বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকভাবে পুঁজির পলায়ন ঘটছে
28 May 2014, Wednesday
আমজাদ ও জহির বাংলাদেশে প্রায়ই আসে। আসার কারণ হলো পেছনে ফেলে যাওয়া ব্যবসাকে দেখা। তাদের সঙ্গে আমার দেখা হলো মতিঝিলে। স্টক ব্রোকারিংয়ের ব্যবসা ছিল বলে তাদের চিনতাম। তারা স্থায়ীভাবে কানাডা চলে গেছে তিন বছর আগে। কিন্তু স্টক ব্রোকিংয়ের ব্যবসাটা তাদের এখনো আছে। শেয়ারবাজার মন্দা যাচ্ছে বলে তাদের সেই ব্যবসা থেকে এখন তেমন আয় নেই। তবে তারা ২০০৯ ও ২০১০ সালে অনেক বড় ব্যবসা করেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। সেই অর্থের কিছু অংশ তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ালেখা করতে ব্যয় করেছে। ছেলেমেয়েরা বিদেশে লেখাপড়া করে আর দেশে ফেরেনি। তারাই তাদের সন্তানদের দেশে ফিরতে বারণ করেছে। অন্য ১০ জন ধনী লোকের মতো আমজাদ ও জহিরও এই দেশকে তাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ বোধ করছে না। স্টক ব্রোকিং থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে তারা অন্য ব্যবসাও স্থাপন করেছে। তবে ব্যবসার লাভগুলোকে তারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ছেলেমেয়েরা না হয় লেখাপড়া করতে বিদেশে গেল, আপনারা কেন বিদেশে থাকেন। তারা বলল, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাদের মায়েরাও (Mothers) বিদেশে গেল। শেষ পর্যন্ত তাদেরও যেতে হলো। তারা এখন কানাডার নাগরিক। টরন্টো শহরে বাড়িও কিনেছে। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, যখন কানাডায়ই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, তাহলে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসাগুলোকে কি গুটিয়ে নিলে হতো না? তাদের উত্তর হলো, না, তারা আপাতত ওই লাইনে চিন্তা করছে না। কারণ কানাডায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া অনেক কঠিন। আর সেখানকার ব্যবসায় বাংলাদেশের মতো অত লাভ নেই। তাই আপাতত ব্যবসাগুলো থাকবে বাংলাদেশেই, তারা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকবে। এভাবে হাজার হাজার আমজাদ ও জহির দেশের বাইরে যাচ্ছে তাদের অর্থকড়ি নিয়ে। অন্যরা যাচ্ছে ইমিগ্রেশন নিয়ে। ইমিগ্র্যান্টস হয়ে যারা যাচ্ছে তারাও তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থকড়ি নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। যেতে পারছে না যাদের টাকা-পয়সা নেই, শুধু তারা। অনেক বাংলাদেশি আবার ছেলেমেয়েদের কাছে বেড়াতে গিয়ে দেশে ফেরার নাম নেই।
বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকভাবে পুঁজির পলায়ন ঘটছে
তারাও তাদের ভরণ-পোষণের অর্থ বাংলাদেশ থেকেই নিচ্ছে। এখন তো আমরা সবাই জানি, যাদের যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, তারা বিদেশে গিয়ে থাকাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তাদের এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা একটি কমন উত্তর দেবে, সেটা হলো দেশে তারা নিরাপদ অনুভব করছে না। কিন্তু তাদের এই দেশে আয়ের ভালো উৎস রয়েছে। তাদের ব্যবসা ও অন্যান্য সম্পদ থেকে যে আয় হয়, তা এ দেশেই তাদের একটি উচ্চ জীবনযাত্রা প্রদানের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তারা এই দেশে থাকতে নারাজ। বিদেশে তারা যে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে, সেই অর্থ যে তারা বিনিয়োগের জন্য নিচ্ছে তা নয়। তারা জানে, বিদেশে বিনিয়োগের সামর্থ্য তাদের নেই। এমনকি অতি সহজ বিনিয়োগ থেকে যে অর্থ বিদেশে পাওয়া যাবে, তা অতি নগণ্য। বিনিয়োগ ও উচ্চ আয়ের জন্য বাংলাদেশই অতি উত্তম জায়গা। শুধু ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা পুরো পরিবার নিয়ে তাদের পছন্দের দেশে বসতি স্থাপন করেছে। তারা যে অর্থ বাংলাদেশ থেকে নিচ্ছে, সেই অর্থ বর্তমান ভোগের জন্য এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভোগের জন্য। তারা খোলাখুলিভাবেই বলেছে, অন্তত ওই সব দেশে জীবন নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আমজাদ ও জহিরের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিদেশে অর্থ নেওয়া ও বিদেশে গিয়ে ইমিগ্রেশন নেওয়ার যুক্তি আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু ভাবছিলাম, এরাই না গেল বিদেশে, এদের অর্থ আছে বলে। কিন্তু এ দেশে অন্য সব মানুষের কী হবে। তারাই তো ৯৯ শতাংশ। তাদের তো এ দেশেই থাকতে হবে, এ দেশেই তাদের সন্তানদের জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ দেশেই বিনিয়োগ ও ব্যবসা করতে হবে। ঘুরেফিরে একটা কথাই মনে আসছিল- এই দেশকে নিরাপত্তার দিক দিয়ে কেউ ঠিক করে দেবে না। ঠিক করতে হবে ওই ৯৯ শতাংশকেই। আর তারা যদি তাদের স্বদেশভূমিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করতে পারে, তাহলে তারা চক্রাকারে গুম-খুনের শিকার হবে। দেশটা হবে শুধুই মৃত্যুর, যে মৃত্যুর জন্য আবার তারা পরস্পরকে দোষারোপ করবে।
গত দুই দশকে এই দেশে কিছু লোক অতি তাড়াতাড়ি ধনী হয়েছে। তারা ধনী হয়েছে একচেটিয়া ব্যবসা করে (Monopoly Business)। যে ব্যবসায় লাভ ছিল আকাশচুম্বী। তাদের বিনিয়োগ উঠে এসেছে মাত্র এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে। এমন লাভজনক ব্যবসা বিশ্বের অন্যত্র নেই বললেই চলে। মনোপলি ব্যবসা এসেছে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের আশীর্বাদে। অন্যত্র এসেছে সস্তা শ্রমিককে ব্যবহারের মাধ্যমে। কিছু লোক আমাদের সীমিত জমিকে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে অনেক অর্থের মালিক হয়েছে। বলা চলে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির প্রায় পুরোটাই ওই ১ শতাংশ লোকের হাতে গিয়ে পড়েছে। ছোট্ট একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এরাই এখন নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এদের ভাবনা হলো- অর্থ হলো, বাড়ি হলো, গাড়ি হলো, কিন্তু নিরাপত্তা কই। হ্যাঁ ওদের সেই উৎকণ্ঠার জবাব দেওয়া যে যাবে না, তা তো সব লোকই অনুভব করছে। তারা যদি দেশের অর্থনীতিতে তাদের মনোপলি ব্যবসা থেকে প্রাপ্য মুনাফা আবার বিনিয়োগ করত, তাহলে এই দেশের অর্থনীতি অবশ্যই ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করত। কিন্তু আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের ধনী লোকরা শুধু নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিজ দেশ থেকে অর্থকড়ি বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। আজকে বাংলাদেশে সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সেই বাড়তি সঞ্চয়? সেই সঞ্চয় আমজাদ ও জহিরদের মাধ্যমে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, দুবাই চলে যাচ্ছে। অথচ আমরা অহরহ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। যেখানে আমাদের ধনী লোকরাই দেশ থেকে অর্থ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে- সেখানে বিদেশিরা আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বিনিয়োগ করে আমাদের অর্থনীতিটাকে চাঙ্গা করে দেবে, এমন আশা করা ঠিক হবে না। দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হচ্ছে না, এ কথাটা অনেকের মুখ থেকেই তিন-চার বছর ধরে শুনে আসছি। কিন্তু কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না, এ ক্ষেত্রে তাঁরা শুদ্ধভাবে কিছু বলতে চান না। আমাদের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হচ্ছে না আমাদের ভৌত অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণে। তবে বর্তমানে বিনিয়োগ-খরার ক্ষেত্রে এটা একটা ছোট্ট কারণ মাত্র। আসল কারণ হলো এই দেশের বিভাজনের রাজনীতি থেকে যে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তাকে সামাল দেওয়ার মতো কোনো শক্তিই যেন আজকে আর যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে সামাজিক অস্থিরতা বর্তমানের পর্যায়ে থাকত না এবং তখন নিরাপত্তার বিষয়টাও এত প্রকট হয়ে দেখা দিত না।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(যুগান্তর)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন