১
লাল গোলাপটি পকেটে নিয়ে ছাদে গেলাম। শেফালি প্রতিদিনের মতো ছাদেই আছে। দাড়িয়ে ব্যস্ত শহর দেখায় ব্যস্ত। শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে তার মুখের এক পাশে। সে তাকিয়ে আছে দূরের রাস্তাটায়। আমি কাছে যেতেই মুখ ফিরিয়ে দেখলো। হেসে বললো, আজও চলে এলে!
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, বাসায় ভালো লাগছিল না। তুমি আর কতক্ষণ আছো?
-আমি কতক্ষণ থাকবো না থাকবো তা জেনে তুমি কি করবে?
-নাহ, একটা কথা বলার ছিল।
-একটা কেন? যতটা ইচ্ছে বলে ফেলো।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নাহ, আজই বলবো। বলতে চাই, কিন্তু মুখ দিয়ে দেখি কথা বের হয় না। নিজেকে অসহায় লাগে, বড় ছোট লাগে। শেফালির ভালোবাসা পাবার যোগ্য নই আমি, আমার মতো অপদার্থকে ভালোবাসার কোন কারণ থাকতে পারে না। তবে কোন অধিকারে আমি তার জীবনসঙ্গী হতে চাইবো!
-কি ব্যাপার? কি বলবে বলো?
-কেমন আছো?
শেফালি আমার দিকে তাকালো রাজ্যের সকল বিরক্তি নিয়ে।
আমি হেসে বললাম, মানে হলো আজকের আকাশটা সুন্দর। কি বলো?
সে বিরক্ত হয়ে তাকিয়েই আছে। তার সেই অগুনের মতো দৃষ্টি। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হালকা ধাচের কথা বলতে লাগলাম।
কথা বলতে বলতে তাকে ফেলে একটু সামনে যেতেই পেছন থেকে শুনি হাসির শব্দ। হঠাৎ মনে পড়লো গোলাপটা আমার পেছনের পকেটে। সে দেখে ফেলেছে এবং নিশ্চয় বুঝে গেছে কি বলতে চাইছিলাম। কি সর্বনাশ!
ঘুরে দেখি সে হাসছে। নিমিষেই আবার নতুন করে আমার পৃথিবী মিথ্যে হয়ে গেলো, সবকিছু তুচ্ছ মনে হলো, জীবনের মায়া নেমে এলো শূন্যের কোটায়। যেন আমার সামনে হাসতে থাকা এই রমণীকে আজীবন পাশে না পেলে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। আমার ইচ্ছে হলো, তার হাসি দেখতে দেখতেই লাফিয়ে পড়ি এই ১০ তালা বিল্ডিং এর ছাদ থেকে। ইতিহাসের পাতায় লায়লি মজনুর মতো আরেকটি নতুন বিষয় যুক্ত হবে- "প্রেমিকার হাসি দেখে প্রেমিকের মৃত্যু!" একসময় শেফালিও তার ছেলেমেয়েদের গল্প শোনাবে, "এই তোরা জানিস, একদিন আমার হাসি দেখে এক পাগল মরে গিয়েছিল। কি সাংঘাতিক ভালোবাসা চিন্তা করে দেখ!"
সে হেসে আমার এত মূল্যবান আবেগ তুচ্ছ করেছে, আমার ভালোবাসার মূল্য দেয় নি। তবে কেন আমি তার হাসি দেখে মুগ্ধ হবো! রাজ্যের সকল অনাগ্রহ নিয়ে বললাম, কারো হাসি এত বিচ্ছিরিও হয়?
আমার কথা যেন সে শুনতেই পায় নি এমন ভঙ্গি করে হাসি না থামিয়েই বলল, তুমি আমার প্রেমে পড়েছো!
-আজব ব্যাপার তো! আমি তোমার প্রেমে পড়তে যাবো কেন?
-ইদানীং ভাবসাব তো সুবিধার ঠেকছে না।
আমি কিছু না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে শিস বাজালাম।
সে উদাসীন হয়ে বললো, সাবধানে থেকো। একবার পড়লেই কিন্তু টুপ করে ডুবে যাবে। আমি হাতও বাড়াবো না টেনে তুলবার জন্য।
এই বলে আবার আয়োজন করে হাসতে শুরু করলো সে। আমি রাগতে যেয়েও পারলাম না, মুগ্ধনয়নে বোকার মতো চেয়ে রইলাম। যাদের হাসি এতটা মায়াবী, তাদের উপর বোধ হয় রাগ করার নিয়ম নেই।
একটুপর সে চলে গেল। আমি আগের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আকাশের দিকে তাকালাম। এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে মেঘেরা। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, আমি আর শেফালি বসে আছি মেঘের উপর। শেফালি আমাকে বলছে, এই, পড়ে যাবো তো!
কল্পনা থেকে আমি পুরনো স্মৃতির পাতায় ডুব দিলাম। শেফালির সাথে প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে তাকে পাবার স্বপ্ন দেখার দিনগুলো, সব মনে পড়তে লাগলো এক এক করে।
২
দুপাশে ধানক্ষেত। রিকশা চলছে। আমি আর শেফালি বসে আছি রিকশায়। মৃদু বাতাসে চুল উড়ছে শেফালির। রহস্যময় হাসি ঝুলে আছে তার ঠোটের কোণে। ভাবসাব এমন যেন আমরা বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি। সে হাত টাত নেড়ে কি যেন বলছে আমাকে।
ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি চারপাশে অন্ধকার। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। খুব করে মনে পড়লো শেফালির কথা। ইচ্ছে হলো শেফালির পাশে গিয়ে বসে থাকতে। ক্রমশ অদ্ভুত এক শূন্যতায় মিলিয়ে যাওয়া। সেদিনের পর থেকে আর ছাদেও যাওয়া হয় নি। আমি এই গভীর রাতে অধীর হয়ে অপেক্ষায় রইলাম পরদিন বিকেলের। কবে দেখা পাবো শেফালির? কোথায় পাবো তাকে?
রাত শেষ হয়ে ভোর হলো। আধো আলো জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়লো রুমে। আমার তবু ঘুম এলো না। ছাদে গেলাম। যদি সে আসে! আসতেই পারে সূর্য উঠার চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করতে। আমি দাড়িয়ে রইলাম। সময় গেল। সে এলো না। আমি বাসায় এসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আবার গেলাম। অবশেষ বিকেলে সে এলো। অনেক কথাই হলো। চলে আসার আগমুহূর্তে সে বললো,
'আর শোনো, যত দ্রুত সম্ভব প্রেমের ভূত মাথা থেকে দূর করো। দ্য আরলিয়ার, দ্য বেটার। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।'
রাতে ঘুম হলো না। জীবনটাকে অর্থহীন মনে হলো। এখন সে এসে যদি হাত ধরে বলে, "আরে পাগল, আমি পাশেই আছি!" তখনও কি আমার জীবনটাকে এমনই অর্থহীন মনে হবে? কেউ একজন হঠাৎ এসে জীবনের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়। সন্তর্পণে তাদেরকেই দিয়ে দেয়া হয় জীবনের অর্থ, তারাই হয়ে যায় বেঁচে থাকার কারণ।
বিছানা থেকে ওঠে ছাদে গেলাম। চুপচাপ চারিদিক, জোছনার চাদরে ঢেকে আছে ঘুমন্ত শহর। চাঁদ মামা আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে। রুটির মতো চাঁদটাকে পানির মতোই সাধারণ মনে হল। কবি সাহিত্যিকরা কেন এত কথা লিখে গেছেন, তাদের প্রেমিকার সাথে তুলনা করে গেছেন এই বৃত্তের সাথে কে জানে।
তবে আকাশটা সুন্দর। সহস্র তারায় ভরা আলো আধারে মিশ্রিত আকাশ। বৃষ্টি পড়ছে। তীব্র হলো জোছনার প্রলেপ। বাতাস হু হু করে বাজিয়ে চললো করুণ বাঁশীর সুর; যা কিনা হৃদয়ে কি যেন কি হারিয়ে ফেলার হাহাকারে ভরিয়ে দেয়। হঠাৎ বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠলো আমার। ঝপঝপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জোছনা মাখা বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা।
আমি তাকে কাছে পাবার ব্যাকুলতায় আচ্ছন্ন হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মাথা উচু করে চাঁদটার দিকে তাকালাম আবার।
কি যেন এক হাহাকার বুকের ভেতরটা শূন্য করে দিল আমার। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, যদি আমাকে আর শেফালিকে একটি পঙ্খীরাজ ঘোড়া করে ঐ দূর আকাশে পাঠিয়ে দেয়া হত! আকাশে যেয়ে আমি খুন করতাম ঘোড়াটাকে। আমাদের ফিরে আসার আর কোন পথ থাকতো না আর জীবনটা তার পাশে থেকেই কেটে যেত।
৩
শেফালির বিয়ের দিন চলে এলো। সে সকলের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে স্টেজে। আমি এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু সময় দেখলাম তাকে। সে ব্যস্ত হয়ে ভীড়ের মাঝে কাকে যেন খুঁজছে। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো; কি চমৎকার লাগছে শেফালিকে! ঠিক একটা নীলপরি!
ফটোগ্রাফার সাহেব শেফালির ছবি তুলছেন বেশ কায়দা করে। সকলের হইচই, প্রচন্ড কোলাহল, শব্দ- এসবের কিছুই আমাকে স্পর্শ করল না। বিরক্ত হয়ে স্টেজ থেকে বেরিয়ে এলাম। চারপাশটা দেখে নিলাম। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে কেন? রাস্তার ওপাশের জনমানবশূন্য বটতলার নিচে গেলে কেমন হয়? কিছু সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে থাকা? ভিতরে সব যেন কেমন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। আকাশ হয়তো আমার দুঃখটা বুঝবে, তার যেমন সীমা নেই, আমার চিলেকোঠায় জমে থাকা বিষাদেরও নেই।
যখন স্টেজে প্রবেশ করি, সকল আয়োজন শেষের পথে। শেফালিকে শেষ বারের মতো দেখতে গেলাম। তার চোখে এখনো সেই উদ্ভ্রান্ত চাহনি। আমাকে দেখা মাত্র কাছে ডাকলো। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, যাই, কেমন? ভালো থেকো।
বাহিরে হাসিমুখে বললাম, আচ্ছা। ভেতরে চিৎকার করে উঠলো আমার সমস্ত আত্মা। চোখের সামনে আমার পুরো পৃথিবী ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, আর আমার তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না। জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত।
৪
ধীরে, খুব ধীরে; আমার স্বপ্নের আকাশ কাঁচের মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। একটি মরুভূমি গড়ে উঠলো বুকের ভেতর, যার কখনো বৃষ্টির স্পর্শ পাওয়া হবে না।
আমার ঠিক আগের মতো থাকা হলো না। বিছানায় শুতে গেলাম তো দেখা গেল বালিস ভিজিয়ে একাকার করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সময় থেমে যায়, আমি ছটফট করি, তাকে না পাবার এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে যাওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। রাত যখন প্রায় শেষ, তখনো একটু ঘুমাতে গেলে দেখা গেল, সে স্বপ্নে এসে হাজির। কখনো বা রাতে সিলিং এর নিচে থাকতে পারি না, তারাভরা আকাশের নিচে থাকতে হয়। রাতে না ঘুমিয়ে ছাদে যেয়ে আকাশের তারা গুনি।
বিকেলে মাঝে মাঝে ছাদে যাওয়া হয়। কিছু সময় একা থাকার ইচ্ছে হয়। এ মুহূর্ত গুলোয় মনে হয়, নির্জনতায় বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। কি দরকার এত আনন্দের, এত কোলাহলের। কি যেন কি ভেবে দেয়ালে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রই আমি। কি ভীষণ নীল! মেঘমুক্ত আকাশে উড়ে যায় কিছু পাখি। আমি দৃষ্টি ছুড়ে দেই। কোথাও কোন সীমানা নেই, বাধা নেই। চারপাশে সবুজ গাছপালা, পাহাড়, বিল্ডিং। রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে। সবকিছুই স্বাভাবিক। অথচ রাস্তাটা শুন্য হওয়ার কথা ছিল, আকাশটা মেঘলা থাকার কথা ছিল।
কয়েক মাস পর পর শেফালি আসে তার বাবা মাকে দেখতে। যে সময়টা সে ছাদে কাটাতো সে সময়ে ছাদে আসে মাঝে মাঝে। আমার সাথে দেখা হয়ে যায়। তার জানা হয় না, আমি আজও প্রতিটা দিন এখানে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, আনমনে প্রতিক্ষার প্রহর গুণি। জানা হবেও না। সবার সবকিছু জানা হয় না, বোঝা হয় না। সে এখন অন্যকারো। ভালোবাসার শেষ ফলাফল এমনই হয়। কেউ একজন এসে জীবনের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়। পরে সময়কে দায়ী করে তারা দূরে সরে যায়, যেতে হয়।
উদাসীন দৃষ্টি লুকিয়ে সে আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করে। বহু বছর পর ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে দেখা হলে যেমন হয়, অনেকটা তেমন। সব ঠিক আছে, তবু যেন কিছুই ঠিক নেই।
-এই, কেমন আছো?
-যেমনটা দেখছো।
-পড়ালেখা শেষ?
-হু
-কি করো এখন?
-কিছু না।
-ও
সে আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হেটে, কি যেন কি কাজ থাকার বাহানা দেখিয়ে চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, সর্বহারার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। তাকে আর বলা হয় না, ইচ্ছে গুলো সব আমার, সে যাওয়ার সময় সাথে করে নিয়ে গেছে। সে দেখে না আমার দৃষ্টির আড়ালের শূন্যতা, বুকের ভেতর চাপা পরে থাকা অভিমান। আমার বলা হয় না, আজও আমি কতটা নিঃসঙ্গ রয়ে গেছি তার ভালবাসা পাবার আশায়।
দীর্ঘশ্বাস গুলো এতই দীর্ঘ হয়ে ওঠে, আমার মনে হয়, এখনই বোধহয় নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা যাবো। ঘুম, খাওয়া দাওয়া, পুরো জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। এর আগে কখনো মানসিকভাবে শান্তিতে থাকার এতটা প্রয়োজন বোধ করি নি। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে গেলাম। ডাক্টার দেখানো হল আমাকে। হসপিটালে ভর্তি করানো হল।
শেফালি মাঝে মাঝে আসে। আমি অভিমান করে মুখ ফেরাতে চেয়েও পারি না। তাকিয়ে থাকি। শুধুই তাকিয়ে থাকি। আনমনে বলি,
-কেমন আছো?
-...
-তোমার 'সে' ভাল আছে?
-...
-সংসার ঠিকঠাক মতো সাজাতে পেরেছো তো?
-...
-চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো? অন্তত একটি বার আমার নাম ধরে ডাকো?
-...
-তুমি কি দেখো না কেমন ছটফট করি, তোমার একটু কথা শুনবার জন্য?
-...
সে একটা নীল শাড়ি পরে মূর্তির মত চেয়ারে বসে থাকে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, নাকি শান্ত শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বুঝতে পারি না। কল্পনায় এত কিছু বোঝা যায় না।
একসময় চোখ খুলে দেখি, কোথাও কেউ নেই। রুমটা খালি। শূন্য।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন