১।
হলুদ লাইটের রাত । মুষলধারে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে । তবে এখনো তার রেশ আছে ।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, পিচঢালা রাস্তায় জমে উঠা পানিগুলো ছুটোছুটি করছে ম্যানহোলের খোঁজে, বৃষ্টির ধোঁয়াটে ভাব চারদিকে । রাফান রাস্তার কিনার ঘেঁসে হাঁটছে ।মাথায় ক্যাপ লাগান ।হাতের মুঠোয় লুকানো জ্বলন্ত সিগারেট । কিছুক্ষণ পর পর টান দিচ্ছে ।তার মন খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে । সে এক বিয়ের পার্টি থেকে ফিরছে । সেই পার্টিতে তিনটা মেয়েকে পটিয়েছে । তাদের নাম্বারও নিয়েছে ।রাত্রিকালীন কথার ক্ষুধা খুব ভালভাবেই মিটবে তার । রাফান মেয়ে পোটানোতে খুব এক্সপার্ট । তাই ভেবে রাফানের মুখের কোণে ভাবের হাসি খেলা করছে ।হাতের শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা থেকে আরেকটা নতুন সিগারেট ধরাচ্ছে সে । এই আবহাওয়ায় সিগারেট টানতেই ভাল লাগে।
সিগারেট ধরাতে ধরাতে রাস্তার অপর পাশে রাফানের চোখ আটকে যায় ।একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে । মেয়েটার বয়স ১২ কি ১৩ হবে । গায়ে হলুদের উপর লাল ডোরাকাটা একটা ফ্রক । কিন্তু মেয়েটা ভিজে একদম চুপসে গেছে ।গায়ের সাথে ফ্রক লেপ্টে আছে । ফ্রকে ঢেকে না থাকা পায়ের বাকি অংশটুকু হলুদ সাদা রঙে ফুটে উঠেছে । মাথা থেকে মুখ, শরীর বেয়ে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ছে কিন্তু পানিগুলো ময়লা । মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন ময়লা গর্তে পড়ে গিয়েছে । চুলের কয়েক ভাগ মুখের উপর লেপ্টে আছে । তার ফাঁক দিয়ে সে রাফানের দিকে তাকিয়ে আছে । চোখগুলো একদম স্থির । রাফান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সামনে এগুচ্ছে , মেয়েটাও রাফানের দিকে তাকিয়ে বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে । রাফান হঠাৎ ম্যানহোলের বাঁশের সাথে ধাক্কা খায় ।বাঁশটা না থাকলে রাফান ম্যানহোলে পড়ে যেত ।রাফান নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চোখ ফেরায় মেয়েটাকে দেখার জন্য ।কিন্তু মেয়েটাকে সে আর দেখছে না । সে চারপাশ ঘুরেফিরে তাকায় ।মেয়েটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না ।পাঁচ সেকেন্ডও হয়নি সে মেয়েটাকে আর কোথাও দেখছে না । জায়গাটাও এমন নয় যে মেয়েটা এতো দ্রুত কোথাও চলে যাবে বা লুকিয়ে যাবে । রাফানের পেটটা হঠৎ মোচড় দিয়ে ওঠে । বমি বমি ভাব হচ্ছে এবং ম্যানহোলটার মুখে বমিই করে দেয় রাফান ।বমির চাপে তার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে । রাফান ভাবছে বিয়ে বাড়িতে হেবি খাবার খাওয়ার কারণেই এমন হচ্ছে । কিন্তু তার শরীর খারাপ লাগা শুরু হয় মেয়েটাকে দেখার পর থেকে । রাফান তার পেটের ধকল সামলে কোন রকমে বাসায় ফিরে আসে ।কিন্তু তার শরীরটা হঠাৎই খুব খারাপ হতে লাগলো । সে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ে নিকট রাতেই ।সাধারণত সে প্রতিদিন নিকট ভোরে ঘুমাতে যায় ।তার ঘুম আসতো মেয়েদের সাথে কথা বলতে বলতে । কিন্তু আজ তার কিছুই ভাল লাগছে না । মেয়েদের চিন্তাও মাথায় আসছে না ।
রাত দুটো । রাফান ঘুমের মধ্যে খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ।নাক দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে । তার বুক অস্বাভাবিকভাবে উপরের দিকে উঠছে আর নামছে । পুরো শরীর কাঁপছে । সেই কাঁপনে খাটও কাঁপছে । রাফানের ছোট ভাই ঘুম থেকে জেগে যায় । সে ভাইয়ার এ অবস্থা দেখে ভয় পায় । তাকে ধাক্কা দেয় । রাফান ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসে যায় ।মনে হয় যেন সে এতক্ষণ ঘুমায়নি । সে এদিক ওদিক তকাচ্ছে শুধু । দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু খুঁজছে । ছোট ভাই ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে । রাফানের পুরো শরীরে প্রচুর ঘাম ঝরছে ।তার পরনের জামা কাপড় গোসলের মত ভিজে গেছে । মুখে লালা লেগে আছে ।চোখে লাল লাল রক্ত রেখা ফুটে ওঠেছে । রাফানের কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা এই ঘরে আছে । তার শরীরে মেয়েটা এতক্ষণ গড়াগড়ি করেছে । তাকে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে ।সে এখনো হাঁপাচ্ছে ।
- ভাইয়া পানি খাবে ? পানি আনবো ? রাফান ভাইয়ের দিকে তাকায় । সে পানি আনতে যায় ।
এক মাস পর......
রাফান হসপিটালের জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে । তাকে হসপিটালে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু তার শরীরে তেমন কোন রোগ ধরা পড়েনি । তবুও তাকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছে । কারণ তার পুরো শরীরের রগ কালছে বর্ণ হয়ে ফোটে আছে । চামড়া বুড়োদের মত কুচকে গেছে ।পায়ের নখগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । চুল দিনদিন সাদা হয়ে যাচ্ছে । তার শারীরিক কোন রোগ ধরা পড়েনি তাই সাইকোলজিস্টও আনা হয়েছিল ।সাইকোলজিস্ট অনেক চেষ্টা করেও কোন কোন কুল কিনার করতে পারেননি । শেষে তিনি রিপোর্ট দেন যে, রাফানের কোন নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়নি । যদিও আমাদের অপ্রকৃতস্থ কোন বিষয়ে বিশ্বাস করার বিধান নেই তারপরও আমাকে বলতে হচ্ছে রাফানের শরীর তার দ্বারা কন্ট্রোল হচ্ছে না । আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তার মনকে কনসেনট্রেট করাতে পারিনি । তার মানসিক স্তর খুব র্যাপিডলী ড্রপ হচ্ছে । কোনভাবেই স্থির করা যাচ্ছে না । তার চোখের পাতা বন্ধ থাকলেও চোখ দুটো ভেতরে রিং এর মত ঘুরতে থাকে । তাই আমি আবারো বলছি তার মানসিক স্তর অন্য কিছুর দ্বারা চালিত হচ্ছে । আমি তারপরও কিছু ব্যায়াম এবং মেডিটেশন দিয়ে দিয়েছি ।নিয়মিত করাতে পারলে কিছু হলেও হতে পারে ।তবে আপনারা যদি অন্য কোন চিকিৎসা করাতে চান করাতে পারেন । আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কি মিন করছি ?
২।
- তোমরা আমার মাইয়ারে লইয়া এতো হিংসে করো ক্যান ? পারলে তোমাগো মাইয়ারেও তোমরা পড়াও না ! আমি কী তাতে কিছু কইছি ?
- হ, হ, আমরা দেখমো তোমার মাইয়ারে কী জজ ব্যারিষ্টার বানাও তুমি ।আমরা পোলাগোরে পড়ালেহা করাইতে পারি না আর হেতি মাইয়ারে পড়ায় !মাইয়া বড় হইছে বাসাবাড়ির কাজকামে লাগাইয়া দিবো । কিছু টাকা পয়সা ইনকাম করবো, তা না, তারে পড়ালেহা করায় । আরো কত রঙ তামাশা যে আমগোরে দেখন লাগবো ।শোন রচিমন, এহনো সময় আছে এই চাতার পড়ালেহা কইরা কইরা মাইয়াড়ার ভবিষ্যত ধ্বংস করিস না । ওরে কাইজকাম কিছু শিখা ।
- মাইয়ার ইনকাম খাওনের আমার এতো সখ নাই।আর আমার মাইয়ার ভবিষ্যত নিয়াও তোমাগোরে কেউ মাতা ঘামাইতে কয় নাই ।বাইচা থাকলে ঠিকই দেখবা আমার মাইয়া একদিন জর্জ ব্যারিষ্টারই অইয়া বাহির অইবো ।এই কতা কইয়া রাখলাম আমি ।
- আরে বাপরে হেতির কী দেমাক ! হের লাইগাই জামাই ফালাইয়া গেছে গা । বুড়ি সকিনা বিড়বিড় করতে করতে ঘরে ঢুকে যায় ।অন্যরাও যে যার কাজে মনযোগ দেয় ।
রচিমন বিবি তার মেয়ে রাবেয়াকে নিয়ে এইভাবেই ঝগড়া করে বস্তির অন্য বাসিন্দাদের সাথে । আজকে ঝগড়াটা আরেকটু বেড়েছিল । কারণ রাবেয়া প্রথম স্থান নিয়ে সিক্সে ওঠেছে । আর রসিমন বিবি কোমর দুলিয়ে ঘরে ঘরে মিষ্টি বিতরণ করছে ।রসিমন বিবির এই রঙ্গ দেখে তাই বস্তির অন্যান্য বাসিন্দাদের গা অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশিই জ্বালা করছে । তবে আজকের ঝগড়াটা রসিমন বিবির পক্ষেই ।
রসিমন বিবি রাবেয়াকে নিয়ে একা থাকে । তার সাংসারিক জীবনটা কিছুটা নাটকীয়তায় ঘেরা । যখন রাবেয়ার বয়স দুই বছর তখন রসিমন বিবি রাবেয়াকে নিয়ে তার প্রেমিক শাহজাদার সাথে স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে । কিন্তু ঢাকায় কয়েকমাস শাহজাদার সাথে সংসার করার পর সেই শাহজাদা ছকিনার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে রসিমনকে অথই সাগরে ফেলে পালিয়ে যায় ।সেই থেকে রসিমন বিবি মেয়েকে নিয়ে একাকী জীবনযাপন করছে । পুরুষ মানুষের প্রতি তার আর তেমন বিশ্বাস নেই ! এখনো বস্তির আবুইল্যা আর জইল্যা প্রেমের ফাঁদ পেতে প্রতিদিন রসিমনকে বিরক্ত করে । কিন্তু রসিমনের এতে কোন আগ্রহ নাই । মাঝে মাঝে আবুইল্যা আর জইল্যারে গালিগালাজও করে । আবার রসিমনের একা থেকেও শান্তি নাই । নারীদেহ ব্যবসায়ী মইত্যা নানা কু-মতলব নিয়ে আসে । তাকে টাকার লোভ দেখায় । অল্প পরিশ্রমে অনেক টাকা । মাঝে মাঝে রাবেয়াকে দেওয়ার কথাও বলে মইত্যা । মইত্যা বলে, রসিমনরে তুই না করলে রাবেয়ারে দে, আমার লগে অনেক বড়লোক কাস্টমারের উঠাবসা । ওরা রাবেয়ারে মত কচি মাইয়া পাইলে অনেক টাকা দিবো ।তর দুঃখের দিন শেষ হইয়া যাইবো ।তুই তো বুঝতাসস না রাবেয়া যে কতবড় সোনার টুকরা । এমন করে নিজের কপাল পুড়াইস না রসিমন । এখনো সময় আছে । তয় রাবেয়ার বয়স যত বাড়বো তত কিন্তু দাম কইম্যা যাইবো কইয়া রাখলাম । রসিমন বিবি অনেকক্ষণ মেজাজটারে ঠিক রাখছে ।ঝাটাটা হাতে নিচ্ছে মাত্র মইত্যা অবস্থা সুবিধাজনক না দেখে উঠে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে । রসিমনকে পেঁছনে আসতে দেখে সে দৌঁড় লাগায় । তবে রসিমন জানে সে কাল আবার আসবে । আবারও সেই একই প্যাচাল পাড়বো । এরা সহজে রাস্তা ছাড়ে না ।কুকুরের লেজ যেমন সারাজীবন চুঙায় ভরে রাখলেও সোজা হয় না তেমনি মইত্যার মত লোকদেরও প্রতিদিন ঝাটার বাড়ি দিয়েও আসা বন্ধ করা যায় না । কিন্তু রসিমন বিবির এর থেকে বেশি কিছু করারও নেই ।সমাজ তাকে সেই ক্ষমতা দেয়নি ।
রসিমন বিবি তিন বাসায় কাজ করে । সেখান থেকে যা টাকা পায় তাই দিয়ে মা মেয়ের ভালই চলে যায় । আবার অল্প কিছু টাকা সমিতিতেও রাখতে পারে । সারাদিনে রসিমন বিবির দম ফালানোর সময় থাকে না । তাই দিনের বেলা রাবেয়ার তেমন দেখাশোনা করতে পারে না । তবে রাবেয়ার জন্য সকালে সব ব্যবস্থা করে রেখে যায়, যেমন, সকালের খাবার, লেবুর শরবত- মেয়ে দুপুরে স্কুল থেকে ফিরলে লেবুর শরবত খাবে, আর দুপুরের খাবার । তারপরও রসিমন বিবির চিন্তার শেষ নাই, মেয়েটা ঠিকমত বাসায় ফিরলো কিনা, খাবার খেল কিনা, গোসল করলো কিনা ইত্যাদি । আর রসিমনের খাবারদাবার যে সব বাসায় কাজ করে তাদের বাসি তরিতরকারী দিয়ে হয়ে যায় । মাঝে মাঝে ভাল খাবারও পায় ।রসিমন বিবি তার মেয়েকে পড়ানোর স্বাদ জাগে এইসব বাসায় কাজ করার সুবাদে । সাহেবানদের মেয়েরা ভাল পড়াশোনা করছে, আবার কেউ কেউ অফিস আদালতে চাকরি করছে । এইসব দেখে তারও ইচ্ছে হয় মেয়েকে সাহেবানদের মত বড় করার ।সাহেবানরাও তার মেয়ের ভাল রেজাল্ট করার খবর শুনে বলে, মেয়েকে ভাল করে পড়াশোনা করাও রসিমন, এখন মেয়েরাও অনেক কিছু করতে পারে, তোমার তো মানুষের বাসায় কাজ করতে করতে জীবন যাচ্ছে, তোমার মেয়েকে যেন আর এই কাজ করতে না হয় । সাহেবানদের এইসব কথা শুনে রসিমন ড্যাবড্যাব চোখে সাহেবানদের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
রসিমন বিবির মন আজ খুব খারাপ । মুখে আচল গুঁজে কাঁদছে ।আক্কাস চাচা ফোন দিয়ে জানিয়েছে তার মা আর নেই । রসিমন বিবি যেদিন তার স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে যায় এর কিছুদিন পর সে মাকে ফোন দেয় । কিন্তু মা কোন কথা বলেনি শুধু কান্নার আওয়াজ শুনেছিল রসিমন । সেদিন থেকে মা তার সাথে আর কোন কথা বলেনি এবং তাকে বাড়ির ত্রিসিমানায় যেতেও নিষেধ করা হয়েছিল । রসিমন তখন বুঝতে পেরেছিল সে অনেক বড় পাপ করেছিল । তার স্বামী তেমন খারাপ ছিল না যে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে । কিন্তু অল্পবয়সে বিয়ে হওয়া কিশোরী রসিমন থেকে তখনো প্রেমের সুখবাতাস পুরোপুরি যায়নি । তাই সে শাহজাদার আবেগের ফাঁদে পা দিয়ে তার সর্বনাশটা করেছিল । যখন সে বুঝতে পারে তখন অনেক দেরী হয়ে যায় । তাই তাকে আজ একাকী থাকার এই দুর্বিষহ জীবন পার করতে হচ্ছে । তবে রসিমন তার পাপের শাস্তি মেনে নিয়েছি । কিন্তু আজ প্রায় দশ বছর হয়েছে সে তার মাকে দেখেনি আর আজকে মায়ের মরা মুখটাও সে দেখবে না । এই ভেবে রসিমনের কলিজা ফেটে যাচ্ছে । তাই সে মুখে আচল গুঁজে কাঁদছে ।
- মা তোমার কী শরীর খারাপ ? রাবেয়া জিজ্ঞেস করে ।
- নারে মা, আমার শইল ভাল আছে । তোমারে স্কুলে আজ কী পড়াইছে ? বাড়ির কাজগুলান ঠিক মত করছো ? মা, তোমারে অনেক বড় হয়ন লাগবো । আমি তোমার জন্য দুধ আনতে যাই । এই কথা বলে রসিমন নাক মুখ মুছে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় । রাবেয়া তার নানা বাড়ি দাদা বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানে না । তার সবকিছুই তার মা । তবে স্কুলে অন্যের বাবার কথা শুনে মাকে জিজ্ঞেস করে তার বাবার কথা । রসিমন তখন খুব বেকায়দায় পড়ে যায় । সে নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেয় যে তার বাবা মারা গেছে । এইকথা বলাটা রসিমনের জন্য খুব কষ্টের কিন্তু তার কিছু করার নেই ।
৩।
রাফান হসপিটালের বেডে বসে আছে । সে ঝুলে থাকা পা দুটো নাড়াচ্ছে । তার গলায়, হাতে এবং কোমরে অনেকগুলো তাবিজ ঝুলছে । তার ঠোঁট দুটো উপর আর নিচে সরে গেছে তাই দাঁতের মাড়িও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । দাঁতগুলো চিকন হয়ে গেছে তাই একটার থেকে আরেকটার দূরত্ব তৈরি হয়েছে । দাঁতের কালার হলুদ হয়ে গেছে । আর মাড়ি কালো বর্ণ ধারণ করেছে । রাফানের মা পাশে বসে তাকে খাওয়াচ্ছে আর বার বার আচল দিয়ে চোখ মুচছেন । কিন্তু রাফান খাবার মুখে নিয়ে কিছুক্ষণ চিবিয়ে ফেলে দেয় । সে রুমের চারপাশে ঘুরেফিরে তাকাচ্ছে । মনে হচ্ছে সে কাউকে দেখছে এবং যাকে দেখছে সে রুমের চারদিকে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে । রাফান তার সাথে সাথে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করছে ।
- আফা, খাওয়া শেষ হয়েছে ? ঔষধ খাওয়াতে হবে । নার্স দরজায় এসে বলল ।
- এই তো আরেকটু । রাফানের মা বলল । রাফান চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে আছে নার্সের দিকে আর হাত দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করছে । ডাক্তার এবং নার্স রুমে আসলেই সে চিৎকার চেচামেচি করে । তাদের তাড়িয়ে দিতে চায় ।
রাফানের দুঃসম্পর্কের চাচা তুলশি গ্রামের বিখ্যাত একজন ফকির নিয়ে এসেছেন । তাঁকে দশগ্রামের মানুষ ধোঁয়াবাবা নামে চেনে । কারণ তার কাঁধে ঝুলে থাকা পুটলি থেকে সবসময় ধোঁয়া বের হয় । সেই ধোঁয়া তার চারপাশ ঘিরে থাকে । আর তিনি এই ধোঁয়া দিয়েই সকল তেলেসমাতি দেখান । তিনি এই পর্যন্ত অনেক জ্বীনভূত পাকড়াও করেছেন ধোঁয়ার বান দিয়ে । আট দশ গ্রামের মানুষ নিজ চোখে দেখেছে ধোঁয়ার ভেতরে জ্বীনভূতদের আহজারি । অনেকে নাকি ধোঁয়ায় বন্দি হওয়া জ্বীনভূতদের কান্না দেখে নিজেরাও কেঁদেছেন । ধোঁয়াবাবার নামে এখন যা প্রচলিত আছে তা হলো তিনি আছর আক্রান্ত এলাকায় পাঁ রাখার সাথে সাথেই ওখান থেকে সকল আছর কেটে যায় ! কিন্তু সেই ধোঁয়াবাবা হসপিটালের গেটে এসে আটকা পড়লেন । হসপিটাল কতৃপক্ষ উনাকে কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না । এর মধ্যে গেটে অনেক জটলা বেঁধে গেছে । অনেক মানুষ এসেছে ধোঁয়া বাবার ধোঁয়ার কেরামতি দেখতে । আবার কেউ কেউ এসেছে তাদের আর্জি নিয়ে । শেষ পর্যন্ত ধোঁয়াবাবা ঢুকতে পারলেন । রাফানের বাবা অনেক রিকুয়েস্ট করে হসপিটাল কতৃপক্ষকে রাজি করালেন ।
ধোঁয়াবাব ঢুকছেন । তার চারপাশে ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত । ধোঁয়া থেকে মধুর ঘ্রাণও বের হচ্ছে । আশেপাশে ঘিরে আছে নার্স, আয়া, ওয়ার্ড বয়েরা । তাদের কৌতুহলের বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ার বইছে । কেউ কেউ নিজেদের সমস্যার কথাও বলে যাচ্ছে । কিন্তু বাবার কোন উত্তর নেই। তিনি আপন মনে মাথা ঝেকে ঝেকে আগাচ্ছেন । উনাকে লিফটের সামনে নিয়ে গেলে তিনি উঠতে অপারগতা প্রকাশ করলেন । তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন ।উনার বয়স দেখে উনাকে বলা হলো যে, ছয় তলায় রুগী, এতো উপরে উঠতে পারবেন কিনা । উনি গরম হয়ে যান ।তার প্রকাশ মুখ দিয়ে গরর গরর শব্দে বের হয় । তাতে সবাই বুঝে গেছে তিনি তাঁর স্পিরিচুয়াল শক্তি দিয়ে উঠে যাবেন । তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন । ছয়তলা পর্যন্ত উঠে যখনি রাফানের দরজার সামনে আসলেন তখনি ঠাস করে দরজাটা লেগে গেল । সাথে সাথে ধোঁয়াবাবাও পড়ে গেলেন । ধোঁয়াবাবা নিথর হয়ে আছেন । মুখে পানি চিটানো হচ্ছে কিন্তু কোন আলাপ নেই । উনাকে তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার ধোঁয়াবাবাকে মৃত ঘোষণা করলেন । সেই থেকে রাফানের রুমে কোন নার্স, আয়া যেতে চায় না ।সবাই ভয় পায় । ডাক্তাররা যতই বোঝায় যে, রাফানের রুমের দরজা বরাবর জানালা ছিল । সেই জানালার বাতাসে দরজা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় । আর ধোঁয়াবাবা এমনেই বয়স্ক মানুষ ছিলেন । তিনি ছয়তলা সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন । তাতে উনার হাই প্রেসার দেখা দেয় ।আর তখন হঠাৎ দরজার এই বিকড় আওয়াজ তিনি সহ্য করতে পারেননি । তাই তিনি হার্ট এট্যাক করেন ।কিন্তু ওরা কেউ এই থিউরী বিশ্বাস করছে না । তাই ধোঁয়াবাবার নাটকীয় মৃত্যু মিথ হয়েই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো । রাফানের বাবা মায়ের এই ছিল শেষ ভরসা । কিন্তু সেই ধোঁয়াবাবা ঢোকার আগেই মারা গেলেন । তাই রাফানের বাবা মায়ের রাফানের মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই ।
৪।
রসিমন বিবি ঘুমে থাকা মেয়ে রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে । মেয়েকে দেখতে অনেক লক্ষী লাগছে । কিন্তু রসিমন বিবি কাঁদছে । তিনি ভয় পাচ্ছেন । আজকে মইত্যাকে চড় দেওয়াটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে । কী করবে রসিমন, মেয়ের সাথে মইত্যার এমন আচরণে রসিমন তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারেনি । আজকে সাহেবানদের বাসা থেকে আসতে রসিমনের সন্ধ্যা হয়ে যায় । এক সাহেবান অসুস্থ ছিলেন তাই সব কাজ রসিমনকেই করতে হয়েছিল । তাই কাজ শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । সে ঘরে এসে দেখে রাবেয়া হাতে চুড়ি পড়ে ঝনঝন আওয়াজ করছে । রসিমন জিজ্ঞেস করে চুড়ি কোথায় পেয়েছে । রাবেয়া বলে মইত্যা কাকা এসেছিল । উনি দিয়েছেন । রসিমন আবার জিজ্ঞেস করে সে আর কী করেছে ? রাবেয়া বলে, আর কী করবে ? হাতে চুড়ি দিয়ে কাঁধে হাত রেখে আদর করে চলে যায় । কাঁধে হাত রাখার কথা শুনে রসিমনের গা ঘিনঘিন করে ওঠে । সে রাবেয়ার হাত থেকে চুড়িগুলো খুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ।এতো জোরে খুলে যে রাবেয়া ব্যাথাও পায় । রসিমন চুড়িগুলো নিয়ে মইত্যার দিকে ছুড়ে মারে আর গালে কইসসা একটা চড় মারে । তাকে হুমকি দিয়ে আসে এর পর যদি রাবেয়ার আশেপাশে তাকে দেখে তাহলে তাকে খুন করে ফেলবে ! রসিমন মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবে সে বড় অন্যায় করে ফেলেছে । রাগের মাথায় অনেক ক্ষমতা দেখিয়ে ফেলেছে । কিন্তু একা এই রসিমনের ক্ষমতা যে কতটুকু সে খুব ভাল করেই জানে । রাবেয়ার জন্য রসিমনের খুব ভয় হচ্ছে । মেয়েটা একা একা স্কুলে যায় । সারাদিন ঘরেও একা থাকে ।কখন কী বিপদ হয় আল্লাহই জানে । রসিমন ভাবছে রাবেয়ার স্কুলে যাওয়া আসার সময় রসিমন সাথে থাকবে । সাহেবানদের বলে এই সময়টুকু বের করে নিবে সে ।যদিও রসিমন কখনো চায়নি তার কাজ রাবেয়াকে দেখাবে। কিন্তু এখন ভাবছে রাবেয়াকে ঘরে একা রেখে যাবে না । তার সাথে সাহেবানদের বাসায় নিয়ে যাবে ।
রসিমন মেয়েকে নিয়ে সাহেবানদের বাসায় বাসায় যাচ্ছে এতেও শান্তি নেই । বস্তির অন্যান্যরা তিরস্কার করে বলতে লাগলো, কিরে রসিমন, শেষ পর্যন্ত আমগো কতাই ফলল, মেয়ের ভবিষ্যত নিয়া ভাবতাচছ, মেয়েরে বাড়ি বাড়ি নিইয়া কাম শিখাইতাচস । তোর মত এমন আরো কত দেখেছি ফুটানি করতে, শেষ পর্যন্ত আমাগো কথাই ফলেছিল, তোর বেলায় কী আর বিপরীত অইব !! আবার কেউ কেউ এর থেকেও এক ডিগ্রি উপরে । তারা বলে, কিরে রসিমন মাইয়ারে নিয়া কী ব্যবসা শুরু করছসনি, সাহেবেগো বাড়ি বাড়ি নিয়া যাইতাসস, তো আমাগোরেও দিস আমরাও পোষাইয়া দিমুনে হা হা হা...
কিশোরী রাবেয়া এইসবের কিছুই বোঝে না । সে শুধু দেখে ঘরের কোণে বসে আঁচলে মুখ চেপে মায়ের কান্না ।মাকে জিজ্ঞেস করলেও মা কিছু বলে না ।
মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়ায় রাবেয়া অনেক খুশি । তার বন্ধু বান্ধুবের অনেকের মা আসে তাদের সাথে কিন্তু রাবেয়া স্কুলে আসতো একা । তাই তার এখন খুব ভাল লাগছে অন্যদের মত রাবেয়াও তার মায়ের সাথে আসছে । আর মায়ের কাছে নানান বাহানায় আইসক্রিম, ফুস্কাও খেতে পারছে । মেয়ের আবদার শুনতে রসিমনের খুব ভাললাগে। তাই রসিমনও মেয়েকে খেতে না করে না । রাবেয়া মায়ের সাথে আইসক্রিম খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে আসছে । রসিমনের হঠাৎ বুক ব্যাথা শুরু হয় । রসিমন ডিস্পেনসারীতে গিয়ে সেক্লো একপাতা নেয় আর পানি দিয়ে তখনি একটা খেয়ে ফেলে । রসিমন এই চিকিৎসাটা ভাল জানে । তার খাওয়া দাওয়ার সময়সীমা নেই । তাই পেটে গ্যাস হয় । তখনি বুক জ্বালাপোড়া করে । আর তখনি রসিমন পাতা থেকে খুলে সেক্লো একটা মেরে দেয় । সে এই চিকিৎসা শিখেছে সাহেবানদের কাছ থেকে । তাঁদের বাসায় কাজ করার সময় রসিমন বুক জ্বালাপোড়ার কথা বললে সাহেবান সেক্লো ট্যাবলেট একটা খেতে দিত । এরপর রসিমনের আরাম লাগতো । প্রায় সময় তার এমন জ্বলাপোড়া হয় দেখে একদিন সাহেবানদের কাছ থেকে ঔষধের নামটা জেনে নেয় । সেই থেকে শাড়ির আঁচলে সেক্লো বেঁধে রাখে রসিমন । ব্যাথা হলেই খুলে একটা মেরে দেয় । কিন্তু ইদানিং ঔষধটা আগের মত কাজ করে না । ব্যাথা সহজে যেতে চায় না ।
রসিমনের বুকে ব্যাথাটা আজ ভাল করেই ধরেছে । সে কাজে যেতে পারেনি । দুপুর থেকে বিছানার সাথে লেগে আছে । রান্নাবান্না সব রাবেয়া করেছে । এখন রাবেয়া মায়ের বুকে রোশনের কোয়া দেওয়া কুসুম গরম সরিষা তেল মালিশ করে দিচ্ছে । রসিমন ব্যাথায় ছটফট করছে । তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে । সকাল পর্যন্ত রসিমনের তেমন কোন উন্নতি হয়নি । রাবেয়া মায়ের মাথার কাছে বসে ঘুমিয়ে গেছে । মায়ের গোঙ্গানির শব্দ শুনে সে জেগে ওঠে । রাবেয়া পাশের ঘরের করিম কাকা আর রহিমা কাকীকে খবর দেয় । এই বস্তিতে কাছের মানুষ বলতে রাবেয়াদের এই দুইজনই আছে । তারা তাড়াতাড়ি রসিমনকে নিয়ে সরকারি হসপিটালে ছোটে । রাবেয়া তার মায়ের পোটলা থেকে জমানো টাকাগুলো নিয়ে নেয় ।
রসিমন বিবিকে ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিছু টেস্ট করাতে বলে । কিন্তু রাবেয়ার কাছে পরীক্ষাগুলো করানোর মত টাকা নেই । করিম কাকা বলল সমিতিটা ভেঙ্গে টাকা নিতে । রসিমনের টেস্টগুলো করানো হলো । ডাক্তার টেস্ট দেখে বলল রসিমনের যকৃতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং অনেক দেরি হয়ে গেছে । তবে এখনো আশা আছে । তাড়াতাড়ি অপারেশনটা করলে ভালোও হয়ে যেতে পারে । কিশোরী রাবেয়া দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে । সে এতো টাকা কোথায় পাবে ? সমিতির সামান্য কিছু টাকা ছাড়া তার হাতে আর কোন টাকা নেই । করিম কাকা বলল মা যে সব বাসায় কাজ করে সেসব বাসায় গিয়ে টাকা চাইতে । রাবেয়া তাদের বাসায়ও গেল । তারা সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিল । সব টাকা দিয়ে রসিমনের এক সপ্তাহের ঔষধ চলল । রাবেয়া মায়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে । মাকে দেখে তার কান্না পাচ্ছে । যত দিন যাচ্ছে মায়ের শরীর ততই খারাপ হচ্ছে । চেহারার দিকে এখন তাকানো যায় না । শুকিয়ে মুখ চোয়ালে ঢুকে গেছে ।
মইত্যাও এখন সুযোগ পেয়েছে । সে রাবেয়াকে সরাসরি কু-কর্মের প্রস্তাব দেয় ।গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে । বলে, অল্পসময়ে অনেক টাকা পাবি রাবেয়া । তোর মায়ের অপারেশন করাতে পারবি । তুই কী তর মাকে ভাল করতে চাস না ! কিন্তু রাবেয়ার মা রাবেয়াকে বলেছে যে সে মারা গেলে যাবে কিন্তু মইত্যার কোন কথায় রাবেয়া যেন কান না দেয় । এবং রাবেয়ার মা রাবেয়াকে তার মাথা ছোঁয়ে কসমও কাটায় ।তবে করিম কাকা একটা ভাল বুদ্ধি দিয়েছে । মায়ের ডাক্তারী কাগজ দেখিয়ে রাস্তায় মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য । রসিমন এটাও চায় না রাবেয়া তার জন্য ভিক্ষা করুক । করিম আর রহিমা বহুকষ্টে রসিমনকে রাজি করায় । তাই প্রতিদিন রাবেয়া সকাল থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহায্য চায় । মায়ের প্রতিদিনের ঔষধ এই টাকায় হয়ে যায় কিন্তু অপারেশনের টাকা সারাজীবন এইভাবে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করলেও হবে না । তবুও প্রতিদিনের ঔষধ দিয়ে মাকে একটু সুস্থ রাখা যাচ্ছে । কিন্তু সেটা কতদিন রাবেয়া তা জানে না । তার এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ । সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহায্য চায় আর অন্য সময় মায়ের কাছে থাকে ।
বৃষ্টির সিজন হওয়ায় ইদানিং রাবেয়ার একটু সমস্যা হচ্ছে । রাস্তায় দাঁড়াতে পারে না । যেকোন সময় বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় । আর বৃষ্টিতে সাহায্যও তেমন পাওয়া যায় না । সবাই গাড়ির জানালা মেরে রাখে । তাই এখন সে রাতের বেলায়ও রাস্তায় দাঁড়ায় কিছু সাহায্যের জন্য । অনেক সময় সাহায্য চাইতে চাইতে সে ভুলে যায় রাত কয়টা বাজে । মায়ের কাছে গিয়ে দেখে মা ঘুমিয়ে গেছে । সে তার ভেজা জামা কাপড় পালটে মায়ের মাথার কাছে মাথা রেখে শুয়ে থাকে ।
৫।
রাত প্রায় এগারোটা বাজে । রাফান তার বন্ধু সিয়াম এবং রিগানের সাথে গাড়ি করে বাসায় ফিরছে । তারা বার থেকে ফিরছে । তাদের মধ্যে অগোচালো কথাবার্তা চলছে তার বেশিরভাগই অশ্লীল । বোঝা যাচ্ছে আজকে প্যাক একটু বেশি মেরেছে । গাড়িতে হাই ভলিউমে গান চলছে, পিংক লিপ্স...পিঙ্ক লিপ্স... !রাফান আধখোলা চোখে দেখছে দূরে একটা মেয়ে হাতে লেমেনেটিং করা কাগজ নাড়াচ্ছে । গাড়ির লাইটের আলোয় লেমনেটিং রিফ্লেক্স করছে । তাই মেয়েটাকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না । গাড়ি কাছাকাছি আসায় মেয়েটাকে ভালভাবে দেখা যায় । মেয়েটাকে দেখে নেশাগ্রস্থ তিন বন্ধুর কামুক বেদনা উঠে যায় । মেয়েটার শরীর আধভেজা । গায়ের জামা অন্তর্বাসবিহীন শরীরে লেপ্টে আছে । সদ্য জেগে উঠতে থাকা বুক টসটস করছে । ভেজা চুল মেয়েটার রূপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে । ঠোঁটে পানির ফোঁটা লেগে আছে । গাড়ির লাইটের আলোয় মনে হচ্ছে পৃথিবীতে কোন পরী নেমে এসেছে । রাফান তার বন্ধু সিয়াম আর রিগানকে বলে, দেখচছ কঠিন একটা মাল রাস্তায় দাঁড়ায়া আছে ।চল আজকে তোর ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই । ফুর্তি করি । সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলে । সিয়ামের ফ্ল্যাট আজকে খালি । সিয়ামের মুখেও কামুক হাসি । তারা গাড়িটা মেয়েটার কাছে এসে থামায় । গ্লাসটা খোলার সাথে সাথে মেয়েটা তাদের কাছে সাহায্য চায় । তখন রাফান বলে চল আমাদের সাথে তোরে আরো অনেক টাকা দেবো । রাফান মেয়েটার মুখে হাত ঘসে বলে । মেয়েটা ভয়ে পেঁছনে সরে যায় । রাফান ঢুলতে ঢুলতে গাড়ির দরজা খুলে নামে । তার পেঁছনে সিয়াম আর রিগানও নামে । তারা মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায় ধরার জন্য । মেয়েটা ভয়ে পিঁছে সরতে থাকে । তারাও হাত বাড়িয়ে মেয়েটার দিকে এগুচ্ছে । মেয়েটা পেঁছনে সরতে সরতে হঠাৎ খোলা ম্যানহোলে পড়ে যায় । তার মাথা ম্যানহোলের কাছার সাথে সজোরে বাড়ি খায় । এটা দেখে রাফান ও তার বন্ধুদের মাতাল চোখেরও তন্দ্রা ভাঙ্গে ।তারা ম্যানহোলের মুখ দিয়ে নিচে তাকায় । ভেতরে শুধুই অন্ধকার আর পানির স্রোতের আওয়াজ । তারা আশেপাশে তাকায় । কাউকে না দেখে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে চলে যায় ।
মেয়েটাকে পরদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে পাওয়া যায় । কিন্তু তার কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি । এর কিছুদিন পর বিনা চিকিৎসায় রাবেয়ার মা রসিমন বিবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে । করিম আর রহিমা মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে রসিমন বিবির দাফন সম্পূর্ন করে ।
৬।
হসপিটালে রাফানের মত আরও দু'জন রুগী ভর্তি আছে ।সিয়াম এবং রিগান । তিনজনই আছে একই আই সি ইউ রুমে । তাদের নিয়ে ডাক্তাররা ওয়ার্ল্ড রিসার্স সেন্টারের সাথে কথা বলেছে । যেহেতো একই সমস্যার তিনজন রুগী পাওয়া গেছে তাই তাদের কাছে মনে হচ্ছে এটা নতুন কোন রোগের আবিস্কার হবে । তাই তারা এদের নিয়ে আরও এডভান্সড রিসার্সের আবেদন করেছে ।তারা অপেক্ষায় আছে রুগীগুলোর মৃত্যুর জন্য ।
রাফান, সিয়াম ও রিগানের রুম বরাবর ঠিক বেইসম্যান্টে স্টুডেন্টদের প্র্যাক্টিসের জন্য হিমঘরে সংরক্ষিত আছে রাবেয়ার দেহটি । তার মুখটি হালকা হা হয়ে আছে যেন সে মা ডেকেছে কিন্তু মুখ বন্ধ করেনি.....
[এই এলোমেলো, এবং কিছুটা ভয়ংকর গল্পটি প্রিয় জুন আপু এবং নাসরিন আপুকে উৎসর্গ করলাম । ]
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন