১
কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্ত বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটি ফেসবুক দিয়া ইন্টারনেট চালায় এবং তাহার ফ্যান-ফলোয়ারগনের সংখ্যা বাঁধ ভাঙ্গিয়া যাইতেছে। কিন্তু আর কিছুদিন এভাবে চলিলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের প্র.পিকের পরিধেয় অবৈধ রকমে কমিয়া গেছে বটে, কিন্ত পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া।
আমি ছিলাম বর, সুতরাং বিবাহসম্বন্ধে আমার মতামত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল। তথাপি আমি ইহার কোন প্রয়োজনও অনুভব করি নাই। আমার কাজ অবশ্য আমি করিয়াছি, কহারও ভালো লাগুক অথবা নাই লাগুক। এস.এস.সি পাস করিয়াছি গোল্ডেন এ+ সহকারে। তাইতো প্রজাপতির দুই পক্ষ, ১) কন্যাপক্ষ ও ২) বরপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল এবং ততখক্ষনাৎ তৃতীয় পক্ষের(ঘটক) সরনাপণ্য হইলো।
আমাদের দেশে যে মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোনো উদ্বেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর সম্বন্ধে তাহার ভাবটা ঠিক সেইরূপ হইয়া উঠে। অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র গোটা কয়েক ডজন পরকীয়া করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না।
যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাদের মতন কচি ছাত্রদের। বিবাহের প্রস্তাবে আমাদের পৌনঃপুনিক প্রেমগুলা রাস্তা-ঘাটেই মৃত্যু বরণ করে, ঘর অবধি প্রবেশের সুযোগ হইয়া উঠে না। ফলে পিতৃপক্ষের পাকা চুল কলপের আশীর্বাদে পুনঃপুনঃ কাঁচা হইয়া উঠে, আর প্রথম ঘটকালির আঁচেই ইহাদের কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার উপক্রম হয়।
‘বিবাহ দেবী’র কিরা কাটিয়া কহিতেছি, আমার মনে এহেন কোন বিষম উদ্বেগ জন্মে নাই। বরঞ্চ বিবাহের কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিনে হাওয়া দিতে লাগিল। সেই হাওয়া কালবৈশাখীতে রুপ লইবার পূর্ব মুহূর্তে আমার কৌতূহলী কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল। যাহাকে পরিক্ষার পূর্ব রাত্রে কেবলই ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পাঁচ-সাত খানি উত্তর মুখস্থ করিতে হইবে, তাহার পক্ষে এ ভাবটা কি দোষের? মোটেই না... আমার এ লেখা যদি ‘পুত্তুম আলুতে’ অনূদিত হইবার বিন্দু মাত্র আশঙ্কা থাকিতো তবেই না-হয় একটুখানি সাবধান হইতাম।
কিন্ত, হায় হায়! এ আমি কী করিতেছি? এক লাইনের ‘সাময়িক পোস্ট’ লিখিতে আসিয়া যেন পুরা ‘সামুপিডিয়া’ এডিট করিতে বসিলাম। এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি কি জানিতাম? মনে ছিল, কয় বৎসরের প্রেমিকা খরার দরুন বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে, তাহাকে বৈশাখসন্ধ্যার ঝড়ো বৃষ্টির মতো প্রবল বর্ষণে এরুপে উগ্রাইায়া দিব?
কিন্তু, না পারিলাম বাংলায় একখানি ফেসবুক স্টাটাস লিখিতে, কারণ বিজয় কি-বোর্ডের মুগ্ধবোধ আমার এখন অবধি আয়ও হয় নাই; আর না পারিলাম বাংলিশে একখানি ফেসবুক নোট রচনা করিতে, কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারি। সেইজন্যেই দেখিতেছি, আমার ভিতরকার শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে ‘রবিদ্র বাবু’কে এডিট করিতে বসিয়াছে। আর না করিয়া বা করিবে কী। তাহার যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে, জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রই তো জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রোদন।
২
আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ ঘটিয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না। পাগ্লা কুকুরে কামড়াইলেও না; রয়েল বেঙ্গল টাইগার কিংবা ভেম্পায়ার-মণ্ডলী কামড়াইলেও না। কারণ ইন্টারনেট জগতে তাহার নামটি লইয়া সার্চ-ম্যানদের মধ্যে প্রতিযোগীতার আশঙ্কা উড়াইয়া দিতে পারি না (যওো সব বিপথগামী যুবক সমাজ কাহিকা)।
আমি ‘নিজস্বার্থ ভালোবাসা’ ছবির শুটিং চলাকালে ‘জনন্ত অলিলে’র কাছে গিয়া, বিনা অপারেসনে যে তাম্রশাসনে তাহার নামখানি খোদাই করিয়া আনিলাম —তাহা আমার হৃদয়পট। কোনোকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইলে, ‘অলিল’কে আমি দেখাইয়া দিবো হেমন্তের পর কেম-নে বর্ষা আসে। কিন্ত, যে অমৃতলোকে তাহার নামখানি এতদিন অক্ষয় হইয়া রহিল, সেইখানে এখন অবধি কোনও সার্চ-ম্যানের আনাগোনা নাই —তাই মরিয়া গেলেও এই নাম মুখে/কলমে উচ্চারন করিবো না।
তবে এ কথাও অজানা নয়, এ লেখায় তাহার যেমন হউক একখানা নাম চাই। অন্যের লেখা এডিট করিতেছি; তাই বলিয়া সামান্য জ্ঞানটুকু থাকিবে না? তাহা কি করিয়া হয়? নামখানা ভাল-খারাপ, আগডুম-বাগডুম-ঘোড়াড্ডুম যাই হোউক মোটকথা বাংলা বর্ণমালার দুই-একটা বর্ণ দিয়া হইলেও তাহার একখানি নাম আমাদিগর চাইই চাই...
আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম ‘শিশির’। কেননা, “শিশিরে কান্নাহাসি একেবারেই যে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়।” —উক্ত নামখানিই কেন ব্যবহার করিলাম তাহাও বলিয়া দিলাম; ভবিষ্যতে স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নায়িকার চরিত্র বিশ্লেষণ করিতে সুবিধা হইবে। এখন-কার ছাত্রদের যেরুপ অবস্থা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সমাধান করিতে গিয়াও তাহারা কয়েকখানা কলম ভাঙ্গিয়া ফেলে।
এহ্..হে! ‘শিশির’ নামখানিও-তো ব্যবহার করা যাইবে না। আগেই সকলকে জানাইয়া রাখি, আমি হইলাম গিয়া সাকিব-আল-হাসানের বিরাট ফ্যান। না! না! না! যে যাই বলুক এই নাম আমি ব্যবহার করিব না।
ধ্যাওেরিক্কা! এতো বাঁধা আসিলে কি চলে? একেতো সাহিত্য রচনায় আমি শুন্য শ্রেণীর লাস্ট বয়; তাহার উপর ইহা এডিট করিতে বসিলে বর্তমান সময়ের তারকারা বউ-বাচ্চা লইয়া হাজির হন। এ-মনে চলিলে 'সাহিত্যে নুবেল' আসিবে কিভাবে? আহ্! সাহিত্য এডিট করিয়া যদি শান্তিতে নুবেল পাওয়া যাইতো। হায়! আবারও আমি কি আজাইরা বকবক পাকাইতেছি... যাহোক উক্ত লেখায় তাহার নাম দিলাম ‘ফারহানা বিথি’।
'বিথি'র ফেসবুক পিকচারের সংখ্যা আমার চেয়ে কেবলই তের-সহস্র বেশী ছিল। অথচ, আমার পিতা যে গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না তাহা নহে।
তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ, দেশের প্রচলিত ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ তাঁহার হাতের মুঠোয় ছিল; তিনি কষিয়া দুর্নীতি করিয়াছিলেন। অপরদিকে আমার পিতা উগ্রভাবে ফটোগ্রাফি প্রেমিক। মানিতে তাঁহার বাঁধে যেমনঃ ফটো এডিটিং; আমাদের স্টুডিওতে, সদরে বা অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়। তবে ইনিও টুকটাক এডিটিং শিখিয়াছিলেন। পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই এডিটিং এর প্রতি অনিহা, যাহার স্বরূপ বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি। কোনোটাই সরল স্বাভাবিক নহে।
তবুও একজন ফেসবুক সেলিব্রেটির সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন, তাহার কারণ মেয়ে সেলিব্রেটি বলিয়াই পণের অঙ্কখানিও মেগা সাইজের। বিথি আমার শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে। স্বভাবতই বাবার বিশ্বাস ছিল, কন্যার পিতার সমস্ত ব্ল্যাক-মানি! ভাবী জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া তুলিতেছে।
৩
আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনো-একটা মতের বালাই ছিল না। তিনি রাজধানিতে শিক্ষামন্ত্রনালয়ের অধীনে বড়ো কাজ করিতেন। বিথি যখন কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয়। মেয়ে বৎসর-অন্তে এক-এক করিয়া ফেসবুকে ছবি আপলোড করিয়া গেছে, তাহা আমার শ্বশুরের চোখেই পড়ে নাই। সেখানে তাঁহার সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না, যে তাঁহাকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে।
বিথির আপলোডেড পিকচার যথাসময়ে ষোল-সহস্র হইল; কিন্ত মনে রাখিতে হইবে ইহা কেবল প্রফাইল পিকচারের হিসাবে ষোলো সহস্র, ফ্যান পেজের জন্য মোটেই ষোলো সহস্র নহে। কেহ তাহাকে আপন পিকচারের পরিধেয়র জন্যও সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও পরিধেয়টার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না।
কলেজে দ্বিতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স সতের; এমন সময় আমার বিবাহ ঘটিলো। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজ সংস্কারকের মতে উপযুক্ত কিনা, তাহা লইয়া তাহারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধাইয়া মরুক। কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাস করিবার পক্ষে যত ভালো হউক বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভালো নয়।
বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি দুষ্টু ফেসবুক ফ্যান পেজের মিষ্টি আভাসে। টেস্ট পরিক্ষার আউট হওয়া প্রশ্নপত্র সমাধান করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে বিথির ফ্যানপেজ ওপেন করা গ্যালাক্সি ট্যাবখানি রাখিয়া বলিলেন, “এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো —একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া।”
কোনো একজন দক্ষ ফটো এডিটরের এডিট করা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া, খোঁপায় জরি জড়াইয়া, জারা কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া, বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই; এমনটি কেহ একেবারেই ভাবিবেন না। আমার ধারনা তাহার বাসায় পার্সনাল বিউটি এক্সর্পাট, রঙ্গিলা মেইক-আপ বক্স, যাত্রাপালার কস্টিউম, ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফটো-এডিটিং সফটওয়্যার সহ গোটা কয়েক হালি দক্ষ ফটো-এডিটর রহিয়াছে।
ভারি একখানি চানচল্যে ভরা মুখ, ডায়মণ্ডের মতন চকচক করিতে থাকা দুটি চোখ, আয়নার মতন প্রতিফলিত হইতে থাকা এক জোড়া ঠোঁট এবং জমকালো একখানি শাড়ি। যেমন-তেমন না একেবারে ঢাকা-জাদুঘরে রাখা সুলেমানী চৌকির মতন একখানিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোরা-দাগ-কাটা লেডি গাঁ গাঁ’র পোস্টার ঝুলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে সদ্য ভূমিষ্ঠ জলজ্যান্ত চাইর-টা বিলাইয়ের বাচ্চা! আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি পা। এক-কথায় সমস্তখানি লইয়া তাহার অঙ্গে অঙ্গে যেন মিথ্যাটি বাসা বাঁধিয়াছে।
ট্যাবের ছবিটির উপর আমার মনের সোনার কাঠি লাগিতেই, আমার রূপার কাঠি জাগিয়া উঠিল, আমি জমিয়া গেলাম। সেই কালো দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া যেন চাহিয়া রহিল। আর, সেই বাঁকা পাড়ের নীচেকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া উদ্দাম নিত্য পরিবেশন করিতে লাগিলো। সমস্তটি লইয়া কী যে অপার মহিমা সে আমি বলিতে চাই, কিন্ত বলিব না।
ট্যাবের ছবিগুলো উল্টাইতে থাকিলাম; ব্যাটারির চার্জ ফুরাইয়া গেল কয়েকবার, তবুও শেষ ছবিখানির দেখা মিলিল না। এদিকে দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না। শ্বশুর পিএসসি’র পর এবার জেএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস করিতে ব্যস্ত। ও-দিকে বিথির টোটাল ফ্যান-সমগ্র, আমার সাথে বিথির সম্ভাব্য বিবাহের খবরখানি লইয়া অযথাই উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। আমাকে হেয়-প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্তে ‘বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা’ নামক একখানা ফেসবুক ইভেন্ট ঘোষণা করিয়াছে। তাহাতে ইতোমধ্যেই আমার একখানা ছবি এডিট করিয়া ঝুলানো হইয়াছে। আমার আইবড় বয়সের সীমানাটাকে সতের বছর হইতে অনর্থক সত্তর বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত চলিতেছে।
শ্বশুরের এবং তাঁহার মনিবের উপর রাগ বাড়িতে লাগিল। রাগ বাড়িতে বাড়িতে এমন অবস্থা হইলো যে একদিন স্বপ্ন দেখিয়া ফেলিলাম, শ্বশুরকে পিটাইতেছি! পিটাইতে পিটাইতে তাহার মেরুদণ্ড গুঁড়া করিয়া পাউডার বানাইয়া ফেলিআছি। একখানা কোম্পানি আবার সেই পাউডার বাজারে বিক্রি করিতেছে, নাম ‘প্রশ্নপত্র পাউডার’ —শুধু মাত্র পরিক্ষার্থীদের জন্য (যওো-সব আজগুবি স্বপ্ন কুথাকার)
যা হউক, এইচ.এস.সি’র ঠিক পূর্বলগ্নটাতে আসিয়া আমাদের বিবাহের দিন ঠেকিল। সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটি আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার সেই সতের বছরের বয়সটি আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক।
বিবাহসভায় চারি দিকে হট্টগোল। তাহারই মাঝখানে কন্যার কুসুম-কোমল হাতখানি আমার ইস্পাত-কঠিন হাতের উপর পড়িল; ‘টাংঙংঙং...’ করিয়া একখানা শব্দ বিবাহসভার চারিদিকের হট্টগোলকে নিঃস্তব্ধ করিয়া দিল।
এমন আশ্চর্য আর কী আছে; আমি চিৎকার করিয়া বারবার বলিতে লাগিলাম, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’ পরক্ষনেই মনে মনে ভাবিলাম, ‘নাকি! ইহা আমাকে পাইলো?’ কে কাহাকে পাইলো তাহা লইয়া অযথাই কিছু সময় ক্ষয় করিলাম। পরিশেষে সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম, ‘এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে?’
৪
আমার শ্বশুরের নাম ‘নুরুল চন্দ্র গুপ্ত’। যে দেশের রাজধানীতে তিনি বাস করিতেন সেই দেশের মেরুদণ্ড গুঁড়া করাই ছিল তাহার প্রধান কাজ। তাঁহার মুখের রহস্যময় হাস্য সকল সময় দেশবাসীকে বিদ্রুপ আর পরিহাঁস করিতো। আর, তাঁহার হৃদয়ের শিখরদেশে গাম্ভীর্যের যে একটি সৌধ ছিল তাহার সন্ধান যাহারা জানিত, তাহারা সেই মুহূর্তেই তাঁহাকে গড-ফাদারের আসনে বসাইয়া দিতো।
কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাবা, আমার মেয়েটিকে আমি সতেরো বছর ধরিয়া জানি, আর তোমাকে এই ক'টি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তোমার হাতেই ও রহিল (মুচকি হাসি)। যেই জিনিষ তোমাকে দিলাম তাহাঁর বোঝা বেশী না কেবল যদি একমাস বহিতে পারো, তবে ভবিষ্যতে সকল পাবলিক পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ‘হোয়াট্স অ্যাপ’ মারফত পাঠাইয়া দিবো —এই আমি শিক্ষামন্ত্রীর নামে কিরা কাটিলাম। এরচেয়ে বেশি ক্লু দেবার ক্ষমতা আমার নাই।”
তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বেহাই, মনে কোনো চিন্তা রাখিয়ো না। তোমার মেয়েটি যেমন গড-ফাদারকে ছাড়িয়া আসিয়াছে, এখানে আসিয়া তেমনি গড-ফাদার/মাদার উভয়কেই পাইলো।”
তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে বিদায় লইবার বেলা হো!হো!! করিয়া হাসিয়া উঠিলেন; আর বলিলেন, “বুড়ি, চলিলাম। তোর একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহা যদি পাউডার হইয়া যায়, কিংবা তোর শ্বশুর বাড়ির ইন্টারনেট সংযোগ যদি কখনও বিচ্ছিন্ন হইয়া যায় —আমি তাহার জন্য দায়ী নই।”
মেয়ে বলিল, “তাই বৈকি। কিন্ত একটুখানি যদি স্পীড কমিয়া যায় তবে তোমাকেই তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে। তোমার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া এ যে অসম্ভব, সে আমার চেয়ে ভাল আর কে বলিবে?”
অবশেষে নিত্য তাঁহার যে-সব বিষয়ে প্রতিনিয়ত লক্ষ-কোটি বিভ্রাট ঘটে সে সম্বন্ধে বাপকে বার বার সতর্ক করিতে থাকিলো। গুম, খুন ও বিচার-বহিভূত হত্যায় আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল না, গুটিকয়েক ধাড়ালো অস্র ও লাইসেন্স বিহীন কিছু পিস্তল ছিল, সেগুলোর প্রতিই তাঁহার বিশেষ আসক্তি —বাপকে সেই-সমস্ত প্রলোভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা ছিল মেয়ের প্রথম কাজ। সময়ে সময়ে এইসব নিয়া ফেসবুকে স্টাটস প্রদান করিয়া, বাপকে বিপদের মুখমুখি করা ছিল তাহার দ্বিতীয় কাজ। তবে আজ সে করিলো তৃতীয় কাজ, সে বাপের হাত ধরিয়া উদ্বেগের সহিত বলিল, “বাবা, তুমি আমার কথা রেখো —রাখবে?”
বাবা হাসিয়া কহিলেন, “মাৎথা খারাপ! মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য; আর যেই পন আমি কখনই রাখিব না, সেই পন না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ।” তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল। তাহার পরে কী হইল তাহা ইহলোকের কেহই জানে না। পরে অবশ্য আমি ধারনা করিয়া বাহির করিয়াছিলাম, সে কথা পরে কহিতেছি...
বাপ ও মেয়ের সাজানো নাটকের সফল মঞ্চায়ন আমাদের চর্মচক্ষুর সামনেই ঘটিলো। বিদায়ব্যাপার পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী অন্তঃপুরিকার দল দেখিল, শুনিল ও বুঝিল-ও। তবু মুখে কহিলো, অবাক কাণ্ড! ডিজিটাল দেশে থাকিয়া একেবারে-ই ডিজিট হইয়া গেছে! মায়ামমতা একেবারে-ই নাই!
৫
আমার শ্বশুরের বন্ধু ‘পায়রা পাখি’ আমাদের বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারেরও পরিচিত। তিনি আমার শ্বশুরকে বলিয়াছিলেন, ‘সংসারে তোমার তো ঐ একটি মেয়ে। এখন ইহাদেরই পাশে একখানা বাড়ি জবর-দখল করিয়া লইয়া, এইখানেই বাকী জীবনটা কাটাও।’
তিনি কণ্ঠ নামাইয়া বলিলেন, “ইহা তুমি কি বলিলা পাখি, মেয়ের শশুর বাড়ীর এলাকার লোকজনের বাড়ি জবর-দখল করিব? বিচার-বুদ্ধি, কান্ড-জ্ঞান সকল ফেসবুকে আপলোড করিয়া দিয়াছো নাকি? তাছাড়া যেই ফেসবুক স্টাটাসের যন্ত্রনায় তড়িঘড়ি করিয়া মেয়ের বিবাহ দিলাম, তাহা পুনঃরায় জীবনে ফিরাইয়া আনিবো?? জীবন মানেই কী শুধুই ‘জি-বাংলা’? এইবার একটু জোরে ঘোষণা দিয়া উঠিলেন, “যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে শুধুই দুঃখ পাইতে হইবে। অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।” (মিথ্যা অভিনয়ের ধাক্কা সামলাইতে না পাড়িয়া খ্যাঁক খ্যাঁক করিয়া হাসিয়া দিলেন)
সব-শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া অপরাধীর মতো সসংকোচে বলিলেন, “আমার মেয়েটির বরই সেল্ফি তুলিবার শখ এবং তাহা বাহিরের অচেনা-অজানা লোকজনকে দেখাইতে ও বড়োই ভালোবাসে। এজন্য বেহাইকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা করে না। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে বিকাশে টাকা পাঠাইবো; উমমম.. না! না!! সে আবার কেমন দেখায়, বরং ইন্টারনেটের প্যাকেজ(এমবি কার্ড) পাঠাইবো; তোমার বাবা জানিতে পারিলে কি অবাক হইবেন?”
প্রশ্ন শুনিয়া মেজাজ গরম হইয়া গেল; ধ্যাত্তেরি! বিকাশের টাকাইতো ঠিক ছিল প্রথমে, তবে ইন্টারনেটের প্যাকেজও মন্দ নয়। বাবাকে এখন প্যাকেজের ব্যপারখানা খোলাশা করিয়া বুঝাইতে হইবে, ঝামেলা এইতুকুই। তাছাড়া সংসারে কোনো-একটা দিক হইতে যেকোন কিছু(প্যাকেজ-ফ্যাকেজ যাই হউক) একটার সমাগম হইলে বাবা অবাক হইবেন, তাঁহার লোভ-লালসার মাত্রা এত নিচা তো দেখি নাই।
যেন ঘুষ দিতেছেন, এমনিভাবে আমার হাতে একখানা আই-ফোন (লেটেস্ট ৬+), ৩.৫ জি’র একখানা রবি সংযোগ এবং কয়েকখানা ফটো-এডিটিং সফটওয়্যার গুঁজিয়া দিয়াই দ্রুত প্রস্থান করিলেন। আকস্মিক যন্ত্রাদি পাইয়া প্রফুল্ল হইয়া প্রণাম লইবার জন্য মাথা নিচা করিলাম। কিন্তু সাথে সাথেই খেয়াল করিলাম সামনে শুধুই খালি জমিন পড়িয়া রহিয়াছে। মাথা উঠাইয়া পিছন হইতে দেখিতে পাইলাম, স্বাধীনতার খুশীতে তিনি ক্যাঙ্গারুর মতন লাফাইয়া এবং হরিণের মতন স্পীডে ইতোমধ্যেই দুই-ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া ফেলিয়াছেন।
আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। প্রথমেই আমার ডিসকভারি চ্যানেলের কথা স্বরণে আসিলো; কিন্তু কিছু সময় ক্ষয় করিয়া মনে মনে বুঝিয়া পাইলাম, ইহারা আসলে অন্য জাতের অমানুষ।
(চলিবে...)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
Stellar work there eveneory. I'll keep on reading.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন