শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ
31 March 2014, Monday
আমাদের শেয়ারবাজারটা আবার ঝিমিয়ে পড়ছে। অনেকে এই ঝিমিয়ে পড়ার জন্য ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রিকে কারণ হিসেবে দেখছে। এই দেখার মধ্যে কিছুটা সত্যতা তো আছেই। কারণ হলো, বাংলাদেশ বারবার নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে তাদের পেইডআপ ক্যাপিটালের ২৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত করে রাখতে হুকুম দিচ্ছে। নতুন ব্যাংক আইনে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই ২৫ শতাংশের মধ্যে ব্যাংকগুলোর সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগও অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ব্যাংক ও তার মালিকানায় স্থাপিত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ পোর্টফলিও সর্বোচ্চ টায়ার-১ মূলধনের ২৫ শতাংশ হতে পারে। এর বেশি ব্যাংক ও মার্চেন্ট ব্যাংক বিনিয়োগ করলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ওই পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। অন্য ব্যাপারটি হলো তাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ওপর লোকসান গেলে যে অঙ্কটা লোকসান গেছে, সে অঙ্কের প্রভিশনিং বা সংগতি রেখে নিট আয়কে হিসাব করতে হবে। তাই ব্যাংক এবং তার মালিকানায় স্থাপিত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো দুই ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যে পড়েছে। এক. তাদের বিনিয়োগকে আইনে নির্দেশিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। দুই. শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে লোকসান দিলে সে লোকসানের বিপরীতে ব্যাংকের আয় হিসাবে প্রভিশনিং করতে হবে।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ
ফল হয়েছে এই যে যেহেতু অধিকাংশ ব্যাংক তাদের এই বিনিয়োগের ওপর লোকসান দিয়েছে, সে জন্য তাদের বড় অঙ্কের টাকা আয় হিসাব থেকে বাদ দিয়ে ব্যাংকের আয়কে হিসাব করতে হচ্ছে। এর অন্য অর্থ হলো এই বছরের জন্য এবং প্রভিশনিং ঘাটতি থাকলে সামনের কয়েক বছরের জন্যও ব্যাংকগুলোর শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস কমে যাবে। ইপিএস কমে যাওয়া মানে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ কমে যাওয়া এবং ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য পতন। বাস্তবেও তাই। এখন মনে হবে, ব্যাংকের শেয়ার অনেক সস্তা হয়ে গেছে। অবশ্য ব্যাংকগুলোর ইপিএস কমে যাওয়ার অন্য বড় কারণ হলো আমাদের অর্থনীতির অধোগতি। ব্যাংকগুলোর আয় আসে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ থেকে। গত আর্থিক বছরে অর্থনীতিতে নিট বিনিয়োগ তেমন হয়নি বললেই চলে। তদুপরি ব্যাংক ব্যবসা এখন অনেক প্রতিযোগিতামূলক। অনেক ব্যাংক উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে এখন অলস অর্থের ওপর বসে আছে। গত কয়েক দিনে আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণী প্রকাশিত হয়েছে। আমি কয়েকটি ব্যাংকের ওই আর্থিক বিবরণী পড়ার চেষ্টা করলাম। পড়ে যেটা দেখেছি, সেটা হলো যেসব ব্যাংক শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছিল, সেসব ব্যাংক এ খাতে বড় অঙ্কের লোকসান দিয়েছে। এবং যেহেতু রেগুলেশন তাদের বিনিয়োগকে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছে, সে জন্য তাদের লোকসান অবস্থায় শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে। অন্য কথা হলো, এ খাতে লোকসানি ব্যাংকগুলো শেয়ার বেচার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয় আরো দুই বছর সময় পেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওই সময়ের মধ্যেও যদি শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বগতি না ঘটে, তাহলে তাদের লোকসান দিয়েই শেয়ার বিক্রয় করে দিতে হবে। তবে এটাও ঠিক, এই লোকসানের জন্য ব্যাংকগুলো নিজেরাই দায়ী। ২০০৯ ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজার যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল তখন এদের খুশি কে দেখে। কিন্তু শেয়ারবাজার যখন নভেম্বর ২০১০ থেকে ধসে যেতে লাগল, তখন এদের স্থিতিপত্রও লাল হয়ে যেতে লাগল। ২০১০ সালের আগে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ওপর কোনো রকমের বিধিনিষেধ ছিল না। যত বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু হলো শেয়ারবাজারে ধস নামার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেতনার উদয় হলো, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে গিয়ে তো প্রকৃত অর্থে আমানতকারীদের অর্থকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। অবস্থা হলো একদিন ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে অতি বিনিয়োগের ফলে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচকে যেমন উল্লম্ফন ঘটেছিল, আর আজকে শেয়ারবাজার থেকে তাদের বের হয়ে যাওয়ার কারণে মূল্যসূচকে ধস নামা শুরু হয়েছে। শেয়ারবাজারে নিত্যনতুন শেয়ার বা আইপিও আসছে। জানি না এত শেয়ার কেনার জন্য এত অর্থ ভবিষ্যতে কারা জোগান দেবে। একটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অতি অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। প্রকাশিত পোর্টফলিওতে যা দেখা গেল, তা হলো তাদের বিনিয়োগগুলো জাংক বা মরিচাপড়া শেয়ারে ভর্তি। অতি দুর্বল কম্পানির দুর্বল শেয়ার দ্বারা তাঁরা তাঁদের যে বিনিয়োগ পোর্টফলিও সাজিয়েছেন, সেই সব বিনিয়োগ তাদের বড় রকমের লোকসানে ফেলে দিয়েছে। যেসব কর্মকর্তা এত উচ্চ মূল্যে ওই সব মরিচাধরা শেয়ার কিনে ব্যাংকের পোর্টফলিও ভর্তি করেছে, তাদের তো চাকরি যাওয়ার কথা। কারণ হিসেবে আমি বলব, তাদের কোনো লেখাপড়া ছিল না। তারা স্রেফ আন্দাজের ভিত্তিতে শেয়ার কিনে ব্যাংকগুলোকে লোকসানে ফেলে দিয়েছে। যে শেয়ার যে মূল্যে ব্যাংকের কর্মকর্তারা কিনেছেন, সেই সব শেয়ারের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে ওই ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান ছিল বলে আমি মনে করি না।
শেয়ারবাজার মন্দায় আছে। মন্দায় থাকার মূল কারণ হলো বিনিয়োগ ও অর্থনীতি। বিনিয়োগকারীরা অতি উৎসাহে আজও যেসব কিনে চলেছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ মূল্য সম্পর্কে তাদেরও ভালো ধারণা আছে বলে আমি মনে করি না। উচ্চ প্রিমিয়ামে যেসব আইপিওকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে এবং সেকেন্ডারি বাজারে ওই সব আইপিও যে মূল্যে বেচাকেনা হচ্ছে, ভবিষ্যতে ওই মূল্য টিকবে বলে আমি মনে করি না। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক হতে অনুরোধ করব। বিশেষ করে নিম্ন প্রযুক্তির কম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে তাদের সতর্ক হতে অনুরোধ করব। অনেকে আইপিও বেচে বাজার থেকে অর্থ নিচ্ছে শুধু সহজে অর্থ নিতে পারে বলে। তাদের কাছে ভালো ব্যবসা আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(কালের কন্ঠ, ৩১/০৩/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন