|
প্রামানিক
|
|
শ্রাবণের ভরা নদী এবং নৌকায় মামার বাড়ি
05 August 2015, Wednesday
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে পুরো এলাকা পানিতে সয়লাব। যমুনা নদী থেকে এখন নৌকা সরাসরি আমাদের বাড়ির সামনে এসে ভিড়ে।
এমনি অবস্থায় এক বিকালে আমার মামাতো ভাই ফকির আলী এবং শহর আলী পাল তোলা মাঝারী ধরনের একটি নৌকা নিয়ে হাজির। মা এবং বাবাকে নিতে এসেছে। আমার নানার ছোট বোন কিছু দিন আগে মারা গেছেন। তার চল্লিশা বা ফয়তা হবে। আমার নানারা দুই ভাই চার বোন। সবাই আগে মারা গেছেন। এই ননীই শুধু বেঁচে ছিলেন। নানী মাকে খুব আদর করতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও নানী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।
নানীর তিন মেয়ে এক ছেলে। ছেলের নাম আদম আলী। আদম আলী মামা নানীর একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় তাকে কখনই কোন ঝামেলার কাজ করতে হয় নাই। নানীর মৃত্যুর পর এত বড় অনুষ্ঠানের ঝামেলা সামাল দেয়ার জন্যই আমার বাবা মাকে তার প্রয়োজন। সেই কারণে নানীর চল্লিশার অনুষ্ঠানে আমার মা এবং বাবাকে নিতে ফকির ভাইকে পাঠিয়েছেন। ফকির ভাই আদম আলী মামার বড় বোনের ছেলে।
মা আগে থেকেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু শ্রাবনের ভরা নদীতে রাতে নৌকায় যেতে বাবা রাজী হলেন না। খুব ভোরে যাওয়ার জন্য ফকির ভাইকে নৌকাসহ আটকিয়ে রাখলেন।
চাঁদনী রাত। মাঝ রাতের কিছু পরেই বাবা সবাইকে ডেকে উঠালেন। মা আগেই তৈরী হয়েছিলেন। মা বাবার সাথে আমিও নৌকার যাত্রী হলাম। আমার বড় বোন আমাদের বাড়িতেই ছিল। তার একমাত্র ছেলে চার বছরের টুকুকে মা সাথে নিলেন। নাতীদের উপর নানীদের একটু আলাদা দরদ থাকে। কোথাও দাওয়াত খেতে গেলে নাতীদের সাথে নিতে ভুল করেন না। টুকু ঘুমে ছিল তারপরেও তাকে নেয়ার জন্য মা ব্যস্ত হলেন। অনেক ডাকাডাকি করেও ভাগ্নে টুকুর ঘুম ভাঙানো গেল না। ঘুমন্ত অবস্থায় টুকুকে কোলে নিয়ে মা নৌকায় উঠলেন। আমার অন্যান্য ভাই বোনেরা বাড়িতেই থেকে গেল। সবাই নৌকায় উঠার পর ফকির ভাই লগি ঠেলে নৌকা ছেড়ে দিল। কিছুদুর যাওয়ার পর বাবা ফকির ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ফকির আলী, পশ্চিমা বাতাস আছে, বাদাম তুইলা দাও, তাইলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাইবো”।
ফকির ভাই বাবার কথামত শহর আলীকে বাদাম তুলে দিতে বললেন। বাদামের দড়ি, কাছি, বাঁশ লাগানোই ছিল। শহর আলী পালের কাছি ধরে টান দিতেই কপিকলে ঘরঘর শব্দ করে বাদাম মাস্তুলের অগ্রভাগে উঠে ছড়িয়ে গেল। ফকির ভাই দক্ষ হাতে বাদামের কাছি ডানে বামে টেনে টেনে পালে হাওয়া লাগিয়ে হাল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। পালের টানে নৌকা তরতর করে দক্ষিণ পূর্বদিকে এগোতে লাগল। আমাদের বাড়ি থেকে মামার বাড়ি কমপক্ষে পাঁচ মাইল। স্রোতের অনুকুলে ভাল বাতাস থাকায় অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে অপর পাড়ে চরের ভিতর চলে এলাম।
পুরো চর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পথ সহজ হলো। পানি আর পানি। কোন ফসলী জমি চোখে পড়ে না। সব পানির নিচে। মাঝে মাঝে দু’একটি পাট ক্ষেত মাথা উঁচু করে জেগে আছে, তাও তলতল অবস্থা। কোনো কোনো পাট ক্ষেতে কচুরি পানা ঢুকে নষ্ট করে ফেলেছে। উঁচু চরেও এক বুক এক গলা পানি থাকায় সোজা দক্ষিণ পূর্ব দিকে নৌকা চলতে লাগল। পথের ঘোরপ্যাচ না থাকায় সূর্য উঠার অনেক আগেই আমরা মামার বাড়ি পৌঁছলাম। বাড়ির সামনের উঠানে মামা দাঁড়ানো ছিলেন। আমাদেরকে দেখে মহাখুশি। সারাদিনের ঝামেলার কথা চিন্তা করে তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। রাতে বাবা আসে নাই সেই চিন্তায় মামার যেন ঘুম হয় নাই। এতবড় অনুষ্ঠান কি ভাবে সামাল দিবে সেই চিন্তায় ছিলেন। ঝামেলা সামাল দেয়ার মত লোক পেয়ে গেলেন। বাবা নৌকা থেকে নেমেই ফজরের নামায পড়ে গরু, খাশি জবাই দিতে বললেন। জবাই করার জন্য মুন্সি উপস্থিত ছিল। জবাই করার পরপরই সবাই মিলেমিশে মাংস কেটে কুটে রান্নার জন্য তৈরী করে নিল। বাবার তত্বাবধানে সব কিছু হচ্ছে। মামা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র যোগান দিচ্ছেন। তার খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না।
বন্যার কারণে মামার বাড়ির চারদিকে একবুক একগলা পানি। বাড়ির সামনের উঠানটি অনেক বড়। দুপুরের আগেই রান্নার কাজ শেষ হলো। দুপুরে চারিদিক থেকে দাওয়াতের মানুষ নৌকাযোগে এসে বাড়ি ভরে গেল। বাড়ির চারদিকে অনেক নৌকা। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। বাড়ির চারদিকে অনেক নৌকা ঘিরে থাকায় মনে হলো এ যেন নৌকার সমারোহ।
চর এলাকা। সবার ঘরে ঘরে নৌকা। একমাত্র গরীব যারা তাদের নৌকা নেই। তবে তাদের কলাগাছের ভেলা আছে। তারা কলাগাছের ভেলায় চরে এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত করে। অনেকে কলাগাছের ভেলা নিয়ে এসেছে। ভরা বর্ষার কারণে লোক কিছুটা কম হয়েছে। তারপরেও হাজারের উপরে মানুষ খেয়ে গেল। বিকাল বেলা নিকটাত্মীয় ছাড়া সবাই চলে গেছে। খাওয়ার ঝামেলা অনেকটা কমে এসেছে। আসরের আজান দেয়ার পরপরই বাবা বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়া করছেন। আমি এবং মা যাওয়ার জন্য খুব একটা ইচ্ছুক ছিলাম না। কিন্তু বাবার কথা অমান্য করার সাহস আমাদের নেই। মামা মামী কোন ভাবেই আমাদের ছেড়ে দিতে রাজী নন। কিন্তু বাবা বর্ষাকাল, বাড়ির চারিদিকে পানি, চুরি-ডাকাতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এইসব নানা অজুহাত দেখিয়ে মামার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার অনুমতি নিয়ে নিলেন। আমাদের এই মুহুর্তে চলে যাওয়াটা অন্যান্য খালারাও খুশি মনে গ্রহণ করলেন না। তারা আমাদের উপর বেজাড় হলেন। কিন্তু তারা বেজাড় হলেও বাবা কেন যেন কারো কথাতেই থাকতে রাজী হলেন না। মা’র ইচ্ছা ছিল ভাই বোনদের সাথে সারা রাত গল্প গুজোব করে সময় কাটাবেন। এরকম অনুষ্ঠান ছাড়া নিকট আত্মীয়দের একত্র হওয়ার সুযোগ খুব একটা হয় না। বাবার তাড়াহুড়ার কারণে মা’র সে ইচ্ছা পুরণ হলো না।
(চলবে -----)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন