বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য কিছুই নেই
19 June 2014, Thursday
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এত দিন ধরে শেয়ারবাজারের জন্য যেসব প্রণোদনা ছিল, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় সেসব সুযোগ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে কম্পানির আয়ের ওপর এত দিন তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে যে কর সুবিধা ছিল, তাও সংকুচিত করা হয়েছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলা উচিত। শেয়ারবাজার যখন থেকে অর্থনীতিতে একটা ভূমিকা রাখা শুরু করল, যখন থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শেয়ারবাজারকে পলিসি সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা শুরু করল, তখন থেকেই শেয়ারবাজারে যেসব কম্পানি তাদের ইক্যুইটি ক্যাপিটাল বিক্রি করে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হবে ওই সব কম্পানিকে তাদের ব্যবসায়িক লাভের ওপর ১০ শতাংশ কম ট্যাক্স দিলে চলত এবং ১০ শতাংশ কম করপোরেট ট্যাক্সের সুবিধাটি আমার স্মরণ মতে দুই যুগ আগ থেকেই চলে আসছিল। মূলত দুই কারণে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোকে কম ট্যাক্সের ওই সুবিধাটি দেওয়া হচ্ছিল।
এক. কম করপোরেট ট্যাক্স আরোপের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানাধীন কম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আসতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছিল। শেয়ারবাজারে এলে কম্পানিকে জবাবদিহির মধ্যে আসতে হয়। কম ট্যাক্সের সুবিধা দিয়ে কম্পানিগুলোকে এসব ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়া হয়। একটা কথা উল্লেখ করতে চাই, ভালো কম্পানির ভালো শেয়ার শেয়ারবাজারে না এলে শুধু মরিচা ধরা কম্পানির শেয়ার দিয়ে শেয়ারবাজারের প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে না। ১০ শতাংশ কম করপোরেট ট্যাক্সের মাধ্যমে অর্থনীতির ভালো কম্পানিগুলোকে এই বাজারে আসতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। এর পরও বলব, বহুজাতিকসহ অনেক দেশীয় ভালো কম্পানি ট্যাক্সের এই প্রণোদনাকে যথেষ্ট মনে করেনি এবং ওই সব কম্পানি অনেক ভালো ব্যবসা করলেও শেয়ারবাজারে আসেনি।
দ্বিতীয়ত, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়া মানে জনগণের কাছে উৎকৃষ্ট ক্যাপিটাল বা মালিকানার একটা অংশ বিক্রি করা। যেসব কম্পানি মালিকানা দিয়ে তাদের ব্যবসায়িক লাভের অংশকে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ভাগ করে নেয়, সেসব কম্পানি তো অবশ্যই প্রণোদনা পাওয়ার দাবি রাখে। এক অর্থে বাংলাদেশের সরকারগুলো জনস্বার্থে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোকে ১০ শতাংশ কম ট্যাক্সের এই সুবিধাটি দিয়ে আসছিল। সেই হিসেবে আমাদের অর্থনীতিতে করপোরেট কর হয়েছিল তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর জন্য সর্বনিম্ন ২৭.৫০ শতাংশ এবং একই জাতের অ-তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর জন্য এই হার ছিল ৩৭.৫০ শতাংশ। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবনায় অ-তালিকাভুক্ত ব্যবসায়িক মালিকানার কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে ২.৫০ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করারোপের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে তালিকাভুক্ত এবং অ-তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে যে ১০ শতাংশ কর পার্থক্য ছিল, সেটা আর থাকল না। কেন এই পার্থক্যটা কমানো হলো? এর পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তি কী? শেয়ারবাজার কি এরই মধ্যে এত বড় ও শক্ত হয়ে গেছে যে এখানে তালিকাভুক্তির জন্য কোনো প্রণোদনার দরকার নেই? এরই মধ্যে কি সব বহুজাতিক কম্পানির শেয়ার বাজারে এসে গেছে? যেখানে ১০ শতাংশ কম ট্যাক্স সুবিধা নিয়েও বাংলালিংক, ইউনিলিভারের মতো কম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসেনি, সে ক্ষেত্রে বাজেটে দেয় প্রস্তাব গৃহীত হলে ৭.৫০ শতাংশ কর সুবিধার জন্য ওই সব কম্পানি কেন শেয়ারবাজারে আসবে? উচিত ছিল তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও কমপক্ষে ২.৫০ শতাংশ করপোরেট কর কমিয়ে দেওয়া। এ তো গেল বর্তমান বাজেট প্রস্তাবনার করপোরেট করের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ। অন্যদিকে বাংলাদেশে শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ক্যাপিটাল গেইনস বা মূলধনী লাভের ওপর করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই উৎস থেকে যে খুব বেশি ট্যাক্স পাওয়া যাবে তা নয়। কিন্তু ক্ষতিটা হবে অনেক। অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য এই ট্যাক্স ভয়ের উপাদান হিসেবে কাজ করবে। তারা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগটাকে অন্য খাতে স্থানান্তর করবে। তাদের অর্থ চলে যাবে সরকারের সঞ্চয়পত্র কেনায় অথবা জমি কেনায়। এ অবস্থায় এই ট্যাক্স আরোপের ফলে অর্থনীতি আদৌ কি ভালো হবে? বড় বিনিয়োগকারীরা চলে গেলে শেয়ারবাজার আরেক ধাপ মন্দাক্রান্ত হবে। মূলধনী লাভের ওপর করারোপের সময় এখনো আসেনি আমাদের শেয়ারবাজারে। ব্যক্তি পর্যায়ে এই কর বসানো থেকে শেয়ারবাজারকে আরো কয়েকটি বছর অব্যাহতি দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। অন্যদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই বলে যে ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লোকসান একটু পুষিয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এক লাখ টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড আয়কে (Dividend Income) আয়করমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড আয় অনেক দিনই করমুক্ত ছিল। আজকে বলা হচ্ছে, ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এই আয়কে বর্তমান বাজেট প্রস্তাবনার মাধ্যমে করমুক্ত ঘোষণা করে শেয়ারবাজারের জন্য অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এরই নাম সুবিধা! এটা সুবিধা হলে আগের এক লাখ টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড আয় যে ট্যাক্স ফ্রি ছিল, সেটাকে কী বলা যাবে।
অন্য বিষয়টি হলো, আগে থেকে যেসব কম্পানি ২০ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্ড বা মুনাফা বণ্টনের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করবে, সেসব কম্পানির আয়ের ওপর একটা গড়ে ট্যাক্স রিবেট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই রিবেট দেওয়ার কারণে কম্পানিগুলো বেশি মুনাফা দেখিয়ে বেশি ডিভিডেন্ড দিতে উৎসাহ বোধ করত। এমনও শুনছি, বাজেট প্রস্তাবনার সেই সুবিধাটিও তুলে নেওয়া হয়েছে। এর ফল হবে, যেসব কম্পানি মোটেই ডিভিডেন্ড দেয় না, দিলেও যৎসামান্য দেয়, সেসব কম্পানি এবং যেসব কম্পানি ৩০০ থেকে ৫০০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেয়, ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই সব কম্পানির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকল না। মনে রাখতে হবে, কম্পানিগুলো কম মুনাফা দেখিয়ে কম ডিভিডেন্ড দিলে রাজস্ব বোর্ডও কম ট্যাক্স পাবে।
আমাদের আবেদন হলো, শেয়ারবাজারের জন্য বাড়তি প্রণোদনা না-ই বা দিলেন, অন্তত যেসব প্রণোদনা আগে থেকে এই বাজারের জন্য ছিল, সেগুলো অব্যাহত রাখুন। এতে অর্থনীতিরও ভালো হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(কালের কন্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন