মৃত্যু উপত্যকার অধিবাসী
21 February 2016, Sunday
১৯৮৮-তে আমি ও আমার স্ত্রী তালেয়া রেহমান টরন্টোতে গিয়েছিলাম- এক বিকেলের জন্য। নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখে টরন্টোতে গিয়েছিলাম ড্রাইভ করে।
প্রায় আটাশ বছর টরন্টো দেখার সুযোগ পাইনি। এবার টরন্টো নিবাসী সাংবাদিক লেখক মি. মোহাম্মদ আলী বোখারীর কল্যাণে কিছুটা দেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি টরন্টো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়েছেন- আমি যুগপৎ মুগ্ধ এবং উদ্বিগ্ন হয়েছি।
মুগ্ধ হয়েছি টরন্টোর সৌন্দর্য এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখে।
উদ্বিগ্ন হয়েছি ঢাকা তথা বাংলাদেশের সঙ্গে টরন্টো তথা কানাডার বিশাল ভিন্নতা দেখে। কয়েকটি প্রধান ভিন্নতা, যা আমাকে আরো দুর্ভাবনায় ফেলেছে, প্রথমে সে বিষয়ে লিখব।
জাতিসংঘের হিসাব মতে ৩১ অক্টোবর ২০১১-তে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ৭ বিলিয়ন। এখন প্রায় চার বছর পরে ২০১৫-তে বিশ্বের আনুমানিক জনসংখ্যা হচ্ছে ৭.৩ বিলিয়ন। এর মধ্যে কানাডার জনসংখ্যা ১ এপৃল ২০১৫-তে ছিল প্রায় তিন কোটি ৫৮ লক্ষ। কানাডার জন্মহারের সংখ্যা ২০১৫-তে হয়েছে ০.১ শতাংশ।
কানাডার প্রতি বর্গ মাইলে জনসংখ্যা হচ্ছে ৮.৮ জন এবং বিশ্বের ২৪১টি দেশের মধ্যে কানাডার এই জনঘনত্ব ২৩০তম। অর্থাৎ, খুবই নিচের দিকে।
অন্য দিকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা, জন্মহার ও জনঘনত্ব বিতর্কিত। আওয়ামী সরকার এক্ষেত্রে তার সাফল্য দেখাতে চায়। তাই বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়। যাই হোক, সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশের জনঘনত্ব প্রতি বর্গ মাইলে ২,৪৯৭ জন। অন্যান্য সূত্রমতে ২,৮০০ জন। বিশ্বের ২৪১টি দেশের মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই উপরের দিকে। বাংলাদেশের অবস্থান বারো নাম্বারে। বাংলাদেশের উপরে আছে মাত্র কয়েকটি দ্বীপ ও স্থান- যেমন, ম্যাকাও, মোনাকো, সিংগাপুর, হংকং, জিব্রলটার, ভাটিকান সিটি, বাহরেইন, মল্টা, বার্মুডা, সেন্ট মার্টেন (হলান্ডের) এবং মালদ্বীপ। অন্য ভাবে বলা চলে, বিশ্বের সব মানুষকে যদি কানাডায় রেখে দেয়া হয় তাহলেও কানাডার জনঘনত্ব বাংলাদেশের জনঘনত্বের সমান হবে না। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কানাডার চেয়ে বারো গুণ বেশি। আর সেজন্যই বাংলাদেশে এখন যানজটের চাইতে বেশি জনযট।
নায়াগ্রা পেরিয়ে অন্টারিওতে ঢুকলেই দেখা যাবে বিভিন্ন কানাডিয়ান শহরের সাইনপোস্টে লেখা আছে শহরের জনসংখ্যা। বাংলাদেশে এমন লেখা দেখা যায় না। বরং বাংলাদেশে আরেকটি নতুন বিপদ দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি বৃটিশ পার্লামেন্টে একটি বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত জুনে একটি পার্লামেন্টারি বিতর্কে বলা হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চল ক্রমেই ডুবে যাবে এবং ৪০ শতাংশ মানুষকে অন্য জায়গায় সরে যেতে হবে।
কোথায়?
এর উত্তর কে দেবে?
অনেকের ধারণা বাংলাদেশের মানুষকে যেতে হবে ইনডিয়ার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে। অথবা বহু মানুষকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য বৃটিশ পার্লামেন্টের ওই বিতর্কে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ৮০০ কিলোমিটার বাঁধ দিতে হবে- যেন দেশের মানুষ দেশেই থাকতে পারে।
বাংলাদেশে এখন প্রত্যক্ষ মৃত্যুদণ্ড এবং পরোক্ষ মৃত্যুদণ্ড বিরাজ করছে। প্রত্যক্ষ মৃত্যুদণ্ড হতে পারে অপরাধ সম্পর্কিত এবং রাজনৈতিক সম্পর্কিত- অথবা উভয়ই।
বলা যায়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশ এখন একটি মৃত্যু উপত্যকা। আমরা সেই মৃত্যু উপত্যকার অধিবাসী।
বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিলীন হয়ে যাবার সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে পরোক্ষ মৃত্যুদণ্ডের কথা বলতেই হবে। বাংলার মানুষ এখন বঙ্গোপসাগর এবং ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের তথ্য অনুসারে কিছুদিন পরে বাংলাদেশেই মানুষ ডুবে মারা যাবে। আমরা সবাই সেই পরোক্ষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষ বায়ুদূষণে মারা যাবে ও যাচ্ছে। আগস্ট ২০১৫ তে লন্ডনের ইকনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে বিশ্বের যে দশটি শহরে বাতাস ও পরিবেশ সবচেয়ে ভালো, তার মধ্যে রয়েছে কানাডারই তিনটি শহর- তৃতীয় স্থানে ভ্যানকুভার, চতুর্থ স্থানে টরন্টো এবং পঞ্চম স্থানে ক্যালগেরি। প্রথম স্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন এবং দ্বিতীয় স্থানে অস্টৃয়ার ভিয়েনা। টরন্টোর বাতাস খুব ভালো সেটা টুরিস্টরা বুঝতে পারেন।
অন্য দিকে ঢাকা বিশ্বের দশটি নিকৃষ্টতম শহরগুলো বা আনলিভেবল (Unliveable) সিটির মধ্যে স্থান পেয়েছে। ইকনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে ২০১৪-তে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে নিকৃষ্টতম শহর (Unliveable City বা বসবাসের অযোগ্য শহর) ছিল সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিপন্ন দামাস্কাস। আর তারপরেই ছিল ঢাকা।
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক পিওর আর্থ (PURE EARTH) সংস্থা বিশ্বের ২০টি দেশের ৭৫টি শহরে জরিপ চালিয়ে ২০১৩-তে জানিয়েছে, ঢাকার হাজারিবাগ থানা টপ দশটি দূষিত স্থানের অন্যতম।
বস্তুত মানুষ যেদিন আগুন আবিষ্কার করেছে, সেদিন থেকে মানুষ বিশ্বের দূষণ শুরু করেছে। গৃনল্যান্ডের গ্লেসিয়ার পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, গৃক, রোমান ও চায়নিজরা আগুন দিয়ে ধাতব পদার্থ বানানো যখন শুরু করে- তখন থেকে এই দূষণপ্রক্রিয়া আরো দ্রুত হতে থাকে। অর্থাৎ, নগরায়ন ও কলকারখানা বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে দূষণপ্রক্রিয়াও বিস্তৃত হতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization, WHO) বলেছে আগামীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে নিচের কারণে :
বায়ুদূষণ
আবর্জনাদূষণ
শব্দদূষণ
মাটিদূষণ
পারমাণবিকদূষণ
প্লাস্টিক/ পলিথিনদূষণ
পানিদূষণ- যে পানিতে এখন পেস্টিসাইড, ফার্টিলাইজার ক্লোরিন, মলমূত্র, শিল্প বর্জ্য পদার্থ সবই থাকে।
এসব পরোক্ষ মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি বাংলাদেশির উপর।
কিন্তু কানাডা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সারা বিশ্বে নন্দিত হয়েছে।
কানাডার সঙ্গে মৃত্যুমুখী বাংলাদেশের আরো অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে।
কানাডাতে মেডিকাল এইড বা চিকিৎসা ফৃ। বাংলাদেশে?
কানাডাতে ফুটপাথ নিবাসী কেউ নেই। বাংলাদেশে?
কানাডাতে শিক্ষার জন্য ভ্যাট দিতে হয় না। বাংলাদেশে?
কানাডাতে বেকারের সংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। তাই তারা সাগর পাড়ির ঝুকি নিচ্ছে।
প্রাকৃতিক আবহাওয়া বিবেচনা করলে প্রচণ্ড শীতের দেশ কানাডার তুলনায় নাতিশীতোষ্ণ ট্রপিকাল দেশ বাংলাদেশে জীবনযাত্রা সহজ সাধ্য।
তবুও আত্মীয়স্বজন ছেড়ে কেউ যখন কানাডা অভিমুখী হয় তখন প্রধানত তার দুটি চিন্তা থাকে। এক. ইমিগ্রেশন ক্যারিয়ার বা বাধা পেরিয়ে কোনো এক সময়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পাওয়া যাবে কিনা এবং দুই. কানাডায় চাকরি পাওয়া যাবে কি না। এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কানাডামুখী কোনো বাংলাদেশিকে অপমৃত্যুর ঝুকি নিতে হয় না। কিন্তু সরকারি মামলা-মোকদ্দমা ও সরকার দলীয় কর্মীদের চাদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে অথবা বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় বাংলাদেশের মানুষ এখন মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে। আর তাই তাদের মধ্যে যারা দুর্ভাগা তারা সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে। তারা মনে করে মৃত্যু উপত্যকায় অবধারিত মৃত্যুর বদলে, বাচার একটা চান্স নেওয়া উচিত। তারা মনে করে, সাগরে ডুবে মারা না গেলে, বিদেশে পৌছাতে পারলে, একটা সমাধান হবেই হবে। তাই তারা মৃত্যুর ঝুকি নিচ্ছে। এ রকম ঝুকি এখন কানাডায় বসবাসকারী বাংলাদেশিকে আগে নিতে হয়নি।
বাংলাদেশ সরকার এখন যুদ্ধ অপরাধীদের ফাসি দেওয়া শেষ হয়ে গেলে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার কথা ভাবছে। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশে বন্ধ হলেও হতে পারে। কিন্তু যে পরোক্ষ মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক পাচ্ছেন তাদের ভবিষ্যত কি?
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন