মাইকেল উলফের বই ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি খোলামেলাভাবে জানিয়েছে আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট তার বাসস্থান ও কাজের জায়গা হোয়াইট হাউসে কিভাবে তার ‘একজিকিউটিভ জীবন’ বা কর্মজীবন কাটান। লন্ডনের প্রভাবশালী ও সিরিয়াস পত্রিকা দি গার্ডিয়ান এ বিষয়টি পাঠকদের সামনে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য নিয়োগ করেছিল তাদের অকুতোভয় রিপোর্টার এডাম গ্যাবাট-কে (Adam Gabbat)। ট্রাম্পের স্থানে যদি গ্যাবাট থাকতেন তাহলে তিনি কিভাবে তার কর্মজীবনটা কাটাতেন?
‘গলফ, থৃ টিভিস অ্যান্ড বিগ ম্যাক’ (গলফ খেলা, তিনটি টিভি দেখা এবং বিছানায় একাধিক বিগ ম্যাক হ্যামবার্গার খাওয়া) নামে এডাম গ্যাবাটের সত্যাশ্রয়ী কিন্তু বিদ্রুপাত্মক দীর্ঘ লেখাটি প্রকাশিত হয় গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৬ জানুয়ারি ২০১৮-তে। নিচে রচনাটির ভাষান্তর দেয়া হলো। বাংলাদেশের পাঠকরা আর্মি অফিসার, বিত্তশালী ব্যবসায়ী ও রিটায়ার্ড আমলাদের কল্যাণে গলফ খেলার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হয়েছে। ফুটবলের মতো ৯০ মিনিটের খেলা নয় গলফ- এটি দীর্ঘক্ষণব্যাপী। আর টিভির সঙ্গে বাংলাদেশিদের পরিচয় হয়ে গিয়েছে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ থেকে। কিন্তু তৃতীয় যে বিষয়টি ট্রাম্পের জীবন জুড়ে আছে, ‘বিগ ম্যাক’ (Big Mac), সেটির সঙ্গে এই একবিংশ শতাব্দিতেও বাংলাদেশিদের পরিচয় ঘটেনি। ম্যাক শব্দটি ম্যাকডোনাল্ডসের (McDonald's) সংক্ষিপ্তকরণ। ম্যাকডোনাল্ডস হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ও প্রিয় হ্যামবার্গার। হ্যামবার্গার হচ্ছে এক ধরনের রুটির বান (ইংরেজি Bun শব্দের উচ্চারণ বন নয়- বান) যেটা দুভাগ করে কেটে মধ্যে দেয়া হয় গরুর মাংসের এক ধরনের কাবাব বা বার্গার (Burger) এবং তার উপরে দেয়া হয় কিছু লেটিস পাতা (উচ্চারণ লেটুস নয়, যদিও ইংরেজি বানান Lettuce), কাটা পেয়াজের ফালি এবং নোনতা-মিষ্টি স্বাদের শসার টুকরা, টমাটোর টুকরা ও বিভিন্ন সস। এটিই হচ্ছে বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া ম্যাকডোনাল্ডসের হ্যামবার্গার। এর উদ্ভাবক আমেরিকান কম্পানি ম্যাকডোনাল্ডের প্রতিষ্ঠাতাবৃন্দ। তারা চেয়েছিলেন শস্তায় গরম খাবার কাস্টমারদের অতি দ্রুত পরিবেশন করতে।
সেই থেকে ফাস্ট ফুড (Fast Food), (ফার্স্ট ফুড First Food বা প্রথম ফুড নয়) শব্দ দুটিও বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের জীবনে চলে এসেছে। চায়না ও ইনডিয়াতে ম্যাকডোনাল্ডস হ্যামবার্গার এলেও বাংলাদেশে কেন এখনো আসেনি সে বিষয়টি পরবর্তী আরেক সময়ে লেখা যাবে। ইনডিয়াতে গরুর নয়, খাসি বা ভেড়ার মাংসের হ্যামবার্গার হয়। ইতিমধ্যে পাঠকরা জেনে রাখতে পারেন বিগ ম্যাক হচ্ছে সাধারণ ম্যাকডোনাল্ডস হ্যামবার্গারের চাইতে প্রায় ডাবল সাইজের, যার বান রুটি বড় এবং রুটির উপরে কিছু তিল-এর বীচি থাকে, ফলে এই বানের স্বাদ হয় ভিন্ন। বানের মধ্যে থাকে দুটি বার্গার বা কাবাব, পনিরের স্লাইস এবং লেটিস, পেয়াজ, শসা, টমাটো ও সস বেশি পরিমাণে- অর্থাৎ বিগ ম্যাক বড় সাইজের ম্যাকডোনাল্ডস হ্যামবার্গার। এক পোর্শন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা চিপসসহ একটি বিগ ম্যাক খেলে একজনের এক বেলা খাবার হয়ে যায়।
আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে যেখানে ম্যাকডোনাল্ডস হ্যামবার্গার বিক্রি হয় সেখানে সাম্প্রতিককালে ওবিস (Obese) বা অস্বাভাবিক ওজনের মোটা মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাই স্বাস্থ্যসচেতন বিজ্ঞানী ও ডাক্তাররা এখন ম্যাকডোনাল্ডস তথা যেকোনো হ্যামবার্গার কম্পানির বিরুদ্ধে অব্যাহত আন্দোলন চালাচ্ছে। যার ফলে কিছু স্থানে ম্যাকডোনাল্ডস ও অন্যান্য হ্যামবার্গার কম্পানির দোকান খোলার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এসব দেশে ম্যাকডোনাল্ডসকে নিচু চোখে দেখা হচ্ছে।
ম্যাকডোনাল্ডসের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ‘বার্গার কিং’ যদিও অনেক পেছনে, তারা এখন ঢাকায় একাধিক ব্রাঞ্চ খুলেছে। ম্যাকডোনান্ডসের চেয়ে বার্গার কিংয়ের হ্যামবার্গারের স্বাদ ভিন্ন। তফাৎটা এই যে, বার্গার কিংয়ের হ্যামবার্গার আমাদের দেশের কাবাবের মতোই আগুনে ঝলসে দেয়া হয়। এর ফলে বার্গার কিংয়ের হ্যামবার্গারের দাম কিছুটা বেশি হয়। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডসের মতোই বার্গার কিংকেও অস্বাস্থ্যকর মনে করা হয়।
ফলটা এবার বুঝলাম ৬ ডিসেম্বরে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টের টার্মিনাল থৃ বিলডিংয়ের ডিপারচার লাউঞ্জে। আমি ও আমার স্ত্রী তালেয়া রেহমান এমিরেটস এয়ারলাইনসের ঢাকাগামী ফ্লাইটের যাত্রী ছিলাম। আমরা সকাল ১০টার দিকে একটু আগেই পৌছে গিয়েছিলাম এবং প্ল্যান করেছিলাম চেকইনের পরে ওই বিলডিংয়ে সদা ব্যস্ত বার্গার কিংয়ে হোপার (Whopper) বার্গার ও চিপস খেয়ে নেব। প্লেনে লাঞ্চ দেরিতে সার্ভ করবে সেটা জানা ছিল। বার্গার কিংয়ে লন্ডনস্থ দুজন পারিবারিক বন্ধু ড. মামুন রহমান ও শামসুল আলম লিটন সি-অফ করার জন্য আসবেন বলেছিলেন। তারা ঠিকই এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে বার্গার কিং দোকানটি আর ছিল না। বুঝলাম বর্তমানে হেলথ ফুড ক্রেইজি বৃটেনে হিথরো এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থৃতে বার্গার কিং বিক্রির অনুমতি হয়তো কর্তৃপক্ষ দেয়নি।
ম্যাকডোনাল্ডস ও বার্গার কিং সম্পর্কে এত কথা লিখলাম পাঠকদের বোঝানোর জন্য যে, পশ্চিমে এখন কম্পানির তৈরি ফাস্টফুড হ্যামবার্গার খাওয়াকে আনস্মার্ট ও আনহেলথি বর্জ্য খাবাররূপে গণ্য করা হচ্ছে। লেখক এডাম গ্যাবাট তার রচনার শিরোনামে বিগ ম্যাক শব্দ দুটি রেখেছেন। ট্রাম্প যে অজ্ঞ ও তার রুচি অতি সাধারণ সেটা বোঝানোর জন্য।
লেখাটির পূর্ণ শিরোনাম হচ্ছে : গলফ, থৃ টিভিস অ্যান্ড বিগ ম্যাকস ইন বেড : মাই উইক ইন দি লাইফ অফ ডোনাল্ড ট্রাম্প (Golf, three tvs, and Big Macs in bed : my week in the life of Donald Trump)। বাংলায়, ‘গলফ, তিনটি টিভি ও বিছানায় বিগ ম্যাক : ডোনাল্ড ট্রাম্পের জীবনীমূলক আমার এক সপ্তাহ।’ এবার পড়–ন গ্যাবাট কি লিখেছেন।
সাধারণত ডোনাল্ড ট্রাম্প বিছানায় শুতে যান সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার মধ্যে। সেখানে তিনি চিজবার্গার, অর্থাৎ পনিরসহ বার্গার, খেতে খেতে তিনটি টেলিভিশনেই প্রোগ্রাম দেখেন। তার স্ত্রী মেলানিয়ার বেডরুম ভিন্ন। ট্রাম্প পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে শুচিবাইয়ে ভোগেন। ম্যাকডোনাল্ডস অথবা সেই ধরনের ফাস্ট ফুড বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে প্রেসিডেন্ট পছন্দ করেন। কারণ তিনি ভয় করেন বিষ প্রয়োগে তাকে খুন করা হতে পারে। তিনি সারাটা সন্ধ্যা বন্ধুদের ফোন করেন। তারপর দেরিতে ঘুমান।
মাইকেল উলফ (Michael Wolff)-এর লেখা ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি (Fire and Fury) বাংলা মানে আগুন ও প্রচণ্ড রাগ বইটির কল্যাণে এখন আমরা এসব এবং আরো অনেক তথ্য জানি। বইটির সবচেয়ে বেশি কৌতূহল জাগানো বিষয়গুলি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে তথ্যসমূহ- আসলেই কিভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তার সময় কাটান এবং কার সঙ্গে কাটান। ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি জানিয়েছে প্রেসিডেন্টের জীবন নিঃসঙ্গ এবং উদ্ভট। কিন্তু এভাবে জীবন কাটানোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো আকর্ষণ ও মজা আছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই ট্রাম্পের মতো আমি জীবন কাটাব। অল্প কিছু দিনের জন্য।
প্রথম দিন
৭১ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ যিনি তার দিনের একটি বড় অংশ বিছানায় অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে কাটান তার জীবন অনুকরণ করা একটি দুঃসাহসিক কাজ। রবিবারে আমার এপার্টমেন্ট ট্রাম্প-রেডি করলাম। ফায়ার অ্যান্ড ফিউরির মতে ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউসে আসেন তখন তিনি দুটি অতিরিক্ত টেলিভিশন সেট তার বেড রুমে ফিট করতে বলেন। কারণ তিনি যেন একই সাথে তিনটি টিভি চ্যানেল দেখতে পান। আমিও তিনটি টিভি পর্দায় চোখ রাখি। একটি চ্যানেল- ফক্স নিউজ যেটা ট্রাম্পের ফেভারিট (উচ্চারণ ফেবারিট নয়)। প্রেসিডেন্ট বলেছেন সিএনএন ও এমএসএনবিসি- এই দুটি চ্যানেল তিনি ঘৃণা করেন। কিন্তু এই দুটি চ্যানেল সম্পর্কে তিনি এত কিছু জানেন যে মনে হয় তিনি এই দুটিও দেখেন। তাই আমি আমার টিভি সেটের পাশে ডেস্কটপ কমপিউটার স্কৃন আর ল্যাপটপের পর্দায় ওই দুই চ্যানেল দেখি।
সন্ধ্যা ৬.৩০-এ আমি বিছানায় গেলাম। উলফ লিখেছেন, সাধারণত এই সময়ের মধ্যেই ট্রাম্প বেডে যান, সঙ্গে থাকে একটি চিজবার্গার। তিনটি স্কৃন দেখতে দেখতে বন্ধুদের ফোন করতে থাকেন। এক ঘণ্টা বিছানায় থাকার পর, দক্ষিণপন্থী নিউজ চ্যানেল দেখে বিরক্ত হলাম। আমার একঘেয়ে লাগে। আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে ফোন করি। এই নারীর নাম রুথ। কিন্তু সে উত্তর দিল না। আমি আবার করলাম। এবারো সে উত্তর দিল না। তাকে একটা এসএমএস করে জানিয়ে দিলাম ‘তোমার নিরুত্তরে আমি অভ্যস্ত হবার চেষ্ট করছি।’ এক ঘণ্টা পরে রুথ এসএমএসে উত্তর দিল, ‘তুমি কি চাও? কুত্তা কোথাকার!’ তাকে আর ফোন করলাম না।
আমার পুরুষ বন্ধু জোনো বরং প্রীতিময় ছিল। সে আমার দ্বিতীয় কলে উত্তর দিল। এটা ভালো হলো কারণ আমি কোন স্টাইলে ট্রাম্প কাদের সাথে অনবরত কথা বলেন, সেটা অনুকরণ করতে চাচ্ছিলাম। এটা এখন সবারই জানা যে, ট্রাম্প নিজের বিষয়ে বাড়িয়ে গর্ব করতে ভালোবাসেন। তিনি একই কথা বারবার বলেন। ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি জানিয়েছে, বেডে শুয়ে বন্ধুদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপও একইভাবে করেন। তবে একটা সমস্যা হলো, আমার নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে গর্ব করার তেমন কিছু নেই।
ট্রাম্প হয়তো উত্তরাধিকার সূত্রে তার বাবার ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু এটা স্বীকার্য যে, তিনি খুব বিত্তবান। একটি টিভি প্রোগ্রামের সঞ্চালক ছিলেন তিনি। এবং তিনি প্রেসিডেন্ট। এর কোনোটাই আমি নই। কিন্তু তারপরেও এটা স্বীকার্য যে, আমি একটি কম্পানিকেও দেউলিয়া করিনি- ট্রাম্পের মতো চারটি কম্পানিকে দেউলিয়া করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি আমার কাজে কেমন করছি সে বিষয়ে জনমত জরিপ এখনো হয়নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, ট্রাম্পের মতো খারাপ ফলাফল সেই জরিপে হবে না।
‘তুমি জানো আমি কখনো দেউলিয়া ঘোষিত হইনি’। জোনোকে বললাম। সে প্রশ্ন করল আমি কি চাই। আমি বললাম, ‘জনমত জরিপ নিশ্চয়ই দেখাবে আমি ভালো কাজ করছি। জরিপের রেজাল্ট হবে পজিটিভ।’ জোনো একমত হলো না। আমরা আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম এক বন্ধু সম্পর্কে যে সম্প্রতি বিয়ে করেছে। তারপর আমি আবার আমার নিজের দৃঢ় আর্থিক অবস্থার কথা বললাম। তখন জোনো লাইন কেটে দেয়ার হুমকি দিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার ওপর আমেরিকার জনগণের আস্থা আছে কিনা। জোনো ফোন লাইন কেটে দিল।
দ্বিতীয় দিন
যেহেতু আমি এখনো বিয়ে করিনি সেহেতু ট্রাম্পের সঙ্গে তার স্ত্রী মেলানিয়ার সম্পর্কটি অনুকরণ করা সহজ। বাহ্যত তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তারা দুটি ভিন্ন বেডরুমে শয়ন করেন। উলফ মনে করেন, তাদের মধ্যে দীর্ঘ দিন দেখা না হলেও তারা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারেন। বলা হয়েছে, বাড়ির মধ্যে ট্রাম্প খুবই সাবধানী। হোয়াইট হাউসে যাওয়ার প্রথম দিকে তিনি তার বেডরুমে তালা লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিক্্েরট সার্ভিস সেটার অনুমতি দেয়নি। ট্রাম্পের জিনিসপত্র কারো স্পর্শ করা নিষেধ। বিশেষত তার টুথব্রাশ। যদি তিনি একটা শার্ট মেঝেতে ফেলে দেন, তাহলেও হোয়াইট হাউসের ক্লিনিং স্টাফ সেটা নিতে পারবে না।
ট্রাম্পের বিছানার চাদরও কেউ বদলাক সেটা তিনি চান না। যখন চাদরটা ময়লা হয়ে গেলে ওটা বদলাতেই হবে তখন ট্রাম্প নিজে সেটা সরিয়ে ওটা মেঝেতে ফেলে দেন। তার অনুকরণে আমিও আমার বিছানার চাদর মেঝেতে ফেলে দিলাম। তারপরেই মনে পড়ল আমার মাত্র একটা চাদরই আছে। তাই সেটা তুলে আবার বিছানায় পাতলাম।
দিনের শুরুটা ভালোই হলো। খবর পেলাম ট্রাম্প বেশি কাজ করেন না। সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তিনি তার ‘এক্সজিকিউটিভ টাইম’ কাটান। এটার মানে হলো তিনি হোয়াইট হাউসের রেসিডেন্সিয়াল অংশে থাকেন এবং টিভি দেখে, ফোন কল করে ও টুইট করে সময়টা পার করেন।
আমি আমার বসকে একটা মেসেজ পাঠালাম জি-চ্যাটে। তাকে বললাম, যেহেতু আমি ‘এক্সজিকিউটিভ টাইম’- এ সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকব, সেহেতু আমার দেরি হবে। বস জানতে চাইলেন একজিকিউটিভ টাইম-টা কি? আমি তাকে বললাম, আমি টিভি দেখব আর বন্ধুদের ফোন করব। আমার উত্তরটা তিনি ভালোভাবে নিলেন না।
বেলা ১১টায় একজিকিউটিভ টাইম শেষ হলো। আমি কিছুক্ষণের জন্য কাজে গেলাম। বেশি কোনো কাজ করলাম না। আমি যে প্রেসিডেন্ট তেমন অভিনয় করা সহজ।
বাড়ি ফেরার পথে আমি ম্যাকডোনাল্ডস রেস্টুরেন্টে গেলাম। ইতিমধ্যে জনগণ জেনে গিয়েছিল ট্রাম্পের ফেভারিট ম্যাকডোনাল্ডস। ফায়ার অ্যান্ড ফিউরির কল্যাণে আমরা জানি এর কারণটা হচ্ছেÑ দীর্ঘকাল যাবৎ ট্রাম্প ভয় করেন তাকে বিষ প্রয়োগে খুন করা হবে। আমি নিজে ম্যাকডোনাল্ডসে চাকরি করতাম। সুতরাং ম্যাকডোনাল্ডস রেস্টুরেন্টে খেতে আমার সমস্যা নেই। তবে আমার অবশ্যই সমস্যা হয় ম্যাকডোনাল্ডসের যেসব খাবার ট্রাম্প খান সেসব খেতে। তার সাবেক নির্বাচনী প্রচারণা ম্যানেজার কোরি লিওয়ানডোস্কির মতে, ট্রাম্পের নিয়মিত অর্ডার হচ্ছে : দুটি বিগ ম্যাক, দুটি ফিলে-ও-ফিশ (কাটাবিহীন মাছের বার্গার) এবং একটি চকলেট মিল্ক শেইক।
আমি সে সবই অর্ডার দিয়ে বাড়িতে এলাম। তারপর বিছানায় বসে খেতে শুরু করলাম। প্রথম বিগ ম্যাকটা ভালোই খেলাম। তারপর ফিলে-ও-ফিশে একটা কামড় দিলাম। আমি চাকরি করার সময়ে নিজে শত শত ফিলে-ও-ফিশ বানিয়েছিলাম। কিন্তু এমনটা কখনো খাইনি। এটা স্রেফ অখাদ্য। এর ফলে দ্বিতীয় বিগ ম্যাকটা খাবার রুচি আর থাকল না। বাকি সব খাবার আমি প্যাক করে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাকে দিলাম। এরপর মিল্ক শেইকটা খেলাম। কিন্তু মাঝরাতে এটা আমাকে জাগিয়ে দিল। আমার প্রচণ্ড বুকজ্বালা করছিল।
ডিনার শেষ হলো। আমি শুয়ে থাকলাম অলসভাবে। ফক্স নিউজ টিভিতে দেখলাম।
কিন্তু যাদের ফোনকল করব, তাদের সংখ্যা আমার কমে যাচ্ছে। কিছুকাল আগে এক নারীর সঙ্গে ডেট করেছিলাম এবং তাকে সম্প্রতি এসএমএস করছিলাম। তাকে বললাম, আমি বিছানায় আছি, ম্যাকডোনাল্ডস বার্গার খেয়েছি। সে বলল, সে ভেজিটারিয়ান। মাংসের কিছু খায় না। আমি যে আর্থিকভাবে দেউলিয়া নই সেই প্রসঙ্গটা তুললাম না।
তৃতীয় দিন
হোয়াইট হাউস পুল রিপোর্টার জানিয়েছেন, আজ বিকেল ৪.১৪ মিনিটে ট্রাম্প কাজ শেষ করেছেন। আমিও আমার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করলাম। বাড়ি ফিরলাম। সারা এপার্টমেন্টে গরুর মাংস (বিফ) আর টারটার (ঞধৎঃধৎ) সসের গন্ধ লেগে ছিল।
ফিরতে ফিরতে বিকেল ৫টা হয়েছিল। তখনই বেড আর বার্গারের জন্য আমি রেডি ছিলাম না। ভাগ্য ভালো যে, ট্রাম্পের প্রেসিডেনশিয়াল কাজ শুধু এসবের মধ্যেই সীমিত নয়। উলফ লিখেছেন, ট্রাম্পের চুল ঠিক রাখার একটা বিচিত্র রুটিন আছে। তিনি চুলে কলপ দেন। ট্রাম্প খুব অধৈর্য। ফলে তার চুলে অসাধারণ কমলা রঙ দেখা যায়। জাস্ট ফর মেন (শুধু পুরুষদের জন্য) যে কলপটি যতক্ষণ লাগিয়ে বসে থাকতে হয়, ট্রাম্প ততক্ষণ থাকতে পারেন না।
কিছু একটা করার আছে ভেবে খুশি হয়ে আমি পথে বেরোলাম। দুটি ভিন্ন রঙয়ের জাস্ট ফর মেন কলপ কিনলাম। একটা সোনালি, আরেকটা ব্রাউন। বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম সোনালিটা লাগাব না। আমি একটি নির্ভীক ও স্বাধীন পত্রিকার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করি। তা সত্ত্বেও আগামী দুই মাস পত্রিকার জন্য আমি কমলা রঙয়ের চুল নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারব না।
ব্রাউন কলপ সহজেই লাগাতে পারলাম। কিছুটা আমার মুখে লেগে গেল এবং তিন দিন পর্যন্ত সেই দাগ তুলতে পারিনি। তবে আমার চুল আগের চাইতে বেশি কালো রঙয়ের হয়েছিল। অবশ্য এটা মানতে হবে যে, যেহেতু আমি আমার রুমে একাই থাকি। সেহেতু আসলেই আমাকে দেখতে কেমন লাগছিল সেটা বলা কঠিন।
নতুন চুলে আমি ম্যাকডোনাল্ডসে গেলাম এবং সেখানেই খাব ঠিক করলাম। আমি সুযোগ পেলাম দোকানের মেনুতে দেখতে ট্রাম্প যে অর্ডার দেন তার ক্যালরির মোট পরিমাণ কত? এটা ছিল ২,৪৩০ ক্যালরি!
আমি এবারো ফিলে-ও-ফিশ খেতে পারলাম না। বাইরে একটি ছেলেকে ওটা দিলাম। বাড়িতে ফিরে বুঝলাম এই ট্রাম্প ডায়েট কাজ করতে শুরু করেছে। টয়লেটে যাওয়ার প্রচণ্ড বেগ অনুভব করলাম। আশা করি হোয়াইট হাউসের ফ্লাশিং সিসটেম কাজ করছে।
মঙ্গলবারে সাধারণত আমি ফুটবল খেলি। কিন্তু তার বদলে এটা ছিল বিছানায় তৃতীয় রাত। এর আগে রিপাবলিকান ও ডেমক্রেটস পার্টির সঙ্গে ট্রাম্প একটা মিটিং করেছেন। সেখানে টিভি ক্যামেরামেনদের ডাকা হয়েছিল। আমার বেডরুমের তিনটি স্কৃনেই সেসব খবর প্রাধান্য পাচ্ছিল। ওই মিটিংয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, ডৃমার্স (Dreamers) বা যাদের ‘স্বাপ্নিক’ বলা হয়- তরুণ, যথাযথ কাগজপত্রবিহীন ইমিগ্রান্ট যারা আমেরিকায় স্বপ্ন পূরণে আগ্রহী, যারা শিশুকালে আমেরিকায় এসেছিলেন, তাদের বিনা শর্তে আমেরিকায় থাকতে দেয়া উচিত হবে। তবে পরে মত পালটে তিনি বলেন, হ্যা, তারা থাকতে পারবে, কিন্তু তার আগে মেক্সিকোর সীমান্ত জুড়ে একটা দেয়াল তৈরি করতে হবে।
ট্রাম্পের এই স্বীয় মতবিরোধিতা বিষয়ে সিএনএন বলছিল। ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বলেন, বিষয়টি প্রাসঙ্গিক কারণ ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি বইতে ট্রাম্পের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশ্ন ওঠানো হয়েছে। কিন্তু ফক্স নিউজে সঞ্চালক টাকার কার্লসন বলেন, তার ধারণা এই স্ব-মতবিরোধিতা ছিল প্রেসিডেন্টের মাস্টারস্ট্রোক বা ওস্তাদের মার। আশ্চর্যের কিছু নয় যে, ফক্স নিউজ ট্রাম্পের প্রিয়।
আমার পেট ভর্তি এখন মাংস আর পনির। আমি আর টিভি দেখতে পারছি না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
চতুর্থ দিন
একজিকিউটিভ টাইমের পরে আমি বাইরে শপিংয়ে গেলাম। একটা বড় লাল টাই কিনলাম। আজ আমি প্রেসিডেন্টের মতো পোশাক পরব। টাইটা সত্যিই লম্বা এবং এটা আমার কোমরের নিচু অবধি বেঢপভাবে ঝুলতে থাকে।
আমি গলফ খেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। ট্রাম্পের লাইফস্টাইল অনুকরণ করতে গিয়ে এটাই হবে আমার প্রথম দৈহিক কাজ। ব্যারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি গলফ খেলতেন বলে ট্রাম্প তার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু খবরে প্রকাশ, এখন ট্রাম্প নিজেই অফিসের ২১ শতাংশ সময় গলফ খেলেছেন।
আর ছুটিতে থাকার সময়ে তিনি গলফ খেলতে গিয়েছিলেন ফ্লোরিডায় ওয়েস্ট পাম বিচ-এ ট্রাম্প ইনটারন্যাশনাল গলফ ক্লাবে। সাধারণত তিনি নিউ জার্সিতে নিজের গলফ ক্লাবে খেলতে পছন্দ করেন। আমি সেই ক্লাবে ফোন করলাম। বললাম, আমি বেশিক্ষণ খেলব না। জানতে চাইলাম আমি সেখানে বিকেলে গিয়ে খেলতে পারি কি?
‘না। শীতকালে আমাদের ক্লাব বন্ধ থাকে’। ফোনের ওদিকে এক নারী উত্তর দিল। সে আরো বলল, তার আগে বেডমিনস্টার নামে একটা মেম্বারশিপ কোর্স করতে হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, ওই কোর্সে যোগ দিতে কত ডলার লাগবে? ওই নারী আমাকে মেম্বারশিপ ডিপার্টমেন্টের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে দিল। কেউ কোনো উত্তর দিল না। তারপর আমি অনলাইনে গিয়ে জানলাম, শুধু মেম্বারশিপ কোর্সের ফি হচ্ছে তিন লাখ ডলার। আমি ওই কোর্সে যোগ দেব না স্থির করলাম।
এখন আমি সত্যিই গলফ খেলতে চাচ্ছিলাম। সাধারণত আমি খেলি না। কিন্তু একটা এক্সারসাইজ করার সুযোগ, হতে পারে সেটা হালকা, আমি হারাতে চাচ্ছিলাম না। ম্যানহাটান-এর বাইরে একটা ড্রাইভিং রেঞ্জ আছে, যেখানে সবাই গলফ খেলতে পারে। সেখানে গিয়ে টের পেলাম, তাড়াহুড়ো করে খেলতে আসায় আমি কোনো স্পোর্টস পোশাক পরে আসিনি। আমার পরনে ছিল সুট আর সেই বড় লম্বা লাল টাই। তবু আমি খেলব ঠিক করলাম। কিন্তু শিগগিরই বুঝলাম, সুট পরে গলফ খেলা বেশ অসুবিধাজনক। বিশেষত যদি সেই সুট হয় স্লিম ফিটিং। আমি বিষয়টা মনে রাখলাম। আর সে জন্যই বোধ হয় ট্রাম্প ১৯৯০ সালের কাধের কাছে চওড়া স্টাইলের ঢিলেঢালা সুট পরে গলফ খেলেন। টাইটাও একটা সমস্যা। ওটা আমার হাতের কাছে ঝুলতে থাকে। তবু বিছানায় থাকার চাইতে এটা ভালো।
বাড়ি ফেরার পথে আমি ম্যাকডোনাল্ডসে গেলাম। কাউন্টারের পেছনে যে লোকটি সার্ভ করছিল সে আমাকে চিনতে পেরে বড় টাই সম্পর্কে মন্তব্য ছুড়ল। আমি ট্রাম্প প্রসঙ্গ তুললাম না। নিউ ইয়র্ক সিটিতে ট্রাম্প তেমন জনপ্রিয় নন। আমার অর্ডার কমিয়ে দু’টি বিগ ম্যাক আর একটি ডায়েট কোক কিনলাম। ডায়েট কোকও প্রেসিডেন্টের ফেভারিট। এর আগে আমি দুই বাক্স ওরিওস (Oreos এক ধরনের চকলেট বিস্কিট যার মধ্যে থাকে শাদা কৃম। খুব মিষ্টি। শতাধিক বছরজুড়ে এটি আমেরিকানদের প্রিয় বিস্কিট) কিনেছিলাম। ট্রাম্প ওরিওস ভালোবাসেন।
বিছানায় বসে আমি বিগম্যাক খেতে শুরু করলাম। কিন্তু রুচি হলো না। পরপর কদিন তো বিগম্যাকই খেয়েছি। বরং ওরিওস খেতে ভালোই লাগল। ডেটিং অ্যাপ-এ যে মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছিল, সে জানাল ওরিওস তৈরি হয় নিরামিষে। আমি অনেক ওরিওস খেলাম।
পঞ্চম দিন
আজ সকালে একজিকিউটিভ টাইমটা একটু লম্বা হলো। হতে পারে সেটা বার্গার খাওয়ার জন্য। হতে পারে সেটা বিছানায় বেশি সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি উঠলাম ১১.৩০ মিনিটে।
একটা শিশুর বার্থডে পার্টি হয়ে যাওয়ার পর ঘরের অবস্থা যেমন হয়, আমার এপার্টমেন্টেরও তাই হয়েছিল। মেঝেতে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ম্যাকডোলান্ডসের ব্যাগ আর বাক্সগুলো। যেসব ওরিওস খাওয়া হয়নি সেসব পড়ে ছিল বিছানার নিচে। কিচেনের সিংকে ছিল অর্ধেক খাওয়া মিল্ক শেইক। গত রাতটা খুব খারাপ গেছে। আমি ভাবছিলাম এ জন্যই কি ট্রাম্প তার বেডরুমে কেউ আসুক সেটা তিনি চান না?
ফৃজ থেকে একটা ডায়েট কোক বের করে খেতে খেতে আরো ভাবছিলাম গত কয়েক দিনে আমি কি আবিষ্কার করেছি। আমি জেনেছি ফিলে-ও-ফিশ আমি পছন্দ করি না। কেউ আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চায় না। আরো জেনেছি, ওরিওস-এ কোনো দুধজাতীয় পদার্থ থাকে না।
কিন্তু ট্রাম্পের জীবনটা যে কত ‘সুন্দরভাবে’ কাটছে তার একটা ইঙ্গিতও আমি পেয়েছি। আমি তার জন্য দুঃখ বোধ করলাম। ফায়ার অ্যান্ড ফিউরির মতে, ট্রাম্প কখনোই প্রেসিডেন্ট হতে চাননি। ইলেকশনের রাতে যখন রেজাল্ট আসতে থাকল, তখন ট্রাম্পকে মনে হচ্ছিল ‘তিনি যেন একটা ভূত দেখছিলেন’।
সেই রাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেই অবস্থার খুব কোনো হেরফের হয়েছে কি? ট্রাম্পের রুটিনে মনে হয় না কেউ সেই রকমের একটা জীবন উপভোগ করছেন। একটা সীমাবদ্ধ এবং একঘেয়ে জীবন কাটাতে মনে হতে পারে তার হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে- কিন্তু বাস্তবে ক্রমশই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদ ও ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
কিন্তু ট্রাম্পের জীবনে যা হচ্ছে তার জন্য চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তিনিই দায়ী। তিনিই প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আমেরিকার বেশির ভাগ মানুষ যে তার বিপক্ষে চলে গেছে সেটার জন্য তিনিই দায়ী। তার ফ্যামিলি যে দূরে সরে গিয়েছে সেটাও তারই কীর্তি।
ট্রাম্প তার বিছানা তৈরি করেছেন- আক্ষরিক ও রূপক, উভয় অর্থেই এবং এখন তাকে সেখানে শুতে হবে।
অনেকক্ষণ।
স্টর্ম অ্যান্ড ফিয়ার
এডাম গ্যাবাট-এর লেখাটির ভাষান্তর পড়লেন। গ্যাবাট লিখেছেন মাইকেল উলফের ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি বইটিতে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে। ট্রাম্প জানতেন উলফের বইটি বাজারে প্রকাশিত হলে এ ধরনের অনেক ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপাত্মক লেখা বের হবে আটলান্টিকের দ্ইু তীরে। তাই এখন হচ্ছে। ভাষ্যকাররা বলছেন, বইতে সত্য-মিথ্যা যতই মেশানো থাকুক না কেন, মানুষ বইয়ের বিবরণকে সত্য মনে করবে। এডাম গ্যাবাটের মতো স্যাটায়ার ট্রাম্পের ভাবমূর্তির প্রচণ্ড ক্ষতি করবে। ট্রাম্প চেয়েছিলেন উকিলের নোটিশ দিয়ে বইটির প্রকাশনা বন্ধ করতে। কিন্তু সেই নোটিশ পাওয়ার আগেই, প্রকাশনার দিন কিছুটা এগিয়ে এনে প্রকাশকরা বইটি বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। বস্তুত উকিলের নোটিশ বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা বহু গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এই প্রকাশনার ঘটনা থেকে একটি সত্য বেরিয়ে এসেছে। সেটা হলো আমেরিকায় একটু সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে এ রকম চরিত্রহীন, অযোগ্য ও বিচিত্র মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তেমনি শাসক ও শাসকদলের সুবিধা মতো আমেরিকার সংবিধান সংশোধিত না হওয়ার ফলে সেখানে চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্টের জীবন বিষয়ে মাইকেল উলফের মতো বই ফায়ার অ্যান্ড ফিউরিও প্রকাশিত হতে পারে। এরপর থেকেই বইটি বেস্টমেলার লিস্টে নাম্বার ওয়ানে আছে। এবং এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন মিডিয়াতে এ নিয়ে সমালোচন-আলোচনা চলছে।
মাইকেল উলফ একটি ইন্টারভিউতে দাবি করেছেন, তিনি হোয়াইট হাউজের প্রায় ২০০ স্টাফের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে লিখেছেন।
মোট কথা, আমেরিকায় আইনের শাসন আছে। ফলে লেখার স্বাধীনতা আছে। বাকস্বাধীনতা আছে।
মাইকেল উলফ বাংলাদেশ এলে আরেকটি বই লিখতে পারবেন এবং তার নাম হতে পারে স্টর্ম অ্যান্ড ফিয়ার (ঝঃড়ৎস ধহফ ঋবধৎ, ঝড় ও ভয়)। তিনি এখানে এসে প্রথমে আমাকে ইন্টারভিউ করলে জানতে পারবেন, আমি স্যাটায়ার লিখতে পছন্দ করি। ১৯৮৬-এর জুলাইয়ে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কর্মজীবন নির্ভর একটি স্যাটায়ার রচনা (দিনের পর দিন) লিখেছিলাম সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে। একই সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনীর টাইটেল ছিল সংসদের শোভা ৩০ সেট অলঙ্কার। এটি ছিল অনির্বাচিত নারী এমপিদের বিষয়ে তথ্যভিত্তিক লেখা। এই দু’টি লেখার জন্য যায়াযায়দিন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং আমাকে আগস্ট ১৯৮৬-তে লন্ডনে চলে যেতে হয় নির্বাসনে। ডিসেম্বর ১৯৯০-এ প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর আমি স্বদেশে ফিরতে পারি। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল।
এরপর ৩১ মার্চ ১৯৯৬-এ দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হলেন চিফ জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি সেই পদে ছিলেন ২৩ জুন ১৯৯৬ পর্যন্ত। তার পরিচালিত সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী এবং বিএনপি পরাজিত হয়। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছাত্রজীবনে আমার বেশ সিনিয়র ছিলেন। তিনি পড়াশোনা শেষ করলেও চাকরি পাচ্ছিলেন না। হয়তো সেই কারণে তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় দড়ি দিয়ে আটকানো একটা চারকোনা কাঠের বাক্স কাধে ঝুলিয়ে বাক্সের মধ্যে রাখা সিগারেট, বিড়ি, ম্যাচ বক্স, পান, লজেন্স, ইত্যাদি বিক্রি করতেন। ছাত্রদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলাকালে তার ওই নিঃসংকোচ পান বিড়িওয়ালা রূপ দেখে আমি ইমপ্রেসড হয়েছিলাম। তার স্বাধীন পেশা, হোক না সাময়িক, প্রশংসিত হয়েছিল।
হাবিবুর রহমানের ডাক নাম ছিল শেলি। তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, অর্থাৎ সরকার প্রধান হলেন তখন সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে আমি একটি কলাম লেখা শুরু করলাম যার নাম ছিল ‘শেলির যথা ডায়রি’। এই কলামে আমি কল্পনা করেছিলাম হাবিবুর রহমান সরকার প্রধান রূপে কেমন দিন কাটাচ্ছেন।
কিন্তু ‘শেলির যথা ডায়রি’র প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই আমার কাছে ফোন এল। ফোনটি করেছিলেন স্বয়ং হাবিবুর রহমান। তিনি নম্রভাবে অনুরোধ করলেন আমি যেন এই কলামটি আর না লিখি। কারণটা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আপনার কল্পনার সঙ্গে বাস্তবটা খুব মিলে যাচ্ছে এবং এর ফলে আমার প্রশাসনিক কাজে অসুবিধা হতে পারে।’
হাবিবুর রহমানের অনুরোধ আমি রেখেছিলাম। আমি আর ওই কলামটি লিখিনি। তবে তাকে অনুরোধ করেছিলাম তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে রিটায়ার করার পর তিনি যেন যায়যায়দিনে সরকার প্রধানের জীবন ও কাজ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে লেখেন। কিন্তু তিনি আমার সেই অনুরোধ রাখেননি।
আমেরিকার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনের ২২ জানুয়ারি ২০১৮-র সংখ্যার কভারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কার্টুন ছবি বেরিয়েছে তার নাম ছাড়া। শুধু দুটি অক্ষরে লেখা ইয়ার ওয়ান। এই কভারে দেখানো হয়েছে ট্রাম্পের সোনালি চুল থেকে আগুনের শিখা বের হচ্ছে আর তার চেহারায় প্রচণ্ড রাগ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অথবা সরকার প্রধান বিষয়ে মাইকেল উলফের মতো বই অথবা এডাম গ্যাবাটের মতো কলাম অথবা টাইম ম্যাগাজিনের মতো কার্টুন কভার সম্ভব নয়। মাইকেল উলফ যদি বাংলাদেশ বিষয়ে লেখেন স্টর্ম অ্যান্ড ফিয়ার তাহলে দেশ জুড়ে জনমতের ঝড় উঠতে পারে। শাসকরা ভীত হতে পারেন। এর পরিণতিতে লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক বিপদে পড়তে পারেন। অথবা বলা যায়, বাংলাদেশে যদি ঝড় ও ভয় বিদ্যমান থাকে, তাহলে শাসককুল এবং শাসিতকুল, উভয়ের কেউই নিরাপদে থাকবে না। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, যেখানে আইনের শাসন বা রুল অফ ল থাকে না- সেখানে বাক ও লেখার স্বাধীনতাও থাকে না।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন