|
তরিকুল ফাহিম
|
|
শিকড়ের গল্প....
27 July 2015, Monday
ঈদের বেশ কিছুদিন আগেই লঞ্চে করে বাড়ি যাচ্ছিলাম। সারা রাত থেকে থেকে বৃষ্টি। কখনো গুড়ি গুড়ি কখনো মুষল ধরে। আমার সাথে আমাদের বাচ্চা মেয়েটা। বর্ষার হিম হিম ঠাণ্ডায় ও খুব করে ঘুমাচ্ছিলো। আমার নদী দেখতে দেখতেই রাত প্রায় শেষ। ফর্সা হয়ে আসছে চারদিক। কিছুটা সন্ধ্যার মত প্রকৃতি।ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি বেদ করে দূর থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের ক্ষীণ কণ্ঠ। এপারের গ্রামটা কিছুটা দৃশ্যমান হলেও ওপারেরটা একেবারেই অদৃশ্য। ছোট বড় জেলে নৌকায় তখনো মিট মিট করে জ্বলছে প্রদীপ। হঠাৎই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। প্রতিদিনের মত ঘুম ভেঙে গেলে ঘ্যানর ঘ্যানর কোন কান্না বা চোখে মুখে কোন বিতৃষ্ণা নেই। সুবোধ বালিকা হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি দেখছে। তীব্র বেগে কাত হয়ে আসা বৃষ্টির জল দেখছে। এমনটা হয়তো কখনো দেখেনি। লঞ্চের পাশের লোহার গ্রিলটা বৃষ্টির জলে ভেজা। পুরোটা জুড়ে ফোট ফোট পানি। ও আনন্দ চিত্তে পানি ধরছে। গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। খেয়াল করে দেখলাম খুব আনন্দ পাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজে যাচ্ছে ওর জামা। মাথায় চুলের ঝুটিতে শিশিরের মত জমছে জল। এরকম বৃষ্টির জল ঘাঁটলে বা বৃষ্টিতে ভিজলে নিশ্চিত ওর জ্বর আসবে এ কথা মাথায় আসতেই ওকে আমি ছোঁ মেরে নিয়ে আসলাম। ও কিছুতেই আসতে চাচ্ছে না। বললাম,'মা তোমার জ্বর আসবে'। কিন্তু কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছে না।
হঠাৎ একটা জেলে নৌকা ওর চোখে পড়তেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
-'উই যে উই লোকেরা নৌকায় কি করে?'
-মাছ ধরে
-কি মাছ?
-ইলিশ মাছ, পোয়া মাছ, বোয়াল মাছ।
-আচ্ছা, উই লোকেদের কি জ্বর আইবনা? তারা তো বিষ্টিতে ভেজে
-না মা, তাদের জ্বর আসেনা। তারা বড় মানুষ।
-উম তুমি মিথ্যা বল। আমার আব্বু একদিন বিষ্টিতে ভিজছিল, জ্বর আইয়া পড়ছে। আমার আম্মু অনেক বকছিল আব্বুকে।
একটু ঝামেলায় পরে গেলাম। কি করে বোঝাই? বললাম, 'মা এরা প্রত্যেকদিন ভেজে তাই এদের জ্বর আসেনা। তুমি ভাতের সাথে প্রত্যেকদিন যে মাছ খাও সেগুলো এই লোকেরাই জাল দিয়ে নদী থেকে ধরে। এদের জন্যই তো তুমি ভাতে মাছ খেতে পারো, মাছের ডিম খেতে পারো'। ও মানতে নারাজ। বলে,'কিন্তু এগুলো তো আমার আব্বু বৌ বাজার থেইকা কিন্না আনে'। বললাম এরা মাছ ধরে বৌ বাজারে নিয়ে যায় এদের কাছ থেকেই তোমার আব্বু কিনে আনে। ও এবার কিছুটা বুঝতে পেড়েছে। আবার জিজ্ঞাস করলাম-
-তাহলে এরা অনেক ভালো তাইনা মা?
-হ ভালো।
-এদের কে আমরা সম্মান করবো।
-কিন্তু এদের জ্বর আয়না ক্যান?
-এদের জ্বর এলে তো তুমি মাছ খেতে পারবে না। তাই জ্বর আসেনা।
-ও
বাড়িতে এক সকালে আমরা বিলের কাছে বসে আছি। সাথে আমার ভাতিজী। আমার উদ্দেশ্য ওকে মেঘ পাখি গরু ছাগল এসব নিয়ে ওর সাথে কথা বলবো। তখন বিলের ভেতর এক লোক ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করছিলো। ওর চোখে পড়তেই আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো-
-চাচ্চু, উই লোকটা কি করে?
-মা, জমি চাষ করে।
-ও ধান লাগাইব?
-হুম মা, আমরা যে ভাত খাইনা (ও আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল)
-সেই ভাত এই লোকটার জিন্নে হয়, তাইনা?
- (আমি সবিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ মা।
-তাইলে এই লোকটাও অনেক ভালো, তাইনা?
- হ্যাঁ মা। শুধু এই লোকটা না যারা এরকম চাষ করে তারা সবাই।
পৃথিবীতে যত নিম্ন পেশার মানুষ সবাকেই উচ্চ পেশার মানুষেরা একটু অবহেলার চোখে দেখে। কোথায় কোথায় গালে পীঠে পরে চড় থাপ্পর। যে কুলি বা মুটে ঘারে পীঠে করে আপনার মোট বইল তাকেই আপনি লাথি মেরে নিচে ঠেলে ফেলে দেন! হায় সভ্যতা! আপনি একবার ভাবলেনও না অই মুটে ছাড়া আপনার এই জাহাজ বা রেলের কামরায় এসে বসা কস্মিন কালেও সম্ভব হতোনা।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন