরো চাহিদামতো স্কুল-কলেজের ব্যবসা খুলে বসত। ১৬ কোটি মানুষের দেশে শিক্ষার জন্য একটা বড় চাহিদা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই চাহিদার সবটা সরকারের পক্ষে জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, সরকারের কম মূল্যের শিক্ষা উচ্চবিত্তদের পছন্দের নয়। তারা সরকার যেখানে আছে সেখানে থাকতে চায় না। তারা মনে করে, সরকারি টেক্সট বুক বোর্ড অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় শিখতে বলে। ওই সব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বদলে তাদের সন্তানরা গ্রামার, বিজ্ঞান, অঙ্ক এবং নৈতিক শিক্ষা নিতে পারলে ভালো করবে। তাই গত এক দশকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার এক বিশাল চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু লোক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা বাণিজ্যের রূপ দিয়েছে। চিন্তা করে দেখুন, তারা গ্লোবালি প্রতিযোগিতা করে এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে আগ্রহী নয়। তারা আগ্রহী ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে, যেগুলো থেকে নিজেরা ইচ্ছামতো শিক্ষা সনদ বেচতে পারবে। সে জন্যই বলা হয়, 'O' লেভেল, 'A' লেভেলের ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল চালানোর চেয়ে কথিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা সনদ বিক্রি করা অনেক সহজ। যেহেতু সমাজে দাঁড়ানোর জন্য একটা একাডেমিক ডিগ্রি প্রয়োজন, সে জন্য অনেকে অর্থ দিয়ে এসব সনদ কিনছেও।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। তদবির করে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সনদ-বাণিজ্য করছে। এ জনাবরা কিন্তু কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আগ্রহী নন। কারণ কলেজ তো সনদ বেচতে পারে না। তাদের চাই এমন এক বিদ্যালয়, যে বিদ্যালয় নিজে নিজেই একাডেমিক ডিগ্রির সনদ বেচতে পারবে। অবশ্য অন্যত্র তদবির-বাণিজ্য ভালোভাবেই চলছে। ব্যাংক-বীমা কম্পানির প্রয়োজন না থাকলেও তদবির করে এসব কম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তদবির ছাড়া সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত কোনো প্রকল্পে কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উপাচার্য-কোষাধ্যক্ষ-সিন্ডিকেট সদস্য নিয়োগ ও মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয়করণ হচ্ছে, যেটা আগে কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। মানুষ চায় অর্থ দিয়ে হলেও একটা মানসম্মত শিক্ষা কিনতে। আর সে জন্য বিদেশি সিলেবাসে পড়ানো হয় এমন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর এত মূল্য। কেউ যদি বিদেশি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস (Campus) স্থাপন করতে উদ্যোগী হন, তাহলে তিনিও দেশের উপকার করবেন।
শিক্ষার মান এবং বাণিজ্য
উচ্চ-মধ্যবিত্তের সন্তানরা দেশি ডিগ্রি নিতে চায় না। তারা চায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। তাই ওই রকম শাখা স্থাপন করতে পারলে ছাত্রের অভাব হবে না। মালয়েশিয়া এবং ভারত এরই মধ্যে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে। উচ্চবিত্তের মধ্যে এ ধারণা ভালোভাবে পাকাপোক্ত হয়ে তাদের মননে বসে গেছে, কে কোন ডিগ্রি নিচ্ছে সেটা বড় কথা নয়, কোথা থেকে ডিগ্রিটা নেওয়া হচ্ছে সেটাই বড় কথা। উচ্চশিক্ষার মানের দিক দিয়ে উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিগ্রিগুলো এখনো সেরা। হাজার হাজার ভারতীয়-চায়নিজ-জাপানি ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে। গবেষণা ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমকক্ষ অন্যরা হতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না। সারা বিশ্ব চেষ্টা করেও কি একটা হার্ভার্ড, একটা এমআইটি (MIT) দাঁড় করাতে পারবে? বিশ্বের অন্যত্র দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এদের সমকক্ষ না হলেও অনেক নাম-দাম কুড়িয়েছে। বিলেতের অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ এমনই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। দুটির সংক্ষেপে নাম দিয়েছে ওরা অক্সব্রিজ (Oxbridge)। আমাদের দেশের কিছু ছাত্রও অক্সব্রিজের ছাত্র হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বিলেতের অন্য দুটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ইমপেরিয়াল কলেজ এবং এলএসই। সারা বিশ্ব থেকে ছাত্ররা এই দুটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে নানাবিধ পরীক্ষার মাধ্যমে চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে হলে GRE, GMAT নামের পরীক্ষাগুলো দিতে হয়। সারা বিশ্বের ছাত্ররা এসব পরীক্ষা দিচ্ছে।
অনেক বাংলাদেশি ছাত্রও এসব পরীক্ষা দিয়ে ভালোই করে। যারা ভালো করে গ্র্যাজুয়েট লেভেলে ভর্তি হতে পারে, তারা কোনো না কোনো ধরনের বৃত্তি পেয়ে থাকে। অর্থাৎ তারা MA, MSC, PhD এসব ডিগ্রির জন্য অধ্যয়ন তাদের খরচেই নির্বাহ করতে পারে। অনেক দরিদ্র-মেধাবী ছাত্র এসব ডিগ্রি কখনোই নিতে পারত না, যদি না তাদের জন্য TA, RA বা অন্য নামের বৃত্তিগুলো থাকত। এখন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি ছাত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশি শিক্ষকও পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গে যারা লেখাপড়া করেছে তাদের অনেকে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাদের অনেক ছাত্র এখন শিক্ষকতা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বড় বড় চাকরি করছে। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার একটা স্রোত লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এই যাওয়াতে অনেক কষ্ট আছে। ওই সব দেশে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে একাডেমিক ডিগ্রি যেমন থাকতে হবে, তেমনি পরিশ্রম করতে হবে। বাংলাদেশিরা নিজ দেশে থাকলে ফাঁক খোঁজে বেশি, কিন্তু বিদেশে গেলে পরিশ্রম করে এবং নিয়ম মেনে চলে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও এককালে বেশ নামডাক ছিল। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেড়েছে; কিন্তু সত্য হলো, নামডাকটা আর নেই।
এ বিশ্ববিদ্যালয় যতটা পেছনে গেছে তার জন্য আমরা সামগ্রিকভাবে দায়ী। ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশে একটা পরিবর্তন আনা দরকার ছিল। কিন্তু এই যুক্তিটা অনেকে বুঝলেও এতে সাহস করে হাত দিতে চায় না কেউ। আমার ভয় হয়, আস্তে আস্তে এ বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্য দশ সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্তরে না নেমে যায়! অথচ আমরা ছাত্র থাকাকালে এত শিক্ষিত শিক্ষক না থাকলেও লেখাপড়াটা হতো। এখন শিক্ষিত শিক্ষক আছে অনেক, তবে মানসম্মত লেখাপড়াটা যেন পেছনে চলে যাচ্ছে। এমনও হতে পারে যে আজকে বিকল্প অনেক আছে বলে অনেকে এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। শেষ কথা হলো, আমরা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণটা বোধ করি একটু দ্রুতই চালু করে দিয়েছি। তবে এ ক্ষেত্রে যে তদারকিটার দরকার ছিল, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায়, সেটা যেন নেই।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন