।অ।
গত ক’দিন ধরে গায়ে ফোস্কা ফেলানো রোদের টানা জোয়ার বইছে যেন। হালকা বাতাসে মক্কা স্যানিটারীর কোনায় কোনায় পৌঁছে যায় দেশজুড়ে কয়েকশ’ মানুষকে নাই করে দেয়া বিশ্রী গরমটা। আক্কেল মিয়া দোকানে বসে বাসি খবরের কাগজের পাতা উল্টায়। পুরান খবর পাঠে বা পুনঃপাঠে তার অরুচি তো নেই-ই বরং এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
চান্দি-ফাটা গরমে লোকজন ঘর থেকে বের হয় না। সকাল থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা অবধি মাত্র তিনজন কাস্টোমার এসেছে। দোকানের ক্যাশবাক্সেও তাই লক্ষ্মীর আনাগোনা কম। ঘামে চটচটে, আঠালো শরীর নিয়ে আক্কেল মিয়া বসে বসে তাই পুরান খবরের কাগজ পড়ে। পরনে ঢোলা হাফ সার্ট, প্যান্ট, মুখে তিনদিন আগে শেইভ করার নজির। পাশের তোফাজ্জলের লাইট-ফ্যানের দোকানের সামনে রাখা স্ট্যান্ডফ্যানগুলো থেকে একটা নিয়ে দোকানের দিকে তাক করে ছেড়ে দিয়েছে সে। তাতেই কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেছে, এই গরমে সিলিং ফ্যানে কাজ হয় না। মাঝে মাঝে চোখ তুলে রাস্তার ওধারে দেখে আক্কেল মিয়া, একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
।আ।
জহিরুদ্দিন শিকদার সরকারি চাকুরে ছিলেন – বড় নয়, ছোটখাট – এখন অবসরে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে দেশ গড়তে ব্যর্থ যে প্রজন্ম দেশের বারোটা বাজিয়েছে অথচ নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে, সেই বুক ফুলিয়ে চলা দলের তিনিও একজন ‘সদস্যপ্রায়’। ‘প্রায়’ একারণে যে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি, দল-টল করেননি, উপরন্তু আখেরও গুছাননি। আজকাল তাই অফুরন্ত অবসরে প্রায়ই যখন জীবন নিয়ে ভাবেন, হিসাব কষতে থাকেন, হিসাবের খাতার পাতায় পাতায় দীর্ঘশ্বাসগুলো জমা হতে থাকে স্তূপাকারে। তারই দু’একটা বেরিয়ে এসে সাবেক সৎ ও দক্ষ সরকারি চাকুরে এবং সনদহীন মুক্তিযোদ্ধা জহিরুদ্দিন শিকদারকে ব্যর্থ বানিয়ে দেয় – বিশেষ করে বাবা, স্বামী ও পরিবার-প্রধান হিসেবে। ব্যর্থ জহিরুদ্দিন মাথা নিচু করে পেনশন এবং গ্লানি ভরা ‘সন্তানের টাকা’ নিয়ে বাজার করতে আসেন। চড়া বাজার তাকে আরো ছোট করে দেয়।
পরাজিত, ব্যর্থ, অসহায়, সৎ, সনদহীন মুক্তিযোদ্ধা এবং ‘বাজারের চাপে’ ক্ষুদ্রতর জহিরুদ্দিন শিকদারের শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছে না। আসলে ভালো যাচ্ছে না ক’দিন ধরেই, কিন্তু বলা হয়নি কাউকে। স্ত্রীরা ব্যর্থ স্বামীর কথা শুনতে কোন উৎসাহ বোধ করেননা, সন্তানরা আখের গুছাতে ব্যর্থ বাবার দিকে তাকানোর সময় পায়না আর সমাজে এরকমের এত বিশেষণধারীদের কোন বন্ধুও থাকেনা। জহিরুদ্দিন শিকদার এতটাই নীরবে চলেন যেন তার কোন নাম নেই, অস্তিত্ব নেই, বলবার মতো কোন পরিচয় নেই। নামহারা, অস্তিত্বহারা, স্বীকৃতিহারা, দামহারা এবং নিজের ভেতর গুটিয়ে যাওয়া সবহারা জহিরুদ্দিন শিকদারের জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া আর কিছু তাই অবশিষ্ট থাকেনা, সেটাও আবার লেমিনেটিং করা, জায়গায় জায়গায় উঠে যাওয়া।
বাজারটা বোধ হয় আজকে বেশি করা হয়ে গেছে, নিতে কষ্ট হচ্ছে। রিক্সার বিলাসিতা তার চলেনা, দরাদরি করে দাম যা কমিয়েছেন সেটা উপে যায়। দোকানগুলোর পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছেন যাতে কিছুটা ছায়া পাওয়া যায়। চলার বেগ ধীর, দরদর করে ঘাম ঝরছে। একটা দোকানের সামনে দেখলেন স্ট্যান্ডফ্যান ছাড়া আছে, প্রচন্ড বাতাস। ভেতরে দোকানী ছাড়া আর কেউ নেই, একটা ফাঁকা চেয়ার আছে।
‘বাবা একটু বসি?’
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে আক্কেল মিয়া। জবাব দেয় না, আবার কাগজে নজর দেয়। তবে এর মাঝে ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় যে বুড়োর বসা না বসায় তার কিছু এসে যায় না। দোকানের ভেতরে ঢুকে চেয়ারের পাশে বাজারের ব্যাগ ঠেস দিয়ে রেখে ধপাস করে বসে পড়েন তিনি, যেন শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ফ্যানের বাতাসে একটু আরাম লাগছে।
‘কী লেখছে পেপারে?’
‘আজকার না, পুরান পেপার’ কাগজ থেকে মুখ না তুলে জবাব দেয় আক্কেল মিয়া।
‘আজকারটা নাই?’
‘নাহ্, সপ্তায় একদিন পেপার কিনি। সারা সপ্তা ওইডাই পড়ি। ডেলি ডেলি কি কিছু ঘটে? হুদাই ডেলি পেপার কিইন্না পয়সা নষ্ট’
‘তা ঠিক, কিছু তো বদলায় না। ঘুইরা ফিরা একই খবর। দুনিয়া মনে হয় থাইমা আছে’ যেন নিজের সাথে কথা বলেন তিনি।
।ই।
আধঘন্টা হয়ে গেছে বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে টুকটুক। রন্তুর ওকে তুলে নেবার কথা, বাইকে এসে, সেই বারোটায়। এখনো দেখা নেই লাটসাহেবের। আসুক আজকে! ফোন দেয়, ‘কই তুমি!......এতক্ষণ লাগে আসতে!......বারোটা থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমি এই গরমের মধ্যে......দশ মিনিট?......দশ মিনিটের মধ্যে যদি তুমি না আসছো!’ দাঁত কিড়মিড় করে ফোন রেখে দেয়। একটু পায়চারী করে। গরমে সারা গা জ্বলে যাচ্ছে যেন। কালকেই স্কিন ট্রিটমেন্ট করিয়েছে। স্কিনের ভালোই ন্যাচারাল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে! পায়চারী করতে গিয়েই খেয়াল করলো একটা দোকানে স্ট্যান্ডফ্যানের বাতাসে গা এলিয়ে বসে আছে এক লোক, আরেকজন পেপার পড়ছে। টুকটুক এগিয়ে যায়। তা দেখে আক্কেল মিয়া একটু নড়েচড়ে বসে। ফ্যানের কাছে দাঁড়াতেই জোর বাতাসে টুকটুকের পোশাক এলোমেলো হয়ে যায়। তাই সে একটু ভেতরের দিকে দাঁড়ায়। আক্কেল মিয়ার চোখ এড়ায় না। খবরের কাগজ পড়াটা বাহানা হয়ে যায়, ফাঁকে ফাঁকে তাকে দেখতে থাকে। টুকটুক মোবাইলে ফেসবুকিং করছে। পাঁচ হাজার ফ্রেন্ড আর সাড়ে সাত হাজার ফলোয়ার তার। কার সাথে যেন চ্যাট করছে। কী একটা মেসেজে নিঃশব্দে হেসে উঠে, মাথা ঝাঁকিয়ে। আক্কেল মিয়ার চোখ সরতে চায়না। পুরনো খবরের কাগজটা নীরস থেকে একেবারে শুষ্ক হয়ে যায়।
তিনিও টুকটুকের দিকে তাকালেন, মেয়েটা তার আর ফ্যানের মাঝে এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে গায়ে বাতাস আর আগের মতো লাগছেনা। একটু বিরক্ত হলেন। টুকটুক হঠাৎই খেয়াল করলো তিনি তার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই তিনি হাতে ইশারায় বললেন মেয়েটাকে একটু সরে দাঁড়াতে। টুকটুক সরে দাঁড়ায়।
।ঈ।
‘কাল রাতে চাঁদ দেখেছিস?’
‘না। কেন, চন্দ্রগ্রহণ ছিলো?’ মমতাজের উৎসাহী প্রশ্নের জবাবে উল্টো প্রশ্ন করে জুবায়ের। ওরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছে। দুটো ক্লাস ছিলো, তার একটা প্রফেসর ক্যান্সেল করে দিয়েছে। তাই আজ তাড়াতাড়ি ফেরা। মূল সড়ক থেকে বেশ ভেতরে একটা মেসে থাকে ওরা দুজন। এই পথটা হেঁটেই যায়, রিক্সার টাকাটা বাঁচে। আজো যাচ্ছিলো, গরমে পুড়ে, কথা বলতে বলতে। মক্কা স্যানিটারীর বারান্দায় ফ্যানটা দেখে ওরা এগিয়ে যায়। তখনই প্রশ্নটা করেছে মমতাজ।
‘আরে না, ভয়াবহ লাল রঙের একটা চাঁদ দেখলাম’
‘চাঁদের কালার লাল হবে কেন, হলুদ বা কমলা হতে পারে। হতে পারে কমলাকেই তোর কাছে লাল লেগেছে’
‘আমি তো একবার সবুজ চাঁদও দেখেছিলাম।’
‘ব্লু মুন শুনেছি, গ্রীন মুন শুনিনি। কী আজব কথা যে তুই বলিস না!’
‘তুই বিশ্বাস করিস না?’ মমতাজের প্রশ্ন তার নিজের দৃঢ় বিশ্বাসকে প্রকাশ করে।
‘তোকে বিশ্বাস করার কোন কারণ আছে!’
‘কেন?’
‘তুই বললি তুই দেখছিস গাছ সেজদা করতেছে। ওইদিন ঝড় হইতেছিলো। বাতাসের টানা চাপে গাছ একদিকে ঝুঁকে ছিলো’
‘সব আল্লাহ্র কেরামতি, তুই বিশ্বাস করোস না?’ বিস্ফোরিত চোখ তাকায় মমতাজ।
‘যেগুলো ব্যাখ্যা করা সেগুলো কেরামতি হবে কেন! যেগুলো করা যায় না, সেগুলো হতে পারে’
‘এই যে দেখ এই কয়দিন যে ঠা ঠা গরম পড়ছে তোর কি মনে হয় না যে এইটা পাপের ফল?’
‘পাপের ফল কিনা জানিনা, আবহাওয়া অফিস পনেরোদিন আগেই ফোরকাস্ট করছিলো......আর পাপ কি খালি আমরাই করি, আম্রিকানরা করেনা? ন্যাচারাল ডিজাস্টার আমাদের এত বেশি হয় কেন?’
‘আল্লাহ্ পরীক্ষা নেয়’
‘দোস্ত কোনটা পরীক্ষা, কোনটা পাপের ফল এটা বুঝস কেমনে? যেটা পরীক্ষা, সেটা তো আর ফল হইতে পারেনা’
‘বুঝার দরকার কি, আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখলেই তো হয়’
‘আল্লা নিজেই তো চেষ্টা করতে বলছে। খালি ভরসা করতে বলে নাই। তুই দেখ বারো-তেরো শতকে মুসলমানদের কী দাপট ছিলো – জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য বীর্যে, অন্যরা ছিলো অন্ধকারে, আর এখন অন্যরা আমাদের পথ দেখায়।’ কথার ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে দু’জনই টুকটুককে দেখে।
‘মুসলমানরা আল্লার পথ থেকে সরে গেছে বলেই এই দুর্দশা’
‘তা আমি মানি। কিন্তু তুই যেমন বলিস সেভাবে আমরা অন্যদের ধরতে পারবোনা, পেছনে ফেলা তো দূরের কথা’
‘তো কিভাবে সম্ভব?’ কপাল কুঁচকে জানতে চায় মমতাজ।
‘সেটাইতো সমস্যা। সবাই মিলে একটা পথ বের করতে হবে। কিন্তু একসঙ্গে বসা, আলোচনা, তর্ক, বিতর্ক এসব আমাদের মধ্যে নাই। আছে শুধু ভাগ আর ফ্যাসাদ।’
এদের কথাবার্তায় প্রচন্ড বিরক্ত হলেন তিনি। ‘কাজকর্ম নাই, খালি কথা! এত বড় বড় বোল কপচাচ্ছো, আর এই বুড়ো লোকটার গায়ে আসা বাতাসটা বন্ধ করে যে দাঁড়িয়ে আছো সেটা তোমাদের মাথায় ঢুকছে না!’ মনে মনে বললেন। মুখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ভাবলেন একটু পর উঠে যাবেন। তখনই বোধ করলেন কেমন জানি লাগছে। একটু বুঝার চেষ্টা করলেন। বাম বুকে ব্যথা হচ্ছে।
।উ।
জাহিদ আর রোমিন দুই বন্ধু, হোটেলে লাঞ্চ সেরে ফিরছিলো ব্রোকারেইজ হাউজে। শেয়ার বাজারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। বেশিরভাগের মতো ধরা খায়নি সাম্প্রতিক ধসে কারণ তারা সেই গুটিকয়েক লোকের দলে যারা গুজব ছড়ায়, কানে নেয় না। সেই ‘সোনালী সময়’-এ আট লাখ টাকা নিয়ে নেমেছিলো, এখন কোটিপতি। তাদের কথা হচ্ছিলো বাজার নিয়েই, আর কিছুতেই যে তেমন উৎসাহ ছিলোনা তাদের। তাড়া ছিলো না, তাই সবুজ রঙের স্ট্যান্ডফ্যানে খানিকক্ষণ গা জুড়িয়ে নেবার সুযোগটা হাতছাড়া করলোনা সতত সুযোগ খুঁজে ফেরা বন্ধুদ্বয়।
‘শুনেছিস, আটটা কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিচ্ছে’ রোমিন সুধায়।
‘হম্ম্, একদম দল বেঁধে’ দাঁতকাঠি দিয়ে পেছনের একটা দাঁত খিলাল করতে করতে বলে জাহিদ।
‘অবশ্য ওদের বেশি করে দেয়া উচিত’
‘কেন?’
‘সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটেছে ওরা। চুরির মালের ভাগ সবাই পেলো, এটা ভালো না?’
‘হম্ম্ ভালো। একারণেই চুরি করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে, কারণ কম-বেশি সবার ভাগ্যেই জুটছে কিছু না কিছু, কোন না কোন ভাবে।’
‘সৎ উন্নয়ন হয়না। উন্নয়ন প্রথমে অসৎ, অসম, কুৎসিত। রোশনাইটা পরে আসে’
‘হম্ম্, তা হবে বোধ হয়। কিন্তু অসৎ লোক কি দক্ষ হতে পারে?’
‘আমার এসবে মাথাব্যথা নেই। যতক্ষণ আমার উন্নতি হচ্ছে, আর কার কি হলো তা নিয়ে ভাবতে চাইনা’
‘আমরা তো সব সে দর্শনেই চলছি। আমি, তুই, দেশ, পৃথিবী।’ মুখে জমা হওয়া, দাঁতকাঠিতে বেরিয়ে আসা মাংসের আঁশগুলো ‘থু’ করে পাশে ফেলে। একবারে যায় না, দুতিনবার করতে হয়।
তিনি কথা বলার চেষ্টা করলেন, গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হলো না। ডান হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলেন। টুকটুক ছাড়া প্রায় সবাই তাকালো, কিন্তু মনোযোগ দিলো না। কেউ তার দিকে তাকিয়েই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, কেউ কেউ আর ফিরেও দেখছে না।
।ঊ।
স্কুল শেষে মেয়েকে নিয়ে ফিরছে অনতি। মেয়ের কাঁধে স্কুল ব্যাগ। তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে বই-খাতায় ঠাসা ব্যাগটা। মেয়েটা টেনে টেনে মা’র হাত ধরে হাঁটছে। এত গরম পড়েছে! মেয়েটাকে আইস্ক্রীম কিনে দিয়েছে, নিজের হাতে একটা পানির বোতল। ছুটির আগে এই কাঠফাটা রোদে পাক্কা এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলো। স্কুলগুলো যা হয়েছে না! এত এত টাকা নেয় অথচ গার্ডিয়ানদের বসার কোন ব্যবস্থা নেই, ভেতরে বাচ্চাদের ক্লাসরুমেও এসি নেই। সব চলছে ইচ্ছেমতো, দেখার মতো কেউ নেই। ভাবতে ভাবতে ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে। সে চলেই যাচ্ছিলো হঠাৎ খেয়াল করলো বেশ কয়েকজন লোক একটা স্ট্যান্ডফ্যানের বাতাস খাচ্ছে। ছেলেকে নিয়ে সেও দাঁড়ালো, ছেলের কাঁধ ধরে। তার ফোন বেজে উঠলো।
‘হ্যালো......হ্যা ভাবী......ও আপনি আজকে আসেননি!......না না রিপোর্ট কার্ড কালকেও নেয়া যাবে, সমস্যা হবে না......ওই একটু ভাব নেয় আর কি।.........ওতো এবার ফোর্থ হয়েছে......না না ভাবী আমি আর কি করলাম! এবার ওই মিসের কাছেই প্রাইভেট পড়তে দিয়েছি......গতবার দিইনি বলে তো নাম্বারই দিলো না, পঁচিশজনের মধ্যে বাইশতম হয়েছিলো।...হম্ম্......সেটাই......আপনিও দিয়ে দেন। এদের সাথে পারা যাবেনা, কমপ্লেইন করলে তো বাচ্চার পেছনে লাগবে।......হম্ম্...দিলু ভাবীরা শুনলাম মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছে সেকেন্ড হোম না কি জানি একটা প্রোগ্রামে......হম্ম্ ভালোই...যা অবস্থা......হ্যা হ্যা সেটাই।.........না ভাবী, আজকে তো ক্লাসনোট দিতে পারবোনা, আমার বাসায় ফিরতে রাত হবে......না না, কোথাও বেড়াতে যাবোনা......লাঞ্চ করে ম্যাথ মিসের কাছে নিয়ে যাবো। ম্যাথ কোচিং শেষে সুরালয়ে.........গান শিখছে, একদিন গান একদিন ড্রয়িং এভাবে। তারপর সন্ধ্যায় ইংলিশ কোচিং এ। ওরা আবার লিট্রেচার, গ্রামার, ডিক্টেইশন, স্পোকেন – সবই করে। তারপর বাসায় যাবে, একঘন্টা আরবী পড়বে। সাড়ে ন’টা বেজে যায়......কী করবো বলেন, সবকিছুইতো জানতে হয়।’
অনতির সুডৌল নিতম্ব অনেকেরই নজর কেড়েছে, তারা বারবার দেখছে – কোন ছল ছাড়াই। তিনি কথা বলতে পারছেননা, একটা হাত দিয়ে বাম বুক চেপে ধরে আছেন। মাথাটা চেয়ারের একপাশে সরে গেছে।
।ঋ।
‘ওই এদিক আয়’ চারজনের একটা দল দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। তাদেরই একজন ফ্যান দেখে দাঁড়িয়ে সার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বাকিদের ডাকে।
‘কী অইছে?’ দলের একজন বলে
‘আরে ব্যাটা আয়, একটু বাতাস খায়া যাই। যে গরম পড়ছে! শইলডা ঠান্ডা কইরা লই।’ প্রথমজনের কথা শুনে একজন আসে, তাকে অনুসরণ করে আসে অন্য দু’জনও।
‘দেরি অয়া যাইব না?’
‘দেরি অইব ক্যা! আধা ঘন্টা আগে যাইবার কইসে, যাইতাছি এক ঘন্টা আগে’
ওরা দাঁড়িয়ে পড়ে ফ্যানের সামনে। একজন সেটাকে সুবিধামতো ঘুরিয়ে দেয় নিজেদের দিকে।
‘হালার পুতরে আইজ এমুন পাংগা দিমু!’
‘মাথা গরম করিস না, লীডারে কইছে হালকার উপ্রে ছাইড়া দিতে। বেশি করলে উল্ডা আমাগো বাঁশ খাওয়া লাগবো।’
ফ্যানের বাতাস আর দোকানের ভেতর যাচ্ছে না, এই চারটা ছেলে ছাড়া আর কারো গায়ে লাগছে না। আক্কেল মিয়াসহ সবাই অসহায়ের মতো তাকায়। ছেলে চারটির দিকে এগিয়ে যায় মমতাজ। ওরা তাকে বাতাস খাওয়ার জায়গা করে দেয়, অন্যরা চেয়ে দেখে।
।ঁ।
তার চারপাশে সব অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে হলো তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। দৈবাৎ টুকটুকের চোখ পড়লো তার দিকে। লোকটা কী মারা যাচ্ছে! সেকি একটা লাইভ মৃত্যুর সাক্ষী হতে যাচ্ছে! এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভেতরটা নেচে উঠলো তার। একটু ঝুঁকে লোকটার চুল এলোমেলো করে দিলো যাতে চেহারাটা হয়ে উঠে আরো করুণ, আরো মৃতপ্রায়। তারপর ঘুরে, লোকটাকে পেছনে রেখে, ঠোঁট বাঁকানো হাসি দিয়ে একটা ‘নিজি’ (selfie) তুললো মোবাইলে। তার বুক চেপে ধরে রাখা হাতটা ঢলে পড়লো একপাশে। নামহীন, দামহীন, অস্তিত্বহীন, স্বীকৃতিহীন তিনি অন্যের ‘নিজি’তে অমর হয়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন