|
আরণ্যক রাখাল
|
|
অনুবাদ গল্প- ক্যাট ইন দ্যা রেইন
04 July 2015, Saturday
হোটেলটায় শুধু মাত্র দুইজন অ্যামেরিকান থেকে গিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে তাদের ঘরে যাওয়া আসার পথে দেখতে পাওয়া কাউকেই তারা তেমন চেনে না। তারা দ্বিতীয়তালার সমুদ্রমুখী একটা ঘর নিয়েছে। সেখান থেকে শহরের পাব্লিক গার্ডেন আর ওয়ার মনুমেন্ট দেখা যায়। পাব্লিক গার্ডেনের সবুজ পামের মাঝে কিছু বেঞ্চ আছে। আকাশ ভালো থাকলে একজন চিত্রি ইজেলহাতে সেখানে বসে থাকেন। চিত্রি পাম গাছগুলো কিভাবে বাড়ছে দেখতে পছন্দ করেন, আর পছন্দ করেন বাগান ও সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা উজ্জ্বল রঙের হোটেলটা দেখতে।
ইটালিয়ানেরা অনেক দূরদূরান্ত থেকে আসছে যুদ্ধের এই মনুমেন্টটা দেখতে। ব্রোঞ্জের তৈরি মনুমেন্ট- জ্বলজ্বল করছে বৃষ্টিতে।
বৃষ্টি পাম গাছগুলো থেকে ফোটায় ফোটায় পড়ছে। জল জমে গিয়েছে নুরিপাথরের তৈরি পায়ে চলার পথটিতে। ঢেউ এসে বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ছে আবার সৈকতে পিছলে যাচ্ছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। মোটর গাড়িগুলো চলে গিয়েছে সৌধটার চত্বর ছেড়ে। ক্যাফেটার ডোরওয়েতে দাঁড়িয়ে একজন ওয়েটার ফাঁকা সেই চত্বরটা দেখছে।
জানালায় দাঁড়িয়ে অ্যামেরিকান স্ত্রীটি বাইরে তাকিয়ে আছে। বাইরে ঠিক জানালাটার নিচেই একটা বিড়াল কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে সবুজ একটা বেঞ্চের নিচে ফোটা ফোটা বৃষ্টিতে। বিড়ালটা নিজেকে আটোসাটো করে রাখতে চেষ্টা করছে, যাতে তার গাঁয়ে বৃষ্টির ফোটা না পড়ে।
“আমি বাইরে গিয়ে ঐ ছোট্ট বিল্লিটাকে নিয়ে আসছি”, স্ত্রীটি বলল।
বিছানায় বসেই স্বামী ভদ্রলোক বলল, “আমিই বরং এনে দিচ্ছি”
“না না। আমি আনবো। কিটিটা একটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে আছে- নিজেকে শুকনা রাখতে। কত্তো কষ্ট পাচ্ছে বেচারা!”
স্বামীটি “ভিজে যেও না আবার” বলে দুইটা বালিশে শরীর এলিয়ে পড়তে থাকল।
স্ত্রীটি নেচে নামল সিঁড়িবেয়ে। অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হোটেলমালিক তাকে মাথা ঝাঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন। তার ডেস্ক একদম অফিসের শেষ প্রান্তে। বয়স হয়েছে লম্বা এই লোকটার।
“এল পিওভ-বৃষ্টি হচ্ছে” স্ত্রীটি বলল। তার হোটেল-কিপারকে ভালো লাগলো।
“সি সি সিনোর, ব্রুত তেম্প- আজকের আবহাওয়াটা যাচ্ছেতাই” তিনি তার ডেস্কের পিছনে ছোট্ট রুমটার একদম শেষ প্রান্ত থেকে বললেন। তাকে ভালো লাগলো স্ত্রীটির। সে যেভাবে- অত্যন্ত গম্ভীরভাবে অভিযোগটি গ্রহণ করল- সেটিও স্ত্রীটির ভালো লাগলো। হোটেল-কিপারটির কঠোর শ্রমী মনোভাব পছন্দ হোল তার। যেভাবে তাকে সেবা দেয়া হচ্ছিল সেটাও মনপুত হওয়ার মতো। হোটেল-কিপারের বয়স বেশ লাগল তার, ভালো লাগল তার গম্ভীর মুখ আর বড় বড় হাতদুটি।
সে দরজাটি খুলে বাইরে তাকাল। বৃষ্টি মুষলধারে পড়ছে। একজন রাবারকোট পরিহিত ফাঁকা চত্বরটা পেরিয়ে ক্যাফের দিকে যাচ্ছিল। বিড়ালটার ডান দিকে থাকার কথা। সেটা হয়তো কোন চালের নিচে চলে গেছে।
যখন সে ডোরওয়েতে দাঁড়াল পিছন থেকে পরিচারিকা এসে ছাতা মেলে ধরল, সেই পরিচারিকাটি যে তাদের রুম পরিষ্কার করে।
“এই বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হবে না, সিনোর” মুখে হাঁসি ঝুলিয়ে ইতালিয়ানে বলল সে। মনে হচ্ছে, হোটেল-কিপারই একে পাঠিয়েছেন।
পরিচারিকাটি তার মাথায় ছাতা ধরে আছে- সে নুরিপাথুরে সেই পথটি দিয়ে হেঁটে গেল যতক্ষণ না জানালাটির নিচে পৌঁছায়। টেবিলটা সেখানেই আছে, আরো বেশি সবুজ দেখাচ্ছে বৃষ্টিতে আচ্ছামতো ভেজার পর। কিন্তু বেড়ালটি চলে গেছে। স্ত্রীটিকে হঠাৎ খুব হতাশ মনে হোল। পরিচারিকাটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“হা পেরদুতো কুয়ালছে কোসা, সিনোর”
“এখানে একটা বিড়াল ছিল” অ্যামেরিকান মেয়েটি বলল।
“বিড়াল?”
“সি এল গাত্তো”
“বিড়াল?” পরিচারিকার কণ্ঠে কৌতুক। “বৃষ্টিতে বেড়াল?”
“হ্যাঁ” সে বলল। “টেবিলটার নিচে” “ওহ, আমার এটা খুব দরকার ছিল, খুব দরকার ছিল বিল্লিটা”
সে ইংরেজি বললে পরিচারিকাটির মুখ শক্ত হয়ে যায়।
“আসুন, সিনোর” সে বলল। “আমাদের ভিতরে যাওয়া উচিৎ। আপনি ভিজে যাচ্ছেন”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে” বলল অ্যামেরিকান মেয়েটি।
তারা দরজাটি পেরিয়ে গেল নুরিপাথরের তৈরি রাস্তাটা বেয়ে। পরিচারিকাটি ছাতাটা বন্ধ করতে বাইরেই থেকে গেল। মেয়েটি যখন অফিসরুমটি পেরিয়ে যাচ্ছিল মালিক আবার তাকে বো করলেন। মেয়েটিকে খুব ছোট আর হতাশ মনে হোল। সে সিঁড়ি বেয়ে দরজা খুলল ঘরের। জর্জ এখনও বিছানায়- পড়ছে।
“বিড়ালটা পেয়েছ?” সে জিজ্ঞেস করল বইটি নামিয়ে।
“কোথায় যেন চলে গেছে”
“কি আশ্চর্য! কোথায় গেল ওটা!” সে বলল। সে তার চোখকে বিশ্রাম দিচ্ছে- অনেকক্ষণ পড়ছিল সে।
বিছানায় বসল মেয়েটি।
“আমি খুব করে চাইছিলাম ওটা, জানো” ও বলল। “জানিনা কেন আমি এতো চাচ্ছিলাম ওটা। কিন্তু আমি খুব চাচ্ছিলাম ঐ বিল্লিটা- ছোট্ট কিটিটা। ওর নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজতে খুব কষ্ট হচ্ছে”।
জর্জ আবার পড়তে লাগল।
সে উঠে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসল। হ্যান্ড গ্লাসটা দিয়ে নিজেকে দেখল সে। প্রথমে শরীরের বাম, তারপর ডানদিক। সে তার গলা আর মাথার পিছনের দিকটা ভালো করে তাকিয়ে দেখল।
“চুলগুলো বড় হতে দিলেই ভালো হয়, তাই না?” সে তার নিজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
বিস্ময়বালকের মতো কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে জর্জ।
“তুমি যেমন আছো, তেমনই আমার ভালো লাগে”
“আমাকে একদম ছেলেদের মতো দেখাচ্ছে এই ছোট চুলে” বলে মেয়েটি। “একটুও ভালো লাগে না আর”
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে”
ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে যায় মেয়েটি, জানালায়। অন্ধকার হয়ে আসছে পৃথিবী- মেয়েটি দাঁড়িয়ে দেখে।
“এবার থেকে আমি খোপা করবো চুলে, একদম টেনে খোপা করবো, অনেক বড় হবে সেটা, দেখো- সারাদিন আয়নায় বসে থাকবো” বলে মেয়েটি অন্ধকারে তাকিয়ে। “ আর আমার কোলে একটা ছোট্ট, খুব ছোট্ট বিল্লি থাকবে, সেটাকে একটু খোঁচালেই, ম্যাও ম্যাও করবে”
“কি” জর্জ বলে।
“আর আমার একটা ডাইনিং টেবিলও চাই- সেখানে রুপোর থালাবাসন থাকবে। আর হ্যাঁ, মোমবাতিও জ্বলবে সেখানে একটা” মেয়েটি এখনও জানালায়।
“বসন্ত কালে, আমি আয়নার সামনে বসে চুল বাঁধবো, আর আমার কোলে একটা বিল্লি থাকবে, আর হ্যাঁ, আর কিছু নতুন কাপড়ও লাগবে”
“ওহ, বকবক থামাও তো, পড়তেও দেবে না দেখছি”। জর্জ আবার পড়া শুরু করে।
জানালায় বাইরে তখন পুরোপুরি অন্ধকার, বৃষ্টি ঝরছে পামগাছগুলোর পাতা থেকে।
“আমার যেভাবেই হোক একটা বিড়াল চাই, চাই, চাই” সে বলে, “আমার এখুনি বিড়াল চাই একটা, এখুনি। তুমি যদি আমাকে চুল বড় রাখতে না দাও, তবে একটা বিড়াল এনে দাও আমাকে, এক্ষুনি”
জর্জ শুনছিল না। মেয়েটি বাইরে তাকিয়ে আছে এখনও, সামনের চত্বরে এখন আলোর রশ্মি খেলা করছে অন্ধকার দূর করে।
কেউ একজন দরজায় নক করছে।
“আভান্তি” জর্জ বই থেকে মাথা তুলে বলে।
সেখানে সেই পরিচারিকাটি দাঁড়িয়ে। সে একটা বিড়াল ধরে আছে। টর্টোইস সেল বেড়াল একটা।
“এক্সকিউজ মিঃ” বলে পরিচারিকাটি, “মালিক এটা পাঠাতে বলেছেন”
মুলঃ- আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন