|
রোদেলা
|
|
জলধরা থেকে বারহাট্টার ভাংগা চোড়া কান্না...
31 July 2015, Friday
ঈদের আমেজ যখন পার্বত্য অঞ্চলের সমুদ্র সীমানায় ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে তখন আমার ইচ্ছে করলো নীরব কোন ঝিল পাড়ে বসে শালুক কুড়াতে। তাই তিন দিনের ছুটি নিয়ে চলে গেলাম নেত্রকোনা।যতোখানি আশা করেছিলাম তার চেয়েও ঢের বেশি সবুজ সাজে নিজেকে রাঙ্গিয়ে রেখেছে পথের দু’ধার।বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে গাছের পাতাগুলো রোদের আলোয় কেমন ঝলমল করে উঠলো,আর বিলের পানিতে উপচে পড়া আকাশের ছায়া এক অদ্ভূত নৈসর্গীয়তায় পৌঁছে দিচ্ছিল ক্রমশ।কিন্তু শহরে ঢুকতেই উঁচু নীচু খাদের মতো রাস্তার ঝাঁকুনীতে বিহবল হয়ে গেলাম,এমন সুন্দর যার রূপের মাধুরী তার গায়ে কি এমন আলুথালু পোষাক মানায়। কিন্তু কিছুতো করার নেই,আমাকে যেতে হবে বিলের বেলাভূমিতে।
“আমার গায়ে যতো দুঃখ সয় ;
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয় ...”
বারী সিদ্দিকীর বাড়ির সামনে দিয়ে হেলে দুলে চলছে অটো রিক্সা,শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পথ।কিন্তু এ পথে চার চাকার কোন যানবাহন আসার সাধ্য নেই।অনেকটা গরুর গাড়ীতে চড়ার অনুভূতি নিয়েই পথ এগুচ্ছি।কোন নিঠুর বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বারী ভাই গানে সুর তুলেছিলেন –আমার জানা নেই।কিন্তু ক্রমাগত ক্ষত হতে থাকা বিষন্ন রাস্তাটি বলে দিচ্ছিল-“তোদের যা খুশি আমারে নিয়া কর,আমি সইবো।“
যতোখানি চোখ প্রসারিত হয় কেবল পানি আর পানি।এখানেও ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায় ,এখানেও তরুনীদের বিয়ে হয় আর এই অনাবিল গায়েও মেয়েদের বছর বছর বাচ্চা হয়।কিন্তু কি করে সম্ভব,আমার পাশের বব্ধু বলে দিল সহজ কথা-যারা ওটিতে নিতে বউকে ভয় পায় তারা এই রাস্তা দিয়ে গেলেই হবে একদম ডেলিভারী কনফার্ম।কতোটা বাস্তব কৌতুক,যার উপর দিয়ে বিষয়টা একবার ঘটে সেই জানে কেমন তার ব্যথা ।এখানে হাসপাতাল তো দূর,একটু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই।এই ডিজিটাল দেশে লতা-পাতা-গুল্ম দিয়েই পথ্য নির্বাচন চলছে।
একটা সময় পর তিন চাকাও থেমে গেল,দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ পাহাড় ।আমার ইচ্ছে হলো এক দৌড়ে ছুঁয়ে দিয়ে আসতে।কিন্তু আরো অনেক মাইল হাঁটতে হবে,সন্ধ্যাও হয়ে আসছে প্রায়।তাই বিশাল বিলে পা ডুবিয়ে সকল ক্লান্তি ভুলে হারিয়ে গেলাম সূর্যাস্তের মাঝে।
বারহাট্টা যাবার সময় অবশ্য এমন ঝামেলা হয়নি,পীচ ঢালা পথ ধরে বাস অথবা অটো সবি যেতে পারে।সুবিন্যস্ত রাস্তা আর দু’ধারে বিদ্যুতের চমৎকার লাইন দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলাম এখা্নকার মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত সুবিধা পাচ্ছে,উপজেলা বলে কথা।চলতি পথে বেশ কয়েকটা প্রাইমারী স্কুল চোখে পড়লো,জেলেরা মাছ ধরে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে।চোখের সীমানা জুড়ে কেবল ক্ষেত আর ক্ষেত,কোথাও দ্বীনতার চিনহ নেই যেন।আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনেই হয়-এখানে কোন অপ্রাপ্তি নেই।
আমাদের তিন চাকা এসে থামলো বারহাট্টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সদর দরজায়। ঠিক কতো দিন হলো এই মোবাইল ক্লিনিক গঠন করা হয়েছে তার কোন হিসেব কেউ দিতে পারলো না,অবশ্য হিসেব দেবার মতোন কোন কর্মকর্তাই সেখানে পাওয়া গেল না।সত্যিকার অর্থে ,মাসের ২৭ তারিখেও তাদের ঈদের ছুটি শেষ হয়নি।কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মেড়েও কর্মকর্তাদের তেমন আনাগোনা আমার চোখে পড়েনি।
সারাজীবনে বহুবার সোস্যাল এওয়ারনেস ,এডুকেশনাল এওয়ারনেস ,হেলথ মোবিলাইজেশনের প্রোজেক্ট সম্পর্কে কেবল শুনেই এসেছি,তার সুনির্ধারিত প্রয়োগ কোন দিন চোখে পড়েনি।ধরেই নিলাম সরকার খুব যত্ন করে একটা গোলাপ গাছ লাগিয়েছে,তাহলে সেই গাছে পানি দেবার জন্যে নিশ্চই রাজধানী থেকে প্রতিদিন পানি আসবে না।এর যত্ন স্থানীয় কর্মীদেরই নিতে হবে।মুখরোচক পোস্টারের পাশে যখন মেডিকেল অফিসার দের বাস ভবন উঁকি দিল তখন মনে হলো আমি নিজেইতো লক্ষ টাকা দিলেও এখানে থাকবো না।তাইতো ডাক্তাররা তাদের ফ্যামেলিকে রাখে ঢাকায়,মাস শেষে এসে বেতন খানা বুঝে নেয়।আর চিকিতসা দেবার জন্যেতো স্থানীয় নার্সতো আছেই।জ্বর হলেও নাপা আবার পেট ব্যথাতেও নাপা,প্রেসক্রিপশনতো একটাই।
কমপ্লেক্সের ভেতরে পা রেখে দেখা মিললো একজন সিভিয়ার হাঁপানী রোগীর।বৃদ্ধের এমন অবস্থা যে তাকে এখনি এম্বুলেন্সে তুলে ময়মনসিংহ পাঠানো দরকার।কিন্তু কই সেই এম্বুলেন্স,আমি তার বেশ ভুশা দেখে একদম থমকে গেলাম।শ্যাওলা জড়ানো এম্বুলেন্স আমি বাপের জন্মে কোন দিন দেখিনিরে ভাই।বেলা ১২টা ,হন্যে হয়ে খুঁজছি মেডিকেল অফিসারকে।যারা প্রেগনেন্ট তাদের কথা ভাবতেই পারছিনা।এর মধ্যেই সাত মাসের গর্ভবস্থায় একজন মহিলা সদর হাসপাতালে নিতে নিতেই বাচ্চাটি পেটেই মারা গেছে।পুরো বিষয়টা তারা এমন ভাবে বর্ননা করছে যেন-এমন দু’চারটা মরণ তাদের প্রাপ্য।এই অশিক্ষিত মানুষ গুলো জানতেও পারেনা কি তাদের প্রাপ্য,কি তাদের নাই।
দু’জন বাচ্চাকে নিয়ে দু’জন মহিলা প্রেস্ক্রিপশন হাতে গেটে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের প্রশ্ন করে জানতে পারলাম বাচ্চাদের জ্বর নিয়ে এসেছে।চিকিতসা করেছে নার্স,কিন্তু থার্মোমিটার দিয়ে যে জ্বর মাপতে হয় তারা তা জানে না।নার্স অবশ্যই জানে,কিন্তু তার একার পক্ষে হাজার রোগী সামাল দেওয়া নিশ্চই সম্ভব নয়।ফেরার পথে শুভ্র চেহারার মেডিকেল অফিসারের দেখা মিলেছিল,কিন্তু আমার আর ছবি তুলতে ইচ্ছে করেনি।কি হবে ,সরকারী চা্তরীর অনেক জোর।এটাতো আর প্রাইভেট কোম্পানী না যে একদিন অফিস কামাই করলে তোমার চাকরীটাই চলে যাবে।এর আছে অন্য রকম ক্ষমতা-“দি এক্সক্লুসিভ পাওয়ার।“
আমি সেই অসম্ভব ক্ষমতা পূর্ন দেবালয় থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিজের হাতের শার্টার বন্ধ করলাম।কারন এইসব নিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রিপোর্ট হয়,টক শোতে টক টক কথা চলতেই থাকে।তাতে এই অসহায় কুলাঙ্গারগুলোর কি বা এসে যায়।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন