
এমনিতেই উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির চাপে হাঁসফাঁস দশায় স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। এর মধ্যে চালের পেছনে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ভালো উৎপাদন ও আমদানির অনুমতির পরেও দাম কমছে না। গত এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধানে কারণ ছাড়াই কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়ে মধ্যবিত্তের সরু চাল ৮০ টাকা ও মাঝারি চাল ৬২ টাকা ছাড়িয়েছে। মোটা চালের কেজিতেও অন্তত ৪ টাকা বেড়েছে। এতে নিম্নবিত্তের খরচের চাপ অনেকখানি বেড়ে গেছে। বেড়েছে হতাশাও।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারে গতকাল চাল কিনতে এসে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. ওসমান আলীর বেজায় আক্ষেপ। মাস দেড়েক আগে যে মিনিকেট কেজিপ্রতি ৭২-৭৪ টাকায় কিনতে পেরেছেন, এখন সেখানে গুনতে হচ্ছে ৮০ টাকা। এক লাফে প্রতি কেজিতে ৬ থেকে ৮ টাকা বেড়ে যাওয়ায় বেশ চাপে রয়েছেন বলে জানান তিনি। বলেন, চালের দাম এভাবে বেড়ে গেলে সংসার চলবে কীভাবে? মিনিকেট এখন ৮০ টাকার নিচে নেই। মাঝারি আটাশ চালের কেজিও ৬৪-৬৫ টাকা। আগে যা ৫৮-৬০ টাকা ছিল।
মালিবাগ বাজারের গাজী স্টোরের খুচরা বিক্রেতা রুবেল হোসেন জানান, মিলগেটে দাম বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের চালের দামই এখন চড়া। আগে যে মিনিকেট ৭৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি চালের দামও একইভাবে বেড়েছে।
পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধানে রাজধানীর আড়তগুলোয় সরু চালের বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, মাঝারি চালের বস্তায় ১০০ থেকে ২০০
টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। মোটা চালের বস্তায়ও একই হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশে সাধারণত আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও চালের দরে স্বস্তি ফিরছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি দাম ও দেশে ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। তাই সেভাবে চাল আসছে না। এর সুযোগ নিচ্ছে দেশীয় মিলগুলো।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার পর্যবেক্ষণের তথ্যও বলছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি সরু চালে প্রায় ৫ শতাংশ, মাঝারি চালে ৫ শতাংশ এবং মোটা চালে ৬.৬৭ শতাংশ দাম বেড়েছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে গতকাল রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সরু চাল ৭০ থেকে ৮৫ টাকা, মাঝারি চাল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং মোটা চালের কেজি ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত মাসে যা যথাক্রমে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা, ৫৬ থেকে ৮৩ টাকা এবং ৫০ থেকে ৫৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। টিসিবির হিসাবে গত বছর এই সময়ের তুলনায় এখন চালের মূল্যবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১৩.১৪ শতাংশ, ১৫.৭৪ শতাংশ এবং ৯.৮০ শতাংশ।
ঠিক কী কারণে দাম বেড়েছে জানতে চাইলে মিল মালিকরা দাবি করছেন, আমন ধানের উৎপাদন কম। ধানের দামও বেশি। এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আবু ইউসূফ বাচ্চু বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে ধানের দামও বাড়তি। এর প্রভাব পড়েছে চালের দামেও।
কিন্তু বাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আমনের মৌসুমে চালের দাম এতটা বৃদ্ধি মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। আসলে মিল মালিকরা নানা অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ানবাজারের একাধিক পাইকারি বিক্রেতা বলেন, বছরের এমন সময় এভাবে দাম বাড়ার যৌক্তিকতা নেই। মিল মালিকরা ধানের বাড়তি দামের কথা বললেও প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, বড় বড় মিল মালিকরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে নজর রাখেন। যখন তারা দেখেন দেশে কোনো অজুহাত পাওয়া গিয়েছে আর বিদেশে দাম বেশি, আমদানির সুযোগ নেই, তখন ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই চলে। মিলগুলোর খরচ কত, মজুদ কত, বিক্রয় করছেন কত টাকায়- এসব খতিয়ে দেখলেই তথ্য বেরিয়ে আসবে। অথচ সরকার শুধু বাজারে অভিযান চালায়। তাতে মিল মালিকদের কিছু হয় না, ক্ষতি হয় খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের।
বাজার বিশ্লেষকরাও বলছেন, ধান-চালের বাজারে সরকারের নজরদারি নেই। অন্যান্য পণ্যের বাজারে যতটা তদারকি হয়, চালের বাজারে ততটা দেখা যায় না। আর নজরদারি-তদারকির ঘাটতির সুযোগ নেয় মিলগুলো। আবার আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সেটা সঠিক সময়ে নেওয়া হয় না।
ভরা মৌসুমে কমার বদলে দাম এভাবে বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক ও হতাশাজনক বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ভরা মৌসুমে এতটা দাম আগে বাড়েনি। মিল মালিকরা আমাদের বলছেন, করপোরেটরা বাজারে আসায় দাম বাড়ছে। ধানের দাম বাড়লে কৃষকরা উপকৃত হবেন। কিন্তু সরকারকে দেখতে হবে যে, মাঝ দিয়ে কারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে। দীর্ঘদিন ধরে চাল নিয়ে চালবাজি চলছে, কালো তালিকা হচ্ছে, এর পরও আগের মতোই চলছে।
তিনি আরও বলেন, ধান-চালের বাজারে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে। অসাধুরা এর সুযোগ নিচ্ছে। সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে হবে। মিলগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। মিলগুলোর খরচ কত, মজুদ কত, বিক্রি কত- এসবের বিশ্লেষণ দরকার।