বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলে এই ভূখণ্ডে ঈদ উল-ফিতরের কয়েক দিন আগে শাস্তিপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে নির্বাচিত কয়েক জনের দণ্ড মওকুফ অথবা কমিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল। এই সংবাদটি সরকারি প্রেস নোটে জানিয়ে দেওয়া হতো এবং সাধারণত সেটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হতো। এই সরকারি আদেশে নির্বাচিত কিছু বন্দিকে পূর্ণ দণ্ডের মেয়াদ পূর্তির আগেই মুক্তি দেওয়া হতো, অথবা দণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে দেওয়া হতো, অথবা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বন্দির মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হতো। সাম্প্রতিক কালে এই ধরনের কোনো প্রেস নোট ঈদের আগে প্রকাশিত হয়নি।
১৪ নভেম্বর ২০১২ তে তদানীন্তন পার্লামেন্টে স্বতন্ত্র এমপি ফজলুল আজিমের এক প্রশ্নের উত্তরে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর জানান রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান :
১৯৮৭ ১ জন
২০০৫ ২ জন
২০০৮ ১ জন
২০০৯ ১ জন
২০১০ ১৮ জন
২০১১ ২ জন
অর্থাৎ, ১৯৭২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মোট ২৫ জন মৃত্যুদণ্ডের আদেশ থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান।
এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়:
• স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কোনো আসামিকে ক্ষমা করা হয়নি।
• সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে ক্ষমা করার সূচনা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিন আহমেদ হত্যা মামলায় দণ্ডিত এক আসামিকে ১৯৮৭ তে ক্ষমা করা হয়। ময়েজ হত্যা মামলায় শাস্তি প্রাপ্তরা ছিলেন এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী। তাই ধারণা করা যেতে পারে এ ক্ষেত্রে দণ্ডিত ব্যক্তিকে ক্ষমার কারণ ছিল রাজনৈতিক।
• খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ২০০৫-এ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত দুই আসামি। এর মধ্যে ঝণ্টুকে ক্ষমা করার বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। অনুমান করা হয়েছিল এই ক্ষমার কারণ ছিল রাজনৈতিক।
• সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকারের সময়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত এক আসামিকে ক্ষমা করা হয়।
• শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে মহাজোট সরকারের সময়ে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ২০১০ এবং ২০১১-তে দুটি ভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত মোট ২৯ আসামিকে ক্ষমা করেন।
প্রথম মামলায় বিএনপির সাবেক উপমন্ত্রী নাটোরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সব্বির ওরফে গামাকে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ নলডাঙ্গা থানার আমতলি বাজারে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার দায়ে ২৪ আগস্ট ২০০৬-এ ঢাকার দ্রুত বিচার আদালতে মামলার রায়ে ২১ জন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে একজন পলাতক ছিলেন। বাকি ২০ জন ক্ষমা এবং জেল থেকে মুক্তি পান আওয়ামী লীগ শাসন আমলে। ধারণা করা হয় এই ক্ষমার কারণ ছিল রাজনৈতিক। গণহারে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের গণহারে ক্ষমা পাওয়া ও গণ খালাস হওয়ার এই দৃষ্টান্ত ছিল বাংলাদেশে প্রথম। মৃত্যুদণ্ড বিরোধীরা এই গণ ক্ষমাকে সমর্থন দিলেও প্রকৃত আসামিদের কোনো শাস্তিই না হওয়াটার সমালোচনা করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার এই সময়ে ক্ষমার মাহাত্ম্য প্রচার করলেও দুই বছর পরেই ২০১৩ তে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় দণ্ডিত পাচ জনকে গণ ফাসি দেয়।
দ্বিতীয় মামলায় লক্ষ্মীপুরের এডভোকেট নুরুল ইসলামকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা তাহেরের ছেলে এ.এইচ.এম বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ৪ জুলাই ২০১২-তে ক্ষমা করে দেন। বলা বাহুল্য, এই ক্ষমাটিরও কারণ ছিল রাজনৈতিক।
১৪ নভেম্বর ২০১২-তে আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর আরো জানান যে, দেশের ৬৮-টি জেলখানার মধ্যে, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, যশোর ও রাঙামাটি ছাড়া বাকি ৬৪টিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি রাখা হয়েছে। এ মধ্যে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ২,৮৮২ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে বন্দি রয়েছেন ৭,৮৩০ জন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দেশের জেলখানাগুলোর মোট ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৩৩,৪৩৬ জন। কিন্তু সেখানে মোট বন্দি আছেন ৬৪,২৫৫ জন- অর্থাৎ, প্রায় দ্বিগুন। এই বন্দিদের মধ্যে ৬২,০৪১ জন পুরুষ এবং ২,২১৪ জন নারী।
এগিয়ে এসেছেন ইইউ রাষ্ট্রদূতরা
অতি সম্প্রতি সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছেন ঢাকাস্থ ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতরা।
১০ অক্টোবরে জাতি সংঘ ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড বিরোধী বিশ্ব দিবস (World Day Against Death Penalty)পালন উপলক্ষে ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা সম্মিলিতভাবে একটি বিবৃতিতে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করা এবং ইতিমধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেসব কার্যকর না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
৯ অক্টোবর ২০১৪-তে প্রকাশিত এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইইউ আশা করে জাতি সংঘের একটি সদস্য দেশ রূপে জাতি সংঘের সব প্রস্তাব বাংলাদেশ মেনে চলবে এবং সেইভাবে সকল মৌলিক অধিকার ও মানব সম্মান রক্ষা করবে।
সম্মিলিত বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, মানব অধিকার ও সম্মান রক্ষায় মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করণ একটি অতি আবশ্যকীয় পদক্ষেপ। কূটনীতিকরা স্মরণ করিয়ে দেন, ১৮ ডিসেম্বর ২০০৭-এ জাতি সংঘ সাধারণ অধিবেনে গৃহীত প্রস্তাব নং ৬২/১৪৯-কে আরো শক্তিশালী করেছে আরো তিনটি প্রস্তাব। এই তিনটি প্রস্তাব হচ্ছে ১৮ ডিসেম্বর ২০০৮-এর ৬৩/১৬৮ প্রস্তাব (Resolution-রিজলিউশন), ২১ ডিসেম্বর ২০১০-এর ৬৫/২০৬ প্রস্তাব এবং ২০ ডিসেম্বর ২০১২-র ৬৭/১৭৬ প্রস্তাব। যেসব দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সেটা নিষিদ্ধ করার জন্য এবং ইতিমধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেটা কার্যকর না করার জন্য চার বছরের এই চার প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
কূটনীতিকরা বলেন, মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করণের দিকে যদিও একটি বৈশ্বিক ধারা এখন চলছে, তবুও বহু দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ড চালু আছে এবং সেটা উদ্বেগজনক।
বেচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ও তৎপর থেকেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। জাতি সংঘ থেকে মানব অধিকার বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে। বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক চুক্তি (International Covenant on Civil and Political Rights) সম্পাদিত হয়েছে।
ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, কোনো অন্যায় বিচার অথবা ভুল ভ্রান্তিমূলক বিচারের ফলে যদি কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং সেটা কার্যকর করা হয় তাহলে সেই ভুল সংশোধনের কোনো পথ আর থাকে না। মৃত ব্যক্তিকে পুনর্জীবিত করা যায় না।
এই কূটনীতিকরা আরো বলেন, সকল ব্যক্তির মানব অধিকার রক্ষার চূড়ান্ত দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। সুতরাং রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে কোনো ব্যক্তিই যেন তার মানব অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
নয় ডিপ্লম্যাটের একটি মাইলস্টোন
এই সম্মিলিত বিবৃতিতে সই করেছেন নয় কূটনীতিক:
ফ্রেডারিক মৌলারু (Frederic Maoluraud), ইইউ এর শার্জ ডি এফেয়ার্স
হেইনে ফুগি এসকেআর (Hanne Fugi Eskjaer), ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত
মিশেল টৃনকেয়ার (Michel Trinquier), ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত
ড. ফার্দিনান্দ ফন ওয়েওয়ে (Dr Ferdinand von Weyhe), জার্মানির শার্জ ডি এফেয়ার্স
জর্জিও গুলেইলমিনো (Giorgio Guglielmino), ইটালির রাষ্ট্রদূত
গারবেন ডি ইয়ং (Gerben de Jong), নেদারল্যান্ডসের (হল্যান্ড) রাষ্ট্রদূত
লুই টেয়াডা শাকোন (Luis Tejada Chacon), স্পেনের রাষ্ট্রদূত
কারিন ম্যাকডোনাল্ড (Karin McDonald), সুইডেনের শার্জ ডি এফেয়ার্স
রবার্ট গিবসন (Robert Gibson), বৃটিশ হাই কমিশনার
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধকরণ তথা মানব অধিকার ও সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই নয় ডিপ্লম্যাটের সম্মিলিত বিবৃতিটি একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।
তবে কূটনীতিকদের এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ২০১৩-তে বাংলাদেশে অন্তত ১৭১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় গণমৃত্যুদণ্ড হয়েছে ১৬৪ জনের- দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ১৪ জনের এবং পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ১৫২ জনের। আরেকটি মামলায় রায়ের পর প্রচলিত আইন বদলিয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে নতুন আইনের রেট্রসপ্রেকটিভ এফেক্ট দিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং কার্যকর করা হয় গত বছরে। অনেকের মতে এটা ছিল বাংলাদেশে এবং হয়তো বা বিশ্বে ব্যাক ডেট দিয়ে ফাসি দেওয়ার প্রথম ঘটনা।
পাইকারি হারে এসব মৃত্যুদণ্ড ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে মৃত্যুদণ্ড পিপাসু দল রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং এই নয় ডিপ্লম্যাট এবং ইওরোপিয়ান ইউনিয়নকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন আওয়ামী লীগ এই বিকৃত মানসিকতা মুক্ত হয়। পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টিকেও স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে ভবিষ্যতে তারা কেউ ক্ষমতায় এলে (একক অথবা জোটবদ্ধভাবে) আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসা পলিটিক্স যেন অনুসরণ না করে। অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সহ দেশের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে মৃত্যুদণ্ড বিরোধিতায় ইইউয়ের সুদৃঢ় অবস্থানটি বুঝিয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে এই দলগুলো তাদের আগামী নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে মৃত্যুদণ্ড বিরোধী অবস্থান ঘোষণা করতে পারে।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধী এনজিও অনুপস্থিতির কারণ
একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে সাধারণ মানুষ এবং মানব অধিকার বিষয়ক এনাজিওগুলোকেও সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে। ইইউ এবং অন্যান্য দেশের সহযোগিতা ও অর্থায়নে বাংলাদেশে কয়েক হাজার এনজিও থাকলেও মৃত্যুদণ্ডবিরোধী আন্দোলনের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে একটি এনজিওর-ও কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
এর কারণ কি?
কারণ আওয়ামী লীগের ভয় এবং আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণরোষের ভয়।
বাংলাদেশে কেউ মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করলে, আওয়ামী লীগ দ্বারা তিনি চিহ্নিত হতে পারেন :
১. তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী এবং
২. তিনি যুদ্ধ অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- এই দুই খুটির ওপর মৃত্যুদণ্ডের গ্রহণযোগ্যতাকে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বহু সভ্য মানুষ আছেন যারা এই বিশেষ দুটি শ্রদ্ধা ও চেতনা পোষন করে, অভিযুক্তদের ন্যায় বিচার ও শাস্তি চাইলেও, মৃত্যুদণ্ড চান না।
টোটাল কনফিউশনে সমাজের একাংশ
অতি দুঃখের বিষয় আওয়ামী লীগের এই অমানবিক রাজনৈতিক দর্শনে আচ্ছন্ন হয়েছেন বুদ্ধিজীবীদের একাংশ, সুশীল সমাজের একাংশ এবং তরুণ সমাজের একাংশ। যার পরিণামে ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ঢাকায় শাহবাগে হয়েছিল মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে বিভ্রান্ত তরুণদের আন্দোলন। এই তরুণ সমাজ, যারা শাহবাগি নামে পরিচিত হয়েছে তারা এতটাই বিভ্রান্ত হয়েছিল যে ব্যক্তির মৃত্যুর দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গণ জমায়েত করেছিল নম্রতার প্রতীক মোমবাতি হাতে নিয়ে। তবে কি ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তির জন্মদিন পালনের উপলক্ষে গণ জমায়েত হবে কাঠিন্যের প্রতীক ফাসির দড়ি হাতে নিয়ে?
এই বিভ্রান্তি গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে সমাজে। যার একটি দৃষ্টান্ত দেখা গেছে ১০ অক্টোবর ২০১৪-তে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী বিশ্ব দিবসে।
এই দিন ট্রান্সকম গ্রুপের বাংলা দৈনিক প্রথম আলো-তে “শাহবাগে বাংলা বসন্ত” শিরোনামে মহিউদ্দিন আহমদের একটি রচনায় চার কলাম ব্যাপী ২০১৩-র সেই মোমবাতি মিছিলের ছবি ছাপা হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে প্রকাশিত চারটি বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছে। রচনাটিতে শাহবাগের এই তরুণ সমাবেশকে ইজিপ্টের তাহরির স্কোয়ারের গণসমাবেশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
এই তুলনা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ তাহরির স্কোয়ারের গণসমাবেশ ছিল ইজিপ্টে ৪,০০০ বছরের মধ্যে এই প্রথম সত্যিকার একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারক ও তার সামরিক সহযোগীদের বিদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন। শাহবাগে আন্দোলনের কোনো গণতান্ত্রিক লক্ষ্য ছিল না। বরং এই আন্দোলন সহায়ক হয়েছে শেখ হাসিনাকে নির্বাচন বিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় থেকে যেতে অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পরাজিত করতে এবং স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
অন্যদিকে একই দিনে ট্রান্সকম গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টার-এ তৃতীয় পৃষ্ঠায় এবং দৈনিক নিউ এইজ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন ডিপ্লম্যাটদের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী বিবৃতিটির সারমর্ম প্রকাশিত হয় - যা বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রধান দৈনিকে সেদিন প্রকাশিত হয় নি। বিবৃতিটি দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়েছিল পরদিন ১১ অক্টোবর ২০১৪-তে।
মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও তরুণ সমাজের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে যে বিশাল কনফিউশন বিরাজ করছে সেটা যেহেতু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কারণে লালিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ দ্বারা, সেহেতু, মৃত্যুদণ্ড বিরোধী কোনো আন্দোলনকে সফল করতে হলে ইওরোপিয়ান ইউনিয়নকে আরো অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষত মৃত্যুদণ্ড বিরোধী কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা সূচিত হলে তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করতে হবে এবং নির্ভয় দিতে হবে।
আরো সক্রিয় হতে হবে
ইইউয়ের এই মানবতাবাদি ডিপ্লম্যাটরা হয়তো শুনেছেন উইসকনসিন-ম্যাডিসন ইউনিভার্সিটির ড. রবার্ট এনরাইট আন্তর্জাতিক ক্ষমাপরায়ণতা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন (Dr Robert Enright, Founder of International Forgiveness Institute, University of Wisconsin-Madison)। ক্ষমতাপরায়ণতা বিষয়ে রিসার্চের জনক রূপে ড. এনরাইট স্বীকৃত।
ক্ষমা করার ২০ ধাপের একটি পদ্ধতি ড. এনরাইট প্রচার করেছেন। তার সাম্প্রতিক রিসার্চে তিনি দেখিয়েছেন কোন ধরনের ব্যক্তিরা ক্ষমাপরায়ণ হতে পারেন। তার রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করেছে যারা নিউরোটিক, ক্রুদ্ধ এবং সমাজের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তারা কম ক্ষমাপরায়ণ হন এবং বহু সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের মনোভাবের পরিবর্তন হয় না। পক্ষান্তরে, যারা ক্ষমাপরায়ণ তারা সাধারণত সুখী এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন।
ড. এনরাইটের রিসার্চ বুঝতে চেষ্টা করেছে এর কারণ। দেখা গেছে ক্ষমাশীলতা মানুষের কার্ডিওভাসকুলার ও নার্ভাস সিসটেমকে শান্ত ও ভালো রাখে এবং তার ফলে ক্ষমাপরায়ণ ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও মনমেজাজ ভালো থাকে। উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা কম ক্ষমাপরায়ণ তাদের মানসিক তো বটেই, স্বাস্থ্যগত সমস্যাও হয় বেশি।
লার্নিং টু ফরগিভ বইয়ের লেখক স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ড. ফ্রেড লাসকিন (Learning to Forgive by Dr. Fred Luskin of Stanford University) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ক্ষমাপরায়ণতা মানুষকে দৈহিক ও মানসিকভাবে শক্তিমান করে। আর তাই, মানুষকে যেমন বিভিন্ন গুণ আয়ত্ব করতে হয়, ঠিক তেমনি তাকে ক্ষমাপরায়ণতার গুনটিও আয়ত্ব করতে হবে।
মানুষ যেন ক্ষমাপরায়ণতার গুণটি আয়ত্ব করতে পারে সেই লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফরগিভনেস এলায়েন্স (Worldwide Forgivenss Alliance, বিশ্বব্যাপী ক্ষমাপরায়ণতা জোট) কাজ করে যাচ্ছে। আগস্ট মাসের প্রথম রোববারটি ফরগিভনেস ডে (Forgiveness Day, ক্ষমাপরায়ণতা দিবস) রূপে উদযাপিত হচ্ছে। এই সংস্থাটি ড. লাসকিনকে “ক্ষমাপরায়ণতার চ্যাম্পিয়ন” উপাধি দিয়েছে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেসব ব্যক্তি নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর তিনটি ভিন্ন রিসার্চে জানা গেছে যারা ক্ষমাশীল হয়েছেন তারা এখন আরো আশাবাদি, আরো মায়া-মমতাময় এবং আরো আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। এই তিনটি রিসার্চে দেখা গেছে প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিরা মানসিক চাপে ভোগেন এবং তার ফলে তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
ক্ষমাপরায়ণতার প্রয়োজনীয়তা এখন বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত হলেও, কিভাবে ক্ষমা করা সম্ভব সে বিষয়ে গবেষণা চলছে। জনমত জরিপ সংস্থা গ্যালাপ (Gallup) ১৯৮৮-তে আমেরিকায় একটি জরিপ চালিয়ে জানতে পারে ৯৪% মনে করেন কোনো মানুষকে ক্ষমাশীল করে তোলার জন্য অন্যের সাহায্য দরকার হতে পারে।
আর তাই ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের ডিপ্লম্যাটরা যে বাংলাদেশে ক্ষমাপরায়ণতার বাণী প্রচার করেছেন সেজন্য তারা প্রশংসা পাবেন। কিন্তু তাদের কাজে সাফল্য অর্জন করায় প্রচুর বাধা আছে। বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, ক্ষমা নয়-ঠিক তার বিপরীতটাই, অর্থাৎ, প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার পোস্টার যখন অবিরাম প্রচারিত হয়। সুতরাং শুধু বিবৃতি নয়, ডিপ্লম্যাটদের অন্য কাজও করতে হবে।
ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের ডিপ্লম্যাটরা তাদের এই কাজের সূচনা এখনই করতে পারেন। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের বিভ্রান্ত অংশটিকে সুপথগামী করতে বার্ডম্যান অফ আলকাতরাজ মুভি ও কাহিনীর বহুল প্রচারের ব্যবস্থা তারা করতে পারেন। কালজয়ী এই মুভিতে দেখানো হয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করলে মানবসমাজ ও প্রাণীকুল- উভয়েই উপকৃত হতে পারে। এখন এর কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার পড়ুন।
বার্ডম্যান অফ আলকাতরাজ
রবার্ট স্ট্রাউড-এর জন্ম হয়েছিল ২৮ জানুয়ারি ১৮৯০-এ আমেরিকার সিয়াটল শহরে। তার মা অ্যান-এর প্রথম স্বামীর ঔরসে দুটি কন্যা সন্তান ছিল। দ্বিতীয় স্বামী, বেনজামিন স্ট্রাউড ছিলেন রবার্টের পিতা। তিনি মদ খেতে আসক্ত ছিলেন। বাড়ির দুর্বিষহ পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে রবার্ট স্ট্রাউড ১৩ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। ১৮ বছর বয়সে তিনি পৌছান সুদূর আলাস্কায়।
সেখানে জুনিউ শহরে তার পরিচয় হয় কিটি ও’ ব্রায়েন নামে এক যৌনকর্মী ও ডান্স হল এনটারটেইনারের সঙ্গে। রবার্ট তার দালালি শুরু করেন এবং কাস্টমার আনতে থাকলেন।
১৯০৯-এ রবার্ট যখন একটি কাজে ছিলেন তখন চার্লি ভন ডাহমার নামে এক কাস্টমার কিটির সঙ্গে মিলন শেষে কোনো টাকা দেন না। বরং কিটি তার প্রাপ্য টাকা চাইলে চার্লি তাকে পিটিয়ে তার গলা থেকে একটা লকেট ছিনিয়ে চলে যান। ওই লকেটে ছিল কিটির মেয়ের একটা ছবি। কিটি এই লকেট হারানোটা মেনে নিতে পারেন না।
রবার্ট কাজ থেকে ফিরে এলে কিটি তাকে সবিস্তারে ঘটনাটি বলেন। রবার্ট ক্ষিপ্ত হয়ে চার্লির কাছে যান। দুজনের মধ্যে মারামারি হয়। ফলে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার্লি মারা যান। এই ঘটনার পরপরই রবার্ট স্ট্রাউড থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ এবং রিভলভার সমর্পণ করেন। পুলিশ তাদের রিপোর্টে বলে, মারামারিতে চার্লি অজ্ঞান হয়ে যাবার পরে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে রবার্ট তাকে গুলি করেছিলেন।
রবার্টের মা অ্যান তাকে বাচানোর জন্য একজন উকিল নিয়োগ করেন। ২৩ আগস্ট ১৯০৯-এ রবার্টের বারো বছর জেলদণ্ড হয়। তাকে ম্যাকলিন আইল্যান্ডের জেলখানায় দ্বীপান্তর করা হয়।
ম্যাকনিল আইল্যান্ডের এই জেলখানায় সহিংস বন্দিরূপে রবার্ট দ্রুত কুখ্যাত হন। তিনি প্রায়ই অন্যান্য বন্দি ও জেলকর্মীদের এটাক করতেন। তিনি কিচেন থেকে খাবার চুরি করেছিলেন, বিষয়টি এক বন্দি রিপোর্ট করায় তাকে ছুরি মেরেছিলেন। নেশার জিনিস জেলখানায় আনতে ব্যর্থ হয়ে এক গার্ড এবং আরেক বন্দিকে আক্রমণ করেছিলেন। এসব কারণে তাকে ম্যাকলিন আইল্যান্ড থেকে সরিয়ে কানসাসের লিভেনওয়ার্থ জেলে ট্রান্সফার করা হয়।
সেখানে মাত্র ছয় মাস পরে ২৬ মার্চ ১৯১৬-তে আরেকটি হত্যাকাণ্ডে রবার্ট জড়িয়ে পড়েন। রবার্টের ছোট ভাই তার সঙ্গে আট বছর পরে দেখা করতে এসে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এনড্রু টার্নার নামে জেলখানার কাফেটারিয়ার এক স্টাফ এর জন্য দায়ী ছিলেন। রাগে রবার্ট হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুরিকাঘাত করেন এনড্রু-কে। এনড্রু মারা যান।
এবার ফার্স্ট ডিগৃ মার্ডার চার্জে ফাসিতে রবার্টের মৃত্যুদণ্ড হয়। রবার্ট যখন সলিটারি সেলে ফাসি কার্যকরের অপেক্ষায় ছিলেন তখন সুপৃম কোর্টের একটি শুনানিতে তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ হয়ে যায়। পরিবর্তে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রবার্ট স্ট্রাউডের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের কারণ ছিল সরকার পক্ষের সলিসিটর জেনারেল জন ডেভিস স্বীকার করেন যে, যেহেতু তিনি আগে থেকেই রবার্টের মৃত্যুদণ্ড চাইছিলেন, সেহেতু মামলা চলা কালে তিনি ভুল করেছিলেন।
এরপর হত্যা মামলার তৃতীয় শুনানি হয়। এবার সুপৃম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে এবং ২৩ এপৃল ১৯২০-এ এই দণ্ড কার্যকর করার ব্যবস্থা হয়। জেলখানায় ফাসির মঞ্চ বানানো হয় যেটা রবার্ট তার সেল থেকে দেখতে পারতেন।
রবার্টের মা আবার তৎপর হন। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন ও তার স্ত্রী ইডিথ উইলসনের কাছে প্রাণ ভিক্ষা করেন।
প্রেসিডেন্ট ফাসি মওকুফ করে দিয়ে রবার্টকে আজীবন জেলে রাখার নির্দেশ দেন। তবে প্রেসিডেন্টের এটর্নি জেনারেল আলেকজান্ডার মিচেল পার্মার নির্দেশ দেন রবার্টকে আজীবন সলিটারি সেলে একা রাখতে হবে।
এভাবে শুরু হয় লিভেনওয়ার্থ জেলে রবার্ট স্ট্রাউডের নির্জন কারাবাস।
যেভাবে পাখি বিজ্ঞানী হলেন
বছর চারেক পরে ১৯২০-এ একদিন রবার্ট জেল প্রাঙ্গণে একটি নীড়ে তিনটি আহত চড়ই পাখি পান। রবার্ট তাদের সুস্থ করে তোলেন। পাশাপাশি তিনি আরো পাখি কেনা শুরু করেন। তখন ওই জেলে ক্যানারি (ছোট হলুদ রঙের পাখি) কেনার অনুমতি বন্দিদের দেওয়া হতো।
জেলখানায় থেকে এসব পাখি পুষে এবং তাদের বিক্রি করে সেই টাকায় তিনি তার বৃদ্ধ মাকে সাহায্য করতেন।
এরপর লিভেনওয়ার্থ জেল কর্তৃপক্ষ বদলি হয়ে গেলে নতুন ওয়ার্ডেন বেনেট স্থির করেন সেখানে বন্দিদের প্রগতিশীলভাবে পুনর্বাসিত করতে হবে। এই নতুন কর্মসূচির আওতায় বেনেট জেলখানায় খাচা, কেমিকালস ও স্টেশনারি কিনে দেন রবার্টকে। রবার্ট একটি বড় এভিয়ারি (Aviary, পাখির খাচা যেখানে অনেক রকমের পাখি থাকতে পারে, উড়তেও পারে) তৈরি করেন। জেলখানায় ভিজিটররা এলে তারা ওই এভিয়ারি দেখতেন। রবার্টের কাছ থেকে ক্যানারি কিনতেন।
রবার্ট প্রায় ৩০০ ক্যানারি সেখানে পেলেছিলেন। ক্যানারিদের অসুখ বিসুখ বিষয়ে ৬০,০০০ শব্দ বিশিষ্ট দুটি বই, ডিজিজেস অফ ক্যানারিজ (Diseases of Canaries, ১৯৩৩) বই লিখেছিলেন। এই বই দুটির পাণ্ডুলিপি জেল থেকে চোরাপথে বাইরে চালান করা হয় এবং প্রকাশিত হয়। দুটি বই-ই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। ১৯৪৩-এ একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। পাখি যারা ভালোবাসেন তাদের সম্মান ও সহানুভূতি পান রবার্ট স্ট্রাউড। কালক্রমে তিনি পরিচিত হন অরিনথলজিস্ট (Orinthologist) বা পাখিবিজ্ঞানী রূপে।
রবার্টের এই সুনাম ও সাফল্য জেল কর্তৃপক্ষের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। যেসব চিঠি রবার্ট লিখতেন জেল কোড অনুযায়ী তা পড়তে হতো, হাতে কপি করতে হতো (তখন ফটোকপিয়ার ছিল না) এবং অনুমোদিত করতে হতো। রবার্টের পাখি ব্যবসা এত বেড়ে গিয়েছিল যে তার জন্য একটা ফুলটাইম সেক্রেটারি নিয়োগ করতে হয়েছিল। আরেকটা সমস্যা হয়েছিল পাখিদের মল সাফ করতে। রবার্টের সেলে পাখিদের ওড়ার অনুমতি ছিল। তাই রবার্ট তার নির্জন সেলে অনেক পাখি রাখতেন। কিন্তু তাদের মল নিয়মিত পরিষ্কার করাটা ছিল সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ।
১৯৩১-এ জেল কর্তৃপক্ষ স্থির করেন রবার্টের এই ব্যবসা বন্ধ করতে হবে এবং জেলখানা থেকে পাখিদের সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু ইনডিয়ানা-র ডেলা মে জোন্স নামে এক নারী পাখি গবেষক বিষয়টি পত্রপত্রিকায় ফাস করে দিলে সারা আমেরিকা জুড়ে প্রতিবাদ ওঠে। চিঠিপত্রের ক্যামপেইন শুরু হয়ে যায়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ৫০,০০০ স্বাক্ষর সংবলিত নাগরিকদের চিঠি যায় প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার-এর কাছে।
গণচাপে প্রেসিডেন্ট হুভার অনুমতি দেন রবার্টকে পাখি পুষতে। শুধু তাই নয়, রবার্টকে একটি অতিরিক্ত সেল দেওয়া হয় বেশি পাখি রাখতে। তবে রবার্টের চিঠি লেখার সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে ডেলা মে জোন্স জেলে আরো কয়েকবার দেখা করেন রবার্টের সঙ্গে। ডেলা ইনডিয়ানা ছেড়ে কানসাসে থাকা শুরু করেন। তিনি আর রবার্ট পার্টনারশিপে বিজনেস আরম্ভ করেন। তারা পাখি, পাখি বিষয়ে বই এবং পাখির ওষুধপথ্য বিক্রি করতেন।
রবার্টের এসব কাজকর্ম এবং বহির্জগতে তার খ্যাতি বিস্তৃত হওয়ায় জেল কর্তৃপক্ষ বিরক্ত বোধ করেন। তারা লিভেনওয়ার্থ থেকে রবার্টকে অন্যত্র বদলির চেষ্টা শুরু করেন।
ইতিমধ্যে রবার্ট তার পড়াশোনায় জেনেছিলেন, কানসাসে কোনো জেলবন্দি যদি বিবাহিত থাকেন তাহলে তাকে অন্যত্র বদলি করা যায় না। তিনি তখন প্রক্সিতে ডেলা জোন্সকে বিয়ে করেন।
এতে জেল কর্তৃপক্ষ ক্ষেপে যান। তারা ডেলার সঙ্গে রবার্টের চিঠি বিনিময় বন্ধ করে দেন।
শুধু জেল কর্তৃপক্ষই নন- রবার্টের মা, অ্যান-ও এই বিয়েতে চটে যান। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীরা রবার্টের জীবনে বিপদ ডেকে আনে। সুতরাং তার ছেলের বিয়ে করা উচিত নয়। অ্যান, যিনি এত দিন চেষ্টা করেছিলেন পেরলে রবার্টের মুক্তির জন্য, তিনি তখন পেরলের বিরুদ্ধে বলেন এবং শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তিনি আর কোনো যোগাযোগ রাখেন নি ছেলের সঙ্গে এবং ১৯৩৭-এ মারা যান।
১৯৩৩-এ রবার্ট পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনে জানান যে ডিজিজেস অফ ক্যানারিজ (Diseases of Canaries, ক্যানারিজ পাখির অসুখ) বইয়ের কোনো রয়ালটি তিনি পান নি। বইটির প্রকাশক এর শোধ নেওয়ার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের কাছে রবার্টের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করেন।
এমন একটা নালিশের অপেক্ষায় ছিলেন লিভেনওয়ার্থ জেল কর্তৃপক্ষ। তারা রবার্টকে আলকাতরাজ (Alcatraz) জেলে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন, যেখানে পাখি পালন ছিল নিষিদ্ধ। তারপরেও রবার্টকে বদলি করা সম্ভব হচ্ছিল না কারণ তিনি সেই সময়ে জেলের সব নিয়মকানুন মেনে চলছিলেন।
সেটাই ভেবেছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ।
হঠাৎ একদিন রবার্ট ধরা পড়ে যান নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে। প্রমাণিত হয় যে পাখির ওষুধ বানানোর ল্যাবরেটরিতে রবার্ট চোলাই মদও তৈরি করছিলেন। অবশেষে লিভেনওয়ার্থ জেল কর্তৃপক্ষ বিদায় করতে পারেন রবার্টকে।
কুখ্যাত আলকাতরাজ দ্বীপে
ক্যালিফোর্নিয়ায় সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরে আলকাতরাজ দ্বীপে আলকাতরাজ ফেডারাল জেলখানাটি ছিল। সান ফ্রান্সিসকো শহর থেকে দেড় মাইল দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটি দেখা যায় বিখ্যাত গোলডেন গেইট বৃজ থেকে। অতীতে ইনডিয়াতে দণ্ডপ্রাপ্ত ভয়ংকর অপরাধীদের যেমন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, ঠিক তেমনই আমেরিকাতে দণ্ডিত ডেনজারাস কৃমিনালদের আলকাতরাজ দ্বীপে রাখা হতো ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত।
আমেরিকার আদিবাসীরা ২২ একরের এই দ্বীপটিকে বলতো ইভিল আইল্যান্ড বা খারাপ দ্বীপ। ২৯ বছরে এই দ্বীপের জেলখানা থেকে মোট ৩৬ বন্দি পালানোর চেষ্টা করেছিল। এদের মধ্যে ২৩ জন ধরা পড়েছিল। ৬ জন পালানোর সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। ২ জন ডুবে মারা গিয়েছিল। আর বাকি ৫ জন নিখোজ হয়ে যায়। জেল কর্তৃপক্ষ দাবি করেন তারা ডুবে মারা গিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন তারা কোনো রকমে সান ফ্রান্সিসকোর তীরে পৌছে বাদবাকি জীবন গোপনে কাটিয়ে দিয়েছিল।
আমি ১৯৮৩-তে সান ফ্রান্সিসকোতে টুরের সময়ে এই কুখ্যাত আলকাতরাজ দ্বীপটি দেখেছিলাম। এখন এই দ্বীপটি হয়েছে একটি বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট।
১৯ ডিসেম্বর ১৯৪২-এ রবার্ট স্ট্রাউডকে ট্রান্সফার করা হয় আলকাতরাজ জেলে। ট্রান্সফারের আগে রবার্টকে বলা হয়নি যে তাকে লিভেনওয়ার্থ এবং পাখিদের ছেড়ে যেতে হবে। মাত্র দশ মিনিট সময় রবার্টকে দেওয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে তিনি তার সব পাখি ও যন্ত্রপাতি তার ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
আলকাতরাজের কড়া নিয়মে প্রথমে ছয় বছর রবার্টকে থাকতে হয় নির্জনে - পাখি ছাড়া।
এরপর তাকে আলকাতরাজের হসপিটাল বিভাগে বন্দি রাখা হয়।
১৯৪৩-এ সাইকিয়াটৃস্ট রমনি রিচি তাকে একজন সাইকোপ্যাথ রূপে চিহ্নিত করেন, যে হঠাৎ সহিংস হতে পারে কিন্তু যার আইকিউ খুব বেশি- ১৩৪!
আলকাতরাজে পাখি পালনে অনুমতি না পেলেও রবার্ট বই লেখার অনুমতি পেয়েছিলেন। সেখানে তিনি দুটি বই লেখেন। একটি তার আত্মজীবনী এবং অপরটি আমেরিকার জেল সিসটেমের ওপর। আলকাতরাজ কর্তৃপক্ষ শংকিত হন রবার্টের এই নতুন কর্মকাণ্ডে। তারা ভয় পান রবার্ট আবারও বহির্বিশ্বে তার প্রভাব বিস্তার করবেন বইয়ের মাধ্যমে। তারা বই দুটির প্রকাশনার বিরোধিতা করেন। একটি মামলা হয়। বিচারক রায় দেন রবার্ট বই লিখতে পারবেন এবং পান্ডুলিপি রাখতে পারবেন, কিন্তু প্রকাশ করতে পারবেন না। রবার্ট স্ট্রাউডের মৃত্যুর পরে তার উকিল, রিচার্ড ইংলিশকে বই দুটির পান্ডুলিপি দেওয়া হয়।
শেষ ৪২ বছর সলিটারি কনফাইনমেন্টে
আলকাতরাজে ১৭ বছর থাকার সময়ে রবার্টকে জেল লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। মাঝে মধ্যে এক গার্ডের সঙ্গে তাকে দাবা খেলার অনুমতি দেওয়া হতো।
আইন পড়াশোনার পরে রবার্ট তার মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে থাকেন। তিনি যুক্তি দেন তার দীর্ঘ এবং নির্জন কারাবাস নিষ্ঠুর ও ব্যতিক্রমী শাস্তি। ১৯৫৯-এ তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তাকে স্পৃংফিল্ড, মিসৌরিতে মেডিকাল সেন্টার ফর ফেডারাল পৃজনার্স-এ ট্রান্সফার করা হয়। ২১ নভেম্বর ১৯৬৩-তে তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩।
জীবনের শেষ ৫৪ বছর রবার্ট স্ট্রাউস জেলবন্দি ছিলেন যার মধ্যে ৪২ বছর ছিলেন নির্জনে- সলিটারি কনফাইনমেন্টে। জীবনের শেষ দিকে তিনি ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখা শুরু করেছিলেন।
আমেরিকান ইতিহাসে রবার্ট স্ট্রাউডকে ভয়ংকর কৃমিনালদের অন্যতম রূপে গণ্য করা হয়। তার মেধা ও বুদ্ধি অসাধারণ ছিল এবং তিনি জেলে থেকেই হয়েছিলেন একজন প্রথম শ্রেণীর পাখিবিজ্ঞানী ও লেখক। কিন্তু রেগে গেলে তিনি হতে পারতেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। তাকে জেল কর্তৃপক্ষ এবং জেলের সহবন্দিরা অপছন্দ ও অবিশ্বাস করতেন।
তবে জীবনের শেষ দিকে কেউ কেউ তাকে সুনজরে দেখেছিলেন। বিচারক বেকার মনে করেন বয়োবৃদ্ধ রবার্ট সমাজের জন্য বিপজ্জনক ছিলেন না এবং তার পাখিপ্রীতি ছিল আন্তরিক। তিনি যে দুটি হত্যাকা-ের জন্য আজীবন শাস্তি ভোগ করেন সেই দুটির স্পষ্ট কারণ ছিল। দুটি ক্ষেত্রেই তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে আঘাত করেছিলেন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, রবার্ট স্ট্রাউড হয়েছিলেন পাখি বিষয়ে স্বশিক্ষিত বৃলিয়ান্ট এক্সপার্ট এবং আমেরিকান জেলখানায় আত্ম উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
অরিনথলজিতে অবদানের জন্য হাজার হাজার পাখি পালক ও পোলটৃ (হাস-মুরগি) ব্যবসায়ীদের কাছে রবার্ট খুব প্রিয় হয়েছিলেন। তাকে জেলমুক্ত করার জন্য ‘কমিটি টু রিলিজ রবার্ট স্ট্রাউড’ নামে একটি সংগঠন তারা করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু, রবার্ট একজন ফেডারাল পুলিশ অফিসারকে খুন করেছিলেন সেহেতু তার সলিটারি কনফাইনমেন্ট বলবৎ থাকে।
১৯৬৩-তে রবার্টের তরুণ উকিল রিচার্ড ইংলিশ দেখা করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সঙ্গে। কিন্তু এ বিষয়ে কিছু করতে রাজি হন না ট্রুম্যান। নাছোড়বান্দা রিচার্ড ইংলিশ পরবর্তীকালে কেনেডি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তারাও কিছু করেন না। রবার্ট তার সব ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং অরিজিনাল পান্ডুলিপিগুলো রিচার্ড ইংলিশকে দান করে যান।
১৯৫৫-তে টমাস ই গ্যাডিস, বার্ডম্যান অফ আলকাতরাজ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে জেলবন্দিদের পুনর্বাসন বিষয়ে তিনি লেখেন এবং এতে রবার্টের বিষয়ে সহানুভূতি দেখান। ১৯৬২-তে এই বইয়ের ভিত্তিতে একই নামে মুভি নির্মাণে এগিয়ে আসেন ডিরেক্টর জন ফ্র্যাংকেনহাইমার। এতে রবার্টের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন বার্ট ল্যাংকাস্টার এবং সেরা অভিনেতার অস্কার প্রাইজের জন্য মনোনীত হন।
শুটিংয়ের সময়ে বার্ট ল্যাংকাস্টার আলকাতরাজে গিয়ে রবার্টের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, রবার্ট সমকামী, এই গুজব সত্যি কি না।
রবার্ট উত্তর দিয়েছিলেন, জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি নির্জন সেলে থেকেছেন। সমকামী হবেন কিভাবে? তা ছাড়া, বয়স এখন বাহাত্তর। সমকামী হলেও সমাজের জন্য তিনি কতোখানি বিপজ্জনক হবেন?
রবার্ট স্ট্রাউড বেচে থাকতেই মুভিটি রিলিজড হয়েছিল। কিন্তু তাকে সেই মুভি দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর পরে তার জীবনী নির্ভর ১৯৮০-তে আলকাতরাজ : দি হোল শকিং স্টোরি (Alcatraz : The Whole Shocking Story) নামে এবং সিক্স এগেইনস্ট দি রক (Six Against the Rock) নামে টিভি মুভি হয়। রবার্ট স্ট্রাউডের নামে গান ও ভিডিও গেমস আছে।
রবার্ট স্ট্রাউডকে যদি ১৯২০-এ ফাসি দেওয়া হতো, তাহলে পাখিপালকরা এবং পাখিরা উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত হতো।
(চলবে)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন