|
রেজা ঘটক
|
|
ভিন্নচোখে ইতিহাস পাঠ: ভারত ভাগ !!!
14 August 2015, Friday
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ওই দিন 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে' পালন করে। কলকাতায় সেদিন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় কত লোক মারা গিয়েছিল? দশ হাজার? বিশ হাজার? পঞ্চাশ হাজার নাকি এক লাখ? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একসঙ্গে গোটা পৃথিবীতে এত মানুষ মারা যাবার আর কোনো রেকর্ড কী আছে? এতো লোক মরার পেছনে যারা নাটের গুরু, সেই জিন্নাহ ও নেহেরু'র কী মানবাধিকার আইনে কোনো বিচার হয়েছিল?
ইতিহাসের পাতা উল্টালে জিন্নাহ-নেহেরুকেও বড় ধরনের খুনি হিসেবেই চিন্থিত করা যায়। কিন্তু ইতিহাসের অন্যপিঠে তারা কিভাবে পরিচিতি পেল? একজন পাকিস্তানের জনক। আরেকজন ভারতের প্রথম ও এখন পর্যন্ত দীর্ঘসময়ের (১৭ বছর) প্রধানমন্ত্রী। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতির সেই ক্যাচাল লাগিয়ে বৃটিশরা নিরাপদে ক্ষমতা হস্তান্তর করেই পালিয়ে গেল। ভাইসরয় লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহ'র এই ক্ষমতার কাছেই পরাস্থ হয়ে সেদিন জিন্নাহকে পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল পদটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বৃটিশরা আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে এই পরাজয় স্বীকার না করে পাঞ্জাব ও বাঙলাকে ভাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এক স্থায়ী ধর্ম-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প রোপন করে দিয়ে যায়। যা থেকে এখনো এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তি মেলেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটেনের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলের সামনে তখন বৃটেনের অার্থিক সংকট কাটানো ছিল প্রধান এজেন্ডা। বৃটেনের বাণিজ্য ঘাটতি তখন ২.১ বিলিয়ন পাউন্ড। কেবলমাত্র ভারতের কাছেই তখন বৃটেনের দেনা ছিল ১.২৫ বিলিয়ন পাউন্ড। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে বৃটেনের তখন দেনা ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন পাউন্ড। বৃটেনের সামনে তখন এই দেনা পরিশোধের বদলে কমোনওয়েলথ ভুক্ত বৃটিশ দেশগুলোকে একে একে স্বাধীনতা দেওয়াটাই ছিল দেনা এড়ানোর একটা প্রধান কৌশল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৃটেন তখন একটি গোপন ঋণচুক্তি করেছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বৃটেনকে ৩.৭৫ বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ দেবে আর্থিক সংকট মোকাবেলা করার জন্য। শুধুমাত্র ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির পেছনে তখন বৃটেনের প্রতিদিন বিশাল একটা খরচ বহন করতে হচ্ছিল। ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে দিলে এই খরচটি আর করতে হবে না। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃটেন এমনিতেই ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে আর্থিক সংকট কাটানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। ধর্ম-ভিত্তিক দ্বিজাতী তত্ত্ব তাহলে কারা সৃষ্টি করেছিল? নেহেরু-জিন্নাহ বৃটিশদের সঙ্গে তাল দিয়েই এই তত্ত্ব বানিয়েছিলেন।
বৃটেনের সেই পরিকল্পনায় ঘোলাজলে মাছ শিকার করতে নামলেন জিন্নাহ ও নেহেরু। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে সবচেয়ে বড় যে জাতীয়তাবাদী নেতা সেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস জাপানের সঙ্গে হাত মেলানোর কারণে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির মিত্র হিসেবে জাপানের পরাজয়ের কারণে নেতাজী অটোমেটিক সিনআউট হয়ে পড়েন। সেই সুযোগটি ধুর্ত নেহেরু আর জিন্নাহ লুফে নেন। ধর্ম-ভিত্তিক দ্বিজাতী তত্ত্বের উৎপত্তি ঠিক এখানেই।
গোটা বিশ্বযুদ্ধে ভারতের যত মানুষ মারা গেছে, তারচেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি লোক মারা যায় ভারত ভাগের কারণে হিন্দু-মুসলিম-শিক দাঙ্গায়। গোটা পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশ এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিনত হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে বসতভিটা হারাতে হয়েছিল। বৃটিশরা ভারত ভাগ করে উপমহাদেশে একটি স্থায়ী অশান্তি সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে। ভারত ভাগের সময় যে পাঞ্জাব ও বাঙলাকে আলাদাভাবে ভাগ করা হবে, এই খবর র্যাডক্লিফ জানতেন না। তাই তিনি ম্যাপ ভাগ করার সময় কিছুটা আন্দাজের উপর নির্ভর করেছিলেন।
র্যাডক্লিফের এই না জানার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলেন ধুর্ত নেহেরু। কিভাবে? জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে তখন ল্যাডি ইদ্বিনা মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার বোন প্যাটরিসিয়াকে লেখা এক চিঠিতে নেহেরু ও ইদ্বিনার প্রেমের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। মাউন্টব্যাটেন বোনকে চিঠিতে লেখেন 'She (Edwina) and Jawaharlal (Nehru) are so sweet together, they really dote on each other.' নেহেরু ইদ্বিনার সঙ্গে এই প্রেমের সম্পর্কটি ইদ্বিনার মৃত্যু পর্যন্ত রেখেছিলেন।
নেহেরুর বোন বিজয়া লক্ষী ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বৃটেনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন। এই সময়ে নেহেরু প্রতিবছর বৃটেন ভ্রমণ করতেন এবং ইদ্বিনার সঙ্গে দেখা করতেন। ইদ্বিনাও প্রতিবছর ভারত ভ্রমণ করতেন। ১৯৬০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইদ্বিনা মাউন্টব্যাটেন ঘুমের মধ্যে মারা গেলে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০ সালে নেহেরু ভারত থেকে নৌবাহিনীর দুটি ডেস্ট্রয়ার জিউফরি ফিশার ও আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবেরি ইংল্যান্ড পাঠিয়েছিলেন।
ইদ্বিনা মাউন্টব্যাটেন ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে আলোচিত নারী, যিনি একাধিক পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা জো রাইট নেহেরু ও ইদ্বিনার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে একটি সিনেমা বানানো শুরু করেছিলেন। ফিল্মের নাম ইন্ডিয়ান সামার। যেখানে কেট ব্লানচেট ইদ্বিনার চরিত্রে, হগ গ্র্যান্ড লর্ড মাউন্টব্যাটেনের চরিত্রে ও ইরফান খান জওহরলাল নেহেরুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বিষয়টি নেহেরু টের পেয়ে জো রাইটের ফিল্মের স্ক্রিপ্ট দেখতে চান। নেহেরু ও ইদ্বিনার সম্পর্ক কিভাবে দেখানো হয়েছে, সেটাই ছিল নেহেরুর দেখার বিষয়। পরবর্তী সময়ে জো রাইট এই ফিল্মটি আর ভারত ও বৃটেনের প্রভাবশালী মহল থেকে অনুমোদনের অভাবে শেষ করতে পারেননি।
একদিকে বৃটিশ অাভিজাত্যের কলংক অন্যদিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত লাম্পট্যকে নির্মাতা জো রাইট 'ইন্ডিয়ান সামার' এর মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়কে উন্মোচন করার আর সুযোগ পাননি। সেখানেও ক্ষমতার জোরেই ইতিহাস চাপা দেওয়া হয়েছে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও ইদ্বিনার দুই কন্যা প্যাটরিসিয়া ও পামেলা নিজেদের মায়ের অনেক বিষয় তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। ইদ্বিনা অ্যাশলে ছিলেন তার সময়ের সেরা ছয় জন বিশ্ব সুন্দরীর একজন। সবচেয়ে দামি পোষাক পড়তেন, ব্রিজ খেলতেন, মধ্যরাত পর্যন্ত শপিং করতেন আর নাইট ক্লাবে ড্যান্স করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীরত্বসূচক মেডেল ম্যাট ও জেফ-এর নামানুসারে ইদ্বিনার ব্রেস্টকে তখন বলা হতো ম্যাট অ্যান্ড জেফ। ইদ্বিনার সার্বক্ষণিক সহচর ডিকির সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। এছাড়া ফ্রেড অ্যাশটায়ার, আমেরিকান বিখ্যাত প্লো প্লেয়ার ল্যাড্ডি স্টাফোর্ড, বৃটিশ সাংবাদিক মাইক ওয়ারডেল, আমেরিকান বিখ্যাত গলফ খেলোয়াড় ববি সুইনির সঙ্গে ইদ্বিনা অ্যাশলের বিভিন্ন সময়ে শারীরিক সম্পর্ক ছিল।
এছাড়া প্লেবয় ল্যারি গ্রে ও ম্যাক্সিকান দুই ভাই টেড ফিলিপস ও বেনি'র সঙ্গে ইদ্বিনার সম্পর্ক ছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজের ডায়েরিতে লিখেছেন, 'Edwina and I spent all our married lives getting into other people's beds.' ইদ্বিনা ও আমি আমাদের বিবাহিত জীবন অন্য মানুষের বিছানায় কাটিয়েছি।
ইদ্বিনা অ্যাশলে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে নেহেরুর সম্পর্কের কারণে ভারত ভাগের সময় জিন্নাহ'র চেয়ে নেহেরু বেশি সুবিধা পেয়েছিলেন। পাঞ্জাব ও বাঙলা ভাগের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য হয়েছে। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে নেহেরু মারা গেলে ডাক্তারি রিপোর্টে সরকারি ভাবে হার্ট অ্যাটাক দেখানো হলেও, এই বিষয়ে গুজব হল নেহেরু সেক্সচুয়াল ট্রান্সমিটেড ডিজিজ (এসটিডি) এ ভুগছিলেন। ইদ্বিনা অ্যাশলে ছাড়াও নেহেরুর সঙ্গে শ্রাদ্ধ মাতা পদ্মজা নাইডু'র সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।
নেহেরু বিয়ে করেছিলেন ১৯১৬ সালে কমলা কৌলকে। ১৭ নভেম্বর ১৯১৭ সালে তাদের একমাত্র কন্যা ইন্দিরার জন্ম। ১৯২৪ সালে নেহেরু-কমলার একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পর ছেলেটি মারা যায়।
ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে নেহেরু ইদ্বিনা অ্যাশলে মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মজার ব্যাপার হল, ইদ্বিনা যখন ঘুমের মধ্যে মারা যায় তার বিছানায় পাওয়া যায় নেহেরুর লেখা অনেকগুলো চিঠি। বৃটিশ সরকার সেই চিঠিগুলো পুড়িয়ে নষ্ট করে ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়কে চাপা দিয়েছে।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
শুরু করলেন এক প্রেক্ষাপটে, শেষ করলেন আরেক ভাবে!
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন