আমার কোন গল্পই শেষমেশ আর গল্প থাকেনা; নষ্ট হয়ে যায় অধিক কল্পনায়, হয়ে যায় অন্য কিছু। এজন্য আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
ছাপার স্বপ্ন সব লেখকেরই থাকে! ইদানিংকার বইমেলায় গেলে অবশ্য মাঝে মাঝে মনে হয় লেখক ছাড়া আরও নানা পদের মানুষেরও ছাপানোর ইচ্ছা জাগতে পারে। অতঃপর ইচ্ছাপূরণও হতে পারে। যাই হোক, আমিও হয়ত তাদের মতই একজন।
এক প্রকাশকের কাছে পান্ডুলিপি পাঠাবার উপায় বের করতে পারলাম দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায়। উনার সাথে যোগাযোগ হল, উনি বললেন আমার ব্লগ দেখে উনি বেশ আশাবাদী ভাল একটা লিখা পাবেন। আমিও খুশিতে আত্মহারা ("আত্মহারা" শব্দটা এতদিন সঠিক বুঝতাম না, এ ঘটনায় বুঝলাম)।
যাই হোক সব ঠিকঠাক, জানুয়ারি মাস ঢুকার আগেই পান্ডুলিপি দিয়ে দিতে হবে। আমিও জোরকদমে লিখা শুরু করছি। কলমখানা একেবারে চিলের মত উড়ে চলেছে কাগজপৃষ্ঠে। লিখা তখন প্রায় অর্ধেকমতন শেষ, ঘটা শুরু করল ঘটনা। আমি প্রেমে পড়লাম, পড়লাম বললে ঠিক হবেনা, একদম চিৎ হয়ে, কাত হয়ে পড়লাম। প্রেম যদি একটা নদী হয়, তাহলে আমার ফুসফুসে পানি ঢুকে আমি ইতিমধ্যেই পটলপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি।
মেয়ের নাম 'বন্দিনী', এরকম অলুক্ষণে নাম কোন বাবা-মা রেখেছে তা নিয়ে এখনও ভাবার সময় পাইনি, সুযোগও হয়নি। তবে, আপাতত বন্দিনীর কাছে বন্দী আমি। ওর এই আচমকা আগমন আমার জীবনকে খুব একটা পালটে না দিলেও আমাকে মোটেই বইটা শেষ করতে দিচ্ছেনা। কত সুন্দর একটা উপন্যাস শুরু করেছিলাম!
বন্দিনী মানুষ হিসাবে খুব উদাস চরিত্রের বলা যায়। পুরুষ কবি এবং মহিলা কবির মধ্যে একটা আইডেন্টিকাল ফারাক রয়েছে। পুরুষ কবির বেশভূষা দেখেই বলে দেওয়া যায় সে কবি, মহিলা কবিদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা হয় না। কবি আদলে সজ্জিত হওয়ার সুবিধা নেই বিধায়ই বোধহয় মহিলাদের কবি হওয়ার প্রতি ঝোঁক কম থাকে। যাই হোক কবি দুই প্রকার, একদলের কাজ কলমের দাপটে খালি পৃষ্ঠা ডিঙ্গানো, আর একদল 'কম কথায় খালাস'। এই 'কম কথায় খালাস'-মার্কা কবিরা হয় অলস, অথবা দারিদ্রতার বশে পৃষ্ঠা ব্যয় করতে অপারগ, অথবা দুই বাক্যে মহাকাব্য লিখার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। বন্দিনী তিন নম্বর ঘরানার কবি। এই ঘরানার কবি আর কেউ নেই, এর কারণ হল এই ইহজীবনে তার লিখা কবিতার সংখ্যা মাত্র 'এক', ভয়ানক ওই কবিতায় চরণও শুধু এক। এই কবিতাটার কারণেই প্রেমে পড়া, কিন্তু আমার গভীর প্রণয় তাকে এই কবিতাটা লিখতে দিচ্ছে না। দুইজনই আজ প্রচন্ড হতাশ- আমারও হচ্ছেনা উপন্যাস লিখা, ওরও হচ্ছেনা কবিতা। মনে মনে লিখা আছে ঠিকই, কাগজে কলমে কিছুতেই হয়ে উঠছেনা আর।
এত ঘুরিয়ে না বলে আরও সহজ করি, যা বলছিলাম- বন্দিনী খুব উদাস, কোথায় একটা কল্পনার রাজ্যে যেন ভেসে থাকে সে। কেউ জানে না, কাউকে বলেনা। বন্ধু বলতেও তেমন কেমন নেই, ভাইবোনও নেই, বাবা-মা সারাদিন ব্যস্ততার ফাঁকে যে সময়টুকু তার জন্য বের করে নেয় সেটাতে সে সাধারণত ঘুমই থাকে। এভাবেই বছর কেটেছে, বয়স তার ২২। সে বসে বসে অতীত ভাবে, মিলায় বর্তমানের সাথে। লোকজন একসময় দেখলে কোলে করে আদর করত, ঝুঁটি করে দিত চুলে, কিনে দিত চকলেট। ঐ একি বাচ্চাটা আজ যখন কৈশোরে, খেতে লাগল টিটকারি। দিন যেতে লাগল আর বাড়তে লাগল জ্বালাতন- এই জ্বালাতন বড় কঠোর, বড় পাশবিক।
চাইনিজ টিটু'কে ভয় পায়না এমন মানুষ এলাকায় কম। নেতাকর্মী আর এলাকার গুটিকয়েক মুরুব্বি ব্যতীত আর কেউই সহজে তার পথ মাড়ায় না। টিটু'র নাকি আবার বন্দিনী'কে খুব মনে ধরেছে। কিন্তু বন্দিনী উদাস চোখে টিটুর সব টিটকারি এড়িয়ে চলে যায়, সে কোন সুবিধাই করে উঠতে পারেনা। এভাবে কেটে গেছে প্রায় এক বছর। টিটু'র আর তর সয় না। সময় যত যায়, লম্বা হয় জিহবা। হাঁটতে চলতে মোটামুটি চোখ দিয়েই সে চেখে ফেলে ওর দেহ। এভাবে আর কয়দিন, ওই লোভী চোখের ভাষা পড়তে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না বন্দিনীর। এতদিন যা হয়নি তা হল এবার, পথেই হাত ধরে টান দিল টিটু, পাশ থেকে হাততালি দিয়ে উঠল তার সাঙ্গপাঙ্গ'রা। হঠাৎ আজব একটা শক্তি ভর করল বন্দিনীর দেহে, "ঠাশ! ঠাশ!" দুইটা থাপ্পরের বিকট আওয়াজ! হুড়হুড়িয়ে নেমে এল নিস্তব্ধতা। গটমট করে হেঁটে চলে গেল বন্দিনী।
আস্ত পাঁচটা খালি মদের বোতল পড়ে আছে পাশে। টিটুর শান্তি হচ্ছেনা, কিছু একটা করা লাগবে। পুরা এলাকার সবার সামনে এভাবে থাপ্পর মেরে যে চলে গেছে তাকে শাস্তি দিতে হবে, কঠিন শাস্তি। শাস্তি হবে এটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, কী শাস্তি হবে এটাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা ও। না, এভাবে না, সবাই মিলে একটা মাইক্রোবাস নিতে হবে। সুযোগ বুঝে তুলে নিতে হবে। রাতে মাঝে মাঝে ও বের হয় এটাসেটা কিনতে, তখনই ভাল সময়। ঐ সময় তুলে নিতে পারলে খালি জায়গার অভাব নাই, কাজ সেরে একদিকে ফেলে দিয়ে আসা যাবে। যে কয়টার সামনে থাপ্পর মেরেছে, সবাইকে সাথে নিতে হবে। ভাবতেই টিটুর গা-টা এলিয়ে পড়ল আরামে।
ঐ মঞ্জু, কামরুল, সান্টু, মামুন- পারবি না তোরা? এত লজ্জা কীয়ের বেটা?
-ভাই কি কোন এইসব?
- কি কমু, এই অপমানের শোধ নেওয়া লাগব না?
সান্টু আর কামরুল বলে উঠে, "হ ভাই নেওয়া লাগবতো কিন্তু ভাই সবাই একলগে.... "
- কোন কিন্তু নাই শুয়োরের বাচ্চারা, পারবি নাকি ক?
- হ হ পারুম ভাই।
মিনমিনে হাসি ফুটেছে টিটুর চোখে। বাকিগুলোও জ্বলজ্বল করছে ঢিবঢিব-ঢিবঢিব.....ছয়-জোড়া চোখে ভর করেছে স্বয়ং ইবলিশ।
.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।
আমি যখন উপন্যাসটা লিখতে শুরু করি তখনও হয়ত পৃথিবীতে 'বন্দিনী' বলে কেউ ছিলনা। আমার উপন্যাসে এল, একটা ভয়াবহ ট্র্যাজিক উপন্যাস লিখার ইচ্ছা নিয়েই নেমেছিলাম আমি। কিন্তু যত লিখতে লাগলাম 'বন্দিনী'র জন্য জমতে লাগল ভালবাসা। একসময় ওর উদাসী চোখে আমি খুঁজে পেলাম পৃথিবীর যত স্নিগ্ধতা, ওর সরল ভাবনায় খুঁজে পেলাম ভালবাসার উপাত্ত, ওর লাবণ্যে ভরে উঠল আমার পুরো অস্তিত্ব। আগেই বলেছিলাম আমার ফিকশান সবসময় বেশি হয়ে গিয়ে কিছু একটা করে বসে, এবারও তাই হল। উপন্যাসের শেষে বন্দিনী-কে এক নির্জন রাস্তার কোণে রাতের আঁধারে লুটেপুটে খাবে শয়তান। মুমূর্ষু বন্দিনী তার শেষ নিঃশ্বাস ধরে রেখে, রক্তকালিতে কংক্রিট পথে লিখে যাবে এক চরণের সেই কবিতা, তার লিখা একমাত্র কবিতা। যে কবিতার জন্যই প্রেমে পড়া আমার। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এ কবিতা তাকে লিখতে দিবনা, এ উপন্যাস আমি লিখবনা। এদ্দুর এসে গল্পের কক্ষপথ পরিবর্তন করা সম্ভব নাহলে ফেলেই দিব নাহয় পুরাটুকু। না যাক কোন পান্ডুলিপি, ছাপানো না হোক প্রয়োজনে। প্রতিদিন এদেশের আনাচে-কানাচে সম্ভ্রম হারিয়ে পড়ে থাকা অজস্র বন্দিনী-কে বাঁচাতে যখন পারছিইনা, অন্তত আমার বন্দিনী'কে রক্ষা করি রাক্ষসের হাত থেকে। যমপুরীতে বসে এ সুখটাই তো রুপকথার আনন্দ দেয়।
এর ভিতরেই প্রকাশকের সাথে আমার চরম পর্যায়ে মনোমালিন্য হয়ে গেছে, হাত থেকেই বোধহয় ছুটে গেছে বেটা। ছুটলে ছুটুক, খুঁজেই যখন চলেছি, ছাপার ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই হয়ে যাবে একদিন।
পরিশেষে, এবারে আর বইটা ছাপা হবেনা। কষ্ট লাগছেনা বললেও মিথ্যা হবে; যাই হোক, ঠিক করেছি বন্দিনী'র নাম বদলে দেব, এবার নাম হবে "মুক্তি"। উপন্যাস আর ট্র্যাজেডির হবেনা, উপন্যাসটাও হবে মুক্তির....।
বিঃদ্রঃ (সকল চরিত্র কাল্পনিক, মিলে গেলে আমি ক্ষমা চাইতেছি...আমি ভীতু প্রকৃতির লোক)
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন