হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ঘটনাটা একেবারেই অশ্রুতপূর্ব বিস্ময়কর । কিন্তু এটাও তো মানতে হবে যে, কখনো কখনো এমন কিছু বিস্ময়কর ঘটনা সত্যও হয়ে থাকে । এ হলো গিয়ে এক নেংটা পেতনির ঘটনা ।
সে দিনভর ঘন বর্ষায় ভিজে ভিজে পানির নালার ভেতর চকমকি পাথর খোঁজে । আর রাতভর সেই পাথর মুঠির মধ্যে নিয়ে নূপুরের মতো ঘুঙুর ঘুঙুর বাজায় । পাথরের ঘর্ষণে যেই না জোনাকির মতো একটু আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরিয়ে আসে, অমনি তার সে কি উচ্ছ্বাসের হাসি ! একবার সে হাসি শুরু হলে আর থামে না, কমেও না, একটু একটু করে বাড়তেই থাকে । বিজলির মতো থেকে থেকে আসা সে হাসির বিচ্ছুরণ বহুদূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়, শুনতেও পাওয়া যায় ।
অথচ আমরা ভাবতাম, বর্ষায় আমাদের ওপর যখন রহমতের বারিধারা নেমে আসে, তখন আকাশের নক্ষত্ররা আনন্দে ঝুমুর ঝুমুর আওয়াজ তোলে । পাশেই ঝিলের ওপরে ভেসে থাকা চাঁদটা ঝুঁকে এসে পানির পদ্মকে চুমু খায় । তারপর অনাহুত লজ্জায় সে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে । কখনো আবার মেঘের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে, ঠাণ্ডা বাতাস জলপরীদের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উপত্যকার দিকে ধেয়ে চলেছে । পাহাড়ের নৈশব্দ চিরে তখন গুন গুন গুঞ্জন ওঠে । এই গুঞ্জন ধ্বনির ফাঁকেই চারিদিক আলো করে ফোটে এক থোকা লাল গোলাপ । মনে হয়, ক’দিন ধরে সেই গোলাপের গায়ে অশুভ ছায়া পড়েছে ।
প্রথম দিকে, যখন এই নির্জন শ্মশানের মতো জায়গাটায় সে এসেছে, ততক্ষণে শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা রাত দ্বিপ্রহরের পাঠ শেষ করে তৃতীয় প্রহরের দিকে এগিয়ে গেছে । আকাশে মেঘের আনাগোনা তখনো চলছে এবং আরেকবার মুষলধারে নামবে বলে ত্রাহি ত্রাহি গর্জন করছে মেঘ ।
এমন শীতল সময়ে পথের পাশে গড়া ছনের ডেরায় ঘুম ঘুম চোখে বসেছিলোে আমাদের গাঁয়ের এক রাখাল । অলক্ষুণে ছায়াটা তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করামাত্রই রাখালের গা কাঁটা দিয়ে উঠলো । ভূত-ভূত বলে আটালি-পাটালি চিৎকার করতে করতে রাখাল দিলো ভো দৌড় । ভয়ে ছুটতে ছুটতে সে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো । দ্বিতীয় রাতেও এ অঞ্চলের অনেক কামলা, কৃষক আর রাখালেরা বহুদূর থেকে ছায়াটাকে সেই চকমকি পাথর তুলতে দেখে । সুতরাং ঘটনাটা যে মিথ্যা নয়, তা মোটামুটি সবার গোচরে পরিষ্কার হয়ে যায় ।
সেদিনই বিত্তবানদের প্রতিটি ঘরের সদর দরজায় তাবিজ ঝুলানো হয় । গরিবের ঝুপড়ির আশেপাশে ছিটানো হয় পির সাহেবের দম দেয়া পানি । শেষে গাঁয়ের তশিলদার সাহেব এলাকার সবচে’ বড় মৌলবি হুজুরকে ডেকে জলসা বসিয়ে বলেন- হুজুর, এখানে তিনবার কোরান পড়ে বখশে দেবেন, আর ভরপেট মিষ্টান্ন খেয়ে যাবেন...
প্রতিবেশি শিখ পরিবারের সন্ত সিং ক’দিন ধরে ঘরেই বন্দি হয়ে ছিলো কোনো এক অজানা কারণে । রাওয়ালপিন্ডিতে পেতনির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে শুনে সে চট করে বাইরে বেরিয়ে আসে । তারপর বাহিরের দিক থেকে দরজায় একটা পেটমোটা তালা ঝুলিয়ে, তারপর সেই তালার ওপর ক’ফোঁটা সিঁদুর ঢেলে দিয়ে খিড়কি গলিয়ে সে ভিতরে পালিয়ে যায়, আর তার দেখা মেলে নি । আর তার পড়শি মাজারপ্রেমী চুমি লাল ভূত-প্রেতের দোষ কাটাতে দুই চার দশদিকের সাধু-ফকিরকে জমায়েত করে এক বিরাট ওরস-ভজনের আয়োজন করে ফেলে । তাদের বিচিত্র গীত-সঙ্গীতের ভনভনানি ভিমরুলের মতো আকাশ-পাতাল মুখর করে তোলে ।
সেই দিন থেকে এলাকার মাদরাসা-মক্তবের সব ক্লাস বন্ধ । কেননা, গাঁয়ের বধূরা তাদের কলিজার টুকরা সন্তানদেরকে কলিজার মধ্যেই পুরে রেখেছে আর মসজিদের মক্তব কিংবা মাদারাসার বারান্দায় বসে সবাই মিলে সেই অলক্ষুণে পেতনির ঠিকুজি বর্ণনা করে চলেছে ।
এদিকে সপ্তাহ যেতে না যেতেই সে গাঁয়ের এক ছেলে মুরাদ এসে চাউর করে দিলো- ওটা পেতনি না, পেতনি না; মানুষ, মানুষ ।
মৌলবি সাব বললেন- ভাই, তুমি কী এমন জানো বলতো, হুট করে বলে ফেললে যে, ওটা পেতনি না, মানুষ । শোনো, বাদশা সেকান্দরের জমানায় ওই পাহাড়ের পাশের কালীতলায় একটা হিন্দু পেতনি এক ইউনানি সৈন্যের মাথা ফাটিয়ে মগজ বের করে খেয়েছে । তখন থেকে কালীতলার ওই দিকে কেউ ভুলেও পা দেয় না । এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, ঝড়-তুফানের রাতে একটা নেংটা পেতনি ওখানে টিমটিমে প্রদীপ জ্বালে, জোরে জোরে তালি বাজায় । তার ভয়ানক অট্টহাসির শব্দও শোনা যায় প্রায়ই । বিশ্বাস না হয় তো, তোমাদের মাতব্বর সাবের কাছে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো ।
গ্রামের মাতব্বর সাহেব আবার ঘটনাক্রমে মুরাদের দাদা । দাদা তো মাশাল্লা কোরানের গুটিকতক আয়াত থেকে শুরু করে আবাবিলের চঞ্চুর কেচ্ছা পর্যন্ত, এমনকি নানান সুরা তেলাওয়াতের ফজিলত ও শেফাদায়ক ভেষজ বানানোর তরিকা পর্যন্ত ঠোটস্ত জাননেওয়ালা । তিনি গাঁ-ভরা লোকজনের মধ্যে চেঁচিয়ে বললেন- কোন মায়ের বেটা মৌলবি সাবের কথা বিশ্বাস করে না, সাহস থাকলে সে কালীতলার টিলায় উঠে দেখাক । তিনি আরো বললেন- বাদশা আকবর দিল্লি থেকে একবার শুধু এই জন্যেই এখানে এলেন যে, এই কালীতলায় কী রহস্য আছে, সেটা সে দেখবে । কিন্তু ওখানে গিয়ে ভয়ে ভিড়মি খেয়ে পড়েছে বাদশা এবং সেই ভয়েই শেষ পর্যন্ত আকবর মারা গেছে ।
মুরাদ বললো- আমার কথাটা তো একবার শুনবেন ..
দাদা বললেন- হ্যাঁ ভাই, তোমরা মুরাদের কথাও একটু শোনো । এ তো আর তোমার-আমার মতো মূর্খ না, তাই না, যে শোনামাত্রই সে হাঁকডাক দিয়ে তা-ই বিশ্বাস করবে । এরা হলো গিয়ে শিক্ষিত পণ্ডিত ছেলে-ছোকরা । এরা এখন কলেজে ইংরেজি পড়ে গাঁয়ে এসে আমাদের মাতৃভাষা শেখায় ! বলো ভাই মুরাদ, বলো ।
মুরাদ বললো- ওটা কোনো পেতনি না, দাদা; একজন জলজ্যান্ত মানুষ । বরং বলতে গেলে অত্যন্ত রূপবতী এক মহিলা । এত লম্বা আর ঘন চুল তার, মনে হয় যেনো গাঢ় ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে আছে একটা বিরাট কালো কুচকুচে শামুক । গায়ের রঙ চাঁদের কিরণের মতো ধবধবে ফরসা । চোখ দু’টা বাদামি । চোখের মণি দুটি চমৎকার পাথরের মতো । চোখের পাপড়ি এমন সূচালো আর দীর্ঘ, আর এমন ঢঙে সে চোখের পলক মারে মনে হয় যেনো ধনুক থেকে তীর......আর...
দাদা মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললেন- থেমো না, নাতি.. চালিয়ে যাও...
মৌলবি সাহেব এতক্ষণে কয়েকশ’বার তাসবির দানা জপে শেষ করেছেন ।
মুরাদ বললো- দাদা, ওই মহিলার দুই ভ্রুর মধ্যিখানে একটা নীল টিপও আছে ।
এটা শুনে দাদা নিজেকে কিছুটা সামলে বসে পড়লেন । মৌলবি সাহেব তসবিটা মুঠির মধ্যে নিয়ে হাত উঁচিয়ে বললেন- আমি বলছি না যে, কালীতলার যেই পেতনিটা এক ই্উনানি সৈন্যের মস্তক উগলে খেয়েছে, এই পেতনিটাই সেই পেতনি । কিন্তু তার কপালের এই যে টিপ, এটা তো নিশ্চয় হিন্দু মহিলার চিহ্ন । আর হিন্দু মানেই ভূত-প্রেতের আছর সেখানে আছে ।..খোদার কসম খেয়ে কও তো মুরাদ, সে যে হিন্দু, এতে কি কোনো সন্দেহ আছে তোমার?
দাদা বললেন- মৌলবি সাব, দশকথার এক কথা বলে দিয়েছেন । সুতরাং এবার যাও মুরাদ, সবাইকে নিয়ে ঘরে গিয়ে নফল নামাজ পড়ো । শোকর করো যে, তুমি জ্যান্ত আসতে পেরেছো ।
-এরপরও আমি বলছি যে, সে কোনো পেতনি না, তাকে আমাদের সাহায্য করা দরকার ।
মুরাদের কথায় ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা ছিলো । সে বললো- যদি পেতনি এরকমই হয়ে থাকে, তাহলে সেই পেতনির কাছে এক্ষণই কালীতলা যেতে তৈরি আছি আমি । কিন্তু দাদা, আমি আস্থার সাথে বলতে পারি, সে ভূত-পেতনি জাতীয় কিছু না ।
-তাহলে কে সে, বলো । দাদা উপস্থিত লোকজনের প্রশ্নবোধক চাহনির জবাবে এই প্রশ্ন করলেন ।
-কেউ একজন হবে ।..মুরাদ বললো- তবে আমি নিশ্চিত সে আমাদের অঞ্চলের কোনো মহিলা হবে । আমি মানুষের বর্ণ চিনি দাদা । অনেক দেশ ঘুরেছি । ইরানিদের দেখেছি, ইরাকে, মিশরেও দেখেছি কিন্তু এ রূপ তাদের কারো সঙ্গে মেলে না । তার চেহারার মধ্যে কাশ্মিরি আপেলের রঙ আছে, গমের মতো লালমেটে বর্ণও আছে, শরীরের কোথাও কোথাও নদীতীরের বালির ফ্যাকাশে ভাবও আছে, কোথাও আবার সোনাধানের সোনালী আভাও মাখা আছে । এই রকম বর্ণের মানুষ কেবল এই পাক-ভারত উপমহাদেশে, কেবল এই হিন্দুস্তানেই পাওয়া যায় ।
-হিন্দুস্তানে আরো বহুকিছু পাওয়া যায়, জনাব...
তশিলদারের ছেলে মহিম লাহোরের কোনো এক কলেজে পড়ে । ইস্টারের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছে । ভারি কোনো বইয়ের পাতা উল্টানোর মতো স্বরে সে বললো- আরো বহুকিছু পাওয়া যায় হিন্দুস্তানে । এখানে বাংলার পচাছনের তৈরি ঘরও আছে, বীর-বাহাদুরের এতিম সন্তানও আছে । আছে সারা হিন্দুস্তানের সেই সকল বিধবা নারী, জলে কিংবা স্থলে যাদের ইজ্জত রক্ষার যুদ্ধে নিহত পুরুষদের লাশের ওপর শকুন-হাঙর আর কীটপতঙ্গের মচ্ছব হয়েছে । তাদের রক্তের স্রোত উপমাহদেশের ফ্যাসিজমকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে । যাদের খুনের সলতে থেকে কর্পুরের সুবাসিত প্রদীপ জ্বলেছে সারা হিন্দুস্তানে । তোমাদের অমৃতসর, রাওয়ালপিন্ডি আর মুলতানও কোনো অংশে বাদ পড়েনি । অথচ আজো এখানে নারীদের শুধু এই কারণে ধর্ষিত হতে হয় যে, তার কপালে কেনো একটা নীল টিপ আছে । আজো এখানে বাচ্চাদের....
মহিমের কথা শেষ হয় নি, তার মাঝেই দাদা বলে উঠলেন- না না ভাই, নমিতার বাচ্চাদের কিছু হয় নি । তারা ভালো আছে । তার বাচ্চাদের এখনো কেউ কিছু বলে নি...
মহিমের দীর্ঘ বক্তৃতায় দাদা মনে হয় ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন...তাই বুঝে উঠতে পারেন নি, কী বলতে কী বলে ফেলেছেন ।
মৌলবি সাহেব চমকে উঠে বললেন- নমিতা? নমিতা কে?
দাদা এইবার হুঁশ ফিরে পেয়েছেন । উপস্থিত গাঁয়ের মানুষের স্তব্ধ দৃষ্টির সামনে আমতা আমতা করে বললেন- কালীতলার পেতনি ।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
I cannot tell a lie, that really hedelp.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন