'একটা টাকা খুচরা দেন' বলে দুইটা দু'টাকার নোট ভ্যানওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিলেন মাঝবয়েসী এক ভদ্রমহিলা ।
দু'মিনিটের মত নিজের পকেট হাতড়ালেন ভ্যানওয়ালা লোকটি ।শেষে বললেন, 'এক টাকা তো খুচরা নাই আফা ।'
'সারাদিন ধরে ভ্যান চালাচ্ছেন,আর একটাকা খুচরা নেই? আলতু-ফালতু কথা বলার আর জায়গা পান না?'
'আলতু-ফালতু হইবো কেন আফা? এক টাকার কয়েন বেশ কয়েকটাই ছিল। তয়,একটু আগে এক লোকরে দিয়া দিছি।'
'তাহলে এখন.......?'
'তাইলে,আফা একটা টাকা কম নেন। কী আর করবেন?' এক টাকা না থাকায় লোকটা যেন মনে মনে খানিকটা খুশি।
'কেন? আমি কম নিব কেন? আমি তো আপনাকে টাকা দিয়েছিই। আপনার কাছে টাকা নেই। এটা আপনার দোষ। এইজন্য আপনি এক টাকা কম নিবেন।' কথাগুলো বেশ মেজাজ দেখিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা। এরপর ভ্যানওয়ালাকে একটা কথাও বলার সুযোগ না দিয়ে চিলের মত ছোঁ মেরে তার হাত থেকে একটা দু'টাকার নোট কেড়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। ভ্যানিটি ব্যাগে ওটা ঢুকিয়ে রেখে হেঁটে চলে গেলেন।
ভ্যান্ওয়ালা চাচা চুপ। মনে হচ্ছে, উনার গালে কেউ সজোরে ঠাস করে একটা চড় মেরে চলে গেল।
এখন বিকেল সাড়ে চারটের কিছু পর। উপরের ঘটনাটা পাঁচ-সাত মিনিটের। আমার চোখের সামনে ঘটল।
এগিয়ে এসে বয়রা বাজার জাওয়ার জন্য ভ্যানটাতে উঠে বসলাম।
আরেকজন লোক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আকাশ মেঘে কালো হয়ে গেছে আর আমার্ও ব্যাচে যেতে লেট হয়ে যাবে। না পেরে বললাম, 'টান দেন,চাচা। ঝুম বৃষ্টি নামবে। ভিজে জাব তো।'
'দেহি, আরেকজন পাই কি না।'
'আমার পাঁচটায় পড়া। দেরী হয়ে যাবে।'
এবার আর কোন কথা না বলে ভ্যান টান দিলেন।
একটু আগের ঘটনায় তার যে বেশ মন খারাপ মন খারাপ বুঝতে পারলাম।
যে কারণে, কিছু সময় পর বলতে লাগলেন, 'কি যে জামানা আইলো! যার যত আছে, তত চায়। আর যার নাই, তার কাছ থেইক্যা গলা টিইপ্যা নেয়।'
আমি একটু আগের ঘটনা যে দেখেছি, উনি সেটা খেয়াল করেছিলেন। বললেন, 'একটা টাকা আমারে বেশী দিলে উনার কি হইতো? রাইতে খাওন কম পড়তো? না কাপড়-চোপড় পরতে সমস্যা হইতো? আল্লাই জানে।'
কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। লজ্জা লাগছে। মহিলাটা আমাদের শ্রেণীর্ই একজন প্রতিনিধি ছিল। তার এই কাজে লজ্জা লাগার্ই কথা।
বেশীক্ষণ চুপচাপ থাকা যায় না। তাই বললাম, 'কিছু মানুষ এই রকম হয়। আল্লাহ এদের এইভাবেই বানান। নাহলে তো সমাজে খারাপ মানুষের মর্ম বুঝতাম না। শুধু ভালো মানুষ থাকলে তো কোন কষ্টই থাকতো না। কিন্তু এদের দেখলে বোঝা যায়, মানুষ কেমন নিচু জাতের হতে পারে।'
আমার এই জ্ঞানগর্ভ মার্কা কথা যে উনি কিছুই বুঝলেন না, বুঝতে পারলাম।
'অত-শত বুঝি না রে, বাপ। এইটুক বুঝি যে উনি যদি একটাকা কম নিত,উনার কোন ক্ষতি হইতো না। তয় আমার কামে লাগতো।' গলায় কিছুটা করুণ ভাব।
'কী কাজে লাগবে,চাচা?'
'ছোড পোলাডার কাইল রাইত থেইক্যা জর। সকালে বাড়িত তে বেরোনোর সময় দেখছি, গা পুইড়া যায়। ডাক্তারের কাছে নিমু। তয়, দুই-আড়াইশ টাকা তো দরকার। ডাক্তারের ফিস আবার ওষুধের দাম। এই জন্য আইজ দুপুরে বাড়িতেও খাইতে যাই নি।' ভ্যানে প্যাডেল মারতে মারতে বললেন চাচা। গলার স্বরে কান্নার ভাব এসে গেছে।
ঠিক এরকম মুহুর্তে ঝুম করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ব্যাগে ছাতা ছিল। বের করলাম না। আমি ছাতা মাথায় ভ্যানে বসে আছি আর চাচা বৃষ্টিতে ভিজে ভ্যান চালাচ্ছেন,ভাবতেই কেমন জানি লাগলো। অন্যদিন হলে হয়তো কিছু মনে হতো না। তবে এই মুহূর্তে আমার বিবেক বাধা দিল। মোবাইলটা ব্যাগে রেখে, ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুললাম।
'কয় টাকা জোগাড় হইছে,চাচা?'
'এহন পর্যন্ত দুইশো বিশ টাকা হইছে।'
'আপনার বড় ছেলে কি করে?'
'তিন-চাইর বছর হইলো তার খোঁজ নাই।'
'কই গেছে?'
'কাজ শিখাইতে ঢাকা পাঠাইছিলাম। দু-তিনমাস যোগাযোগ ছিল। এরপর হঠাৎ আর খোজ নাই। কই গেছে আল্লায় জানে।'
খেয়াল করলাম চাচার দিকে। বয়সটা কি রকম বলি? মাঝবয়সী,আমার আব্বুর মত বয়স হবে। মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। তবে কাঁচা দাড়ির সংখ্যা খুব্ই কম। মাথার চুল বাবড়ি ঝোলানো। পয়সার অভাবে চুল কাটাতে পারেন না-দেখলেই বোঝা যায়।
'বাড়িতে কে আছে?' জিজ্ঞেস করলাম।
'বউ আর ছোড পোলা।' আমার দিকে ফিরে চাইলেন, 'বার-তের বছর হইবো।'
'বাপ,জোরে টান দিই? বৃষ্টি তো বাড়তাছে।'
'দেন,চাচা।'
শেষ দু'মিনিট আর কোন কথা হল না।
এর ভিতরেই বয়রা বাজার চলে আসলাম। বৃষ্টিতে চুপুচুপ হয়ে গেছি। যাকে বলে কাক ভেজা। ভাড়া দেবার জন্য মানিব্যাগ বের করলাম।
হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো।
পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে বাড়িয়ে দিলাম।
'খুচরা দাও,বাপ। এতো বড় নোট ভাংতি নাই তো।'
'খুচরা তো নাই,চাচা। এক কাজ করেন। পুরোটাই রেখে দেন। আর এখন বাড়ি যান। ভ্যান চালানোর দরকার নাই আজকে। বাড়ি যেয়ে ছেলেকে নিয়ে তারাতারি ডাক্তারের কাছে যান।'
'কী কও,বাপ? তুমি ইস্টুডেন্ট মানুষ। পঞ্চাশ টাকা অনেক। তোমার সমস্যা হইবো।'
'কোন সমস্যা হবে কয়েকটা দিন হেঁটে যাতায়াত করবো। ম্যানেজ হয়ে যাবে।'
'তাও বাপ.......'
'আর বইলেন না তো। রাখেন ওইটা' গলায় আবদারের সুর নিয়ে বললাম।
বৃষ্টি হচ্ছে।
ঝুম ঝুম শব্দে।
মুষলধারে বৃষ্টি।
রাস্তার কোণে আমি আর লোকটা।
কোন লেখক যেন বলেছিল,বৃষ্টির ভেতর কাঁদলে চোখের পানি বোঝা যায় না। কিন্তু আমি ঠিক্ই মানুষটার চোখের পানি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
আনন্দ অশ্রু।
তুমি যখন যা আশা করো,তার থেকে বেশি পেলে দেখবে চোখের কোণটা ভিজে উঠেছে। এটা পৃথিবীর একটা নিয়ম।
বৃষ্টির পানি আর চোখে জল কখনো এক হয় না। মিশে যায় না। আলাদা করে ঠিক্ই বোঝা যায়।
পঞ্চাশ টাকার নোটটা চাচার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘুরে চলে আসলাম।
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁঠছি। নিজেকে হঠাৎ কোন উপন্যাসের নায়ক মনে হতে লাগলো।
চোখের কোণটা ভিজে উঠতে শুরু করেছে। আমি জানি,উনি এখন্ও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। পেছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাকাবো না। আমার চোখের পানিও যদি উনি দেখে ফেলেন!
তিন দিন পরের কথা,
কেমিস্ট্রি ব্যাচ শেষ করে আসছি। আজ্ও বৃষ্টি হয়েছে। ব্যাচ শেষ করে সাকিবের সাথে গল্প করতে করতে হাঁটতে হাঁটতে আসলাম।
বয়রা বাজার এসে, ও বাড়ি চলে গেলো। আমি নানাবাড়ি যাবো। এজন্য,ভ্যানস্ট্যান্ডের কাছে যেয়ে ভ্যানে উঠবো ভাবলাম।
গত দু'দিন ধরে আমি সেই চাচাকে খুঁজচি। হঠাৎ কী মনে হলো! ভাবলাম, হেঁটেই যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। হাঁটা শুরু করলাম।
কিছুদুর যেয়ে রাস্তায় আবার সেই লোকটাকে দেখলাম।
সেই চাচা।
তবে আজ সাথে ভ্যান নেই। হাঁটছেন।
এগিয়ে যেয়ে ডাক দিলাম, 'চাচা!'
ফিরে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনার ছেলের অবস্থা কী?'
হঠাৎ রাস্তায় আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। ভাবলাম, খুশির কান্না।
যাক,আমি একটা ভালো কাজ হয়তো করেছি। চাচার ছেলেটা সুস্থ আছেন।
'আরে চাচা। আগে বলেন, আপনার ছেলে সুস্থ হয়েছে তো?'
'হ,বাপ। চিরকালের জন্য সুস্থ হইছে।'
'মানে কী,চাচা?'
'পোলাডা মইরা গেছে,বাপ। ওইদিন তুমি ক্ওনের পর্ই বাড়িত গেছি। দেহি, মা আর পোলায় জড়াইয়া ঘুম পড়ছে। পোলারে ডাকি, ওঠে না। গায়ে হাত দিয়া দেহি, গা বরফ। পোলার মারে ডাকি। তার গায়ে হাত দিই। সেও বরফ। দুইজনে ভালোয় ভালোয় চইল্যা গেছে। আমারে কষ্টে রাইখ্যা চইল্যা গেলো।'
কথাগুলো শোনার পর মনে হলো, স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হায় আল্লাহ! তুমি এটা কী করলে?
'ওইদিন তোমার আগে আরো দুইজনের কাছে টাকা চাইছি। দেয় নাই। তুমি দিলা। তাও কামে আইলো না।'
এই মানুষটাকে আমি কী করে সান্তনা দিবো?
আল্লাহ,তুমি কেন এইরকম করলা?
'আমার সব গেছে,বাপ। দুই পোলা,বউ। সব। কী নিয়া বাঁচমু আমি? কিসের আশা নিয়া? মইরা যাই। তাইলে অন্তত কষ্ট সহ্য করতে হইবো না।'
'চাচা,আমার সাথে চলেন। মরে গেলে তো সব শেষ। এত কষ্ট যখন আপনার জীবনে আসছে। আল্লাহ কোন সুখ তো দিবেন্ই। অন্তত সেই আশায় বাঁচেন।'
জানি না, কী বললাম? কেন বললাম? কী জন্যে বললাম? কোন সান্তনা দিলাম?
জানি না। সত্যিই জানি না।
চাচাকে সাথে নিয়ে পথ ধরে এগোলাম।
আমার চোখ আবার ভিজে গেছে। এটা আনন্দ অশ্রু না।
আবার ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।
এক পৃথিবীর কত রুপ!
কি নিষ্ঠুর রুপ!
আর মানুষগুলোও!
যদি সেইদিন আমার আগে অন্য কেউ সাহায্য করতো। হয়তো ছেলেটা বেঁচে থাকতো।
এমন কী হতো সেসব লোকদের?
আমার ছোট মাথায় এত প্রশ্নের জবাব নেই। এখন একটাই চাওয়া, হে খোদা! তুমি মানুষটাকে বাঁচার একটা আশা দাও। আশা ছাড়া কোন মানুষ বাঁচতে পারে না।
পরিশিষ্টঃ চাচাকে নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে রাখি। আব্বুকে বলে আমার দুর সম্পর্কের এক মামার ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।
বছর্খানেকের মাথায়,চাচার বড় ছেলে ফিরে আসে। তাকে ইন্ডিয়া পাচার করেছিল। পালিয়ে বর্ডার ক্রস করে বেনাপোল দিয়ে খুলনা আসে। এরপর চাচাকে খুঁজে বের করেছে।
ছেলেকে এক বছর কাজ শেখানোর পর, বাপ-বেটা দু'জন মিলে বড়সড় একটা ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান দিয়েছে। সামনের বছর ছেলেকে বিয়ে দেয়ার চিন্তা করছেন। তার জন্য পাত্রী ও খোঁজা শুরু করেছেন।
বলা যায়, এখন তারা বেশ সুখে শান্তিতেই আছেন।
সামান্য একটা আশা, মানুষের বেঁচে থাকার শেষ ভরসা।
শানে নুযুলঃ গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। তবে পরিশিষ্টটুকু কাল্পনিক। সেই চাচাকে ঐ দিন বাড়ি নিয়ে আসতে পারি নি। কোথায় আছে তাও জানি না।
তবে মানুষ সুখের কল্পনা করতে ভালোবাসে। এই জন্য পরিশিষ্টটার ভিতর সুখের কল্পনা ভেবেছি
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন