১. আইনের দ্বারে
আইনের খোলা দরজা পাহারা দিচ্ছে এক দারোয়ান। গ্রাম থেকে আসা এক লোক সেই দারোয়ানের কাছে হাজির হয়, আর তাঁকে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দিতে বলে। দারোয়ান বলে, ঠিক এই মুহূর্তে ভেতরে যাবার অনুমতি নেই। মানুষটা ভাবে, তারপর জিজ্ঞেস করে, এর মানে কি ভবিষ্যতে একদিন সে ঢুকতে পারবে ভেতরে?
'তা পারবে', দারোয়ান জবাব দেয়, 'কিন্তু এখন না।'
যেহেতু আইনের কাছে যাবার দরজা খোলা থাকে সবসময়, আর কথা বলতে বলতে দারোয়ান সরে গেছে একদিকে, তাই লোকটা ঘাড় নিচু করে দরজা দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করা। দারোয়ান দেখে হাসে, বলে, 'এতই লোভ হয় যদি, দ্যাখো না ঢোকার চেষ্টা করে! মনে রেখ, আমি প্রথম দারোয়ান, সবচে নিচু পদের। ভেতরে হলের পর হল, দারোয়ানের পর দারোয়ান, প্রত্যেকেই আগের জনের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। তারা কেমন হবে ভাব! আমি নিজেই তো তৃতীয় দারোয়ানের চেহারার দিকে তাকাতে পারি না! গ্রাম থেকে আসা লোকটা এত কিছু আশা করে নি, আইনের কাছে যেকোনো সময় যে কারো যাবার অধিকার থাকা উচিৎ, সে ভাবে। কিন্তু দারোয়ানের দিকে আরেকবার তাকিয়ে- তার ফারের কোট, সূচালো নাক, মুখের কালো লম্বাটে দাড়ি দেখে সে সিদ্ধান্ত নিল- ভেতরে ঢোকার অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করাটাই ভাল হবে।
দারোয়ান তাঁকে একটা টুল দিয়েছে। বসতে দিয়েছে দরজার এক পাশে। তাতে সে বসে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। অনেকবার সে চেষ্টা করে ভেতরে ঢোকার, কিন্তু দারোয়ান তাঁকে নিরস্ত করে। মাঝে মাঝে দারোয়ান লোকটার কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে যায়, তখন সে তাঁকে জেরা করার মতন করে ঘর-গৃহস্থালি নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে, কিন্তু সেগুলো নিতান্ত দায়সারা ভাবে, আর জিজ্ঞেস করা শেষ হলে ঘুরেফিরে একই কথা বলে বারবার- অনুমতি ছাড়া সে ভেতরে ঢুকতে দিতে পারবে না।
লোকটা এই সফরে সকল প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে, তার যত মূল্যবান কিছু আছে, সব সে ব্যয় করে দারোয়ানকে ঘুষ দেবার কাজে, যাতে কাজ হাসিল হয়। দারোয়ান তাতে মানা করে না কখনো, যা দেওয়া হয় সব ঠিকই নেয়, কিন্তু নিয়ে বলে, 'দেখ, এটা তোমার মনের শান্তির জন্য নিলাম। আসলে ঘুষ দিয়ে কোন কাজ হবে না। অনুমতি লাগবে।'
লোকটা দারোয়ানকে দেখছে অনেক বছর ধরে। আস্তে আস্তে সে ভুলে যায় অন্য সব দারোয়ানের কথা, তার মনে হয় এইটিই একমাত্র দারোয়ান, একমাত্র বাধা। সে দারোয়ানকে, তারপর তার কপালকে গালমন্দ করে, প্রথম দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে- উঁচু গলায়, তারপর- যখন সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, তখন এই ক্রোধ ক্ষীণ গলার অসন্তুষ্ট বিড়বিড়ানিতে পরিণত হয়। বাচ্চাদের মতন হয়ে পড়ে সে, দীর্ঘদিন ধরে দারোয়ানকে দেখতে দেখতে একসময় দারোয়ানের ফার-কোটের কলারের মাছিগুলোকেও সে চিনে ফেলে, তাদের কাছেও সে মিনতি জানায় দারোয়ানের মন বদলাতে সাহায্য করার জন্য।
অবশেষে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, সে বুঝতে পারে না আসলেই কি চারিদিক কালো হয়ে আসছে, নাকি তার চোখ দুটো প্রতারণা করছে। কিন্তু সেই কালো অন্ধকারের মাঝেও, সে বুঝতে পারে, আইনের দরজা থেকে ভেসে আসছে অনির্বাণ এক দীপ্তি। এখন আর মরার বেশিদিন বাকি নেই তার, মৃত্যুর আগে তার মনে এতদিনের অভিজ্ঞতা জমে জমে একগাদা প্রশ্নের উৎপত্তি হয়, যেগুলো কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি দারোয়ানকে। সে চিৎকার করে দারোয়ানকে ডাকে, তাঁকে কাছে আসতে বলে, কারণ সে নিজে স্থবির, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আর নেই তার। দারোয়ান আসে, তাঁকে লোকটার শরীরের ওপর অনেকটা ঝুঁকে পড়তে হয়, কারণ এতদিনে দুজনের উচ্চতার ফারাক ঘটে গেছে অনেকটা। 'এখনও কি জানতে চাইছ তুমি?', দারোয়ান জিজ্ঞেস করে, 'তোমার প্রশ্নের কোন শেষ নেই দেখছি।'
'সবাই তো আইনের কাছে আসে, তাই না?' লোকটা ক্ষীণকণ্ঠে বলে, 'তাহলে এতদিন ধরে আমি এখানে বসে আছি, অন্য কাউকে দেখলাম না কেন?'
দারোয়ান বুঝতে পারল লোকটা জীবনের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, তাই সে তার ক্রমশ অকেজো হতে থাকা কানে কথাগুলো যেন পৌছায়, এজন্যে গলা উঁচু করে, জোরে চিৎকার করে বলল,
'এখানে আর কেউ আসে নি, কারণ এই দরজাটা শুধুমাত্র তোমার জন্যেই বানানো হয়েছিল। আর এখন আমি ওটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি।'
২. নতুন উকিল
নতুন এক উকিল এসেছেন আমাদের অফিসে, ড. বুসেফেলাস। তার চেহারা দেখে মোটেও বোঝার উপায় নেই যে ইনিই একসময় মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার দা গ্রেটের যুদ্ধ-ঘোড়া ছিলেন। অবশ্য ভেতরের খবর যারা জানে, কিংবা চোখ খোলা রাখে, তারা কিছু কিছু ব্যাপার ধরতে পারে। যেমন সেদিন, উনি আদালত ভবনের সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, আর আমাদের অফিসের গার্ড তার রেসের-ঘোড়া-দেখা তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল- তিনি কি সুন্দর করে পা গুলো উঁচুতে তুলে তুলে উপরে উঠছেন, তার পায়ের খুর মারবেলের মেঝেতে কি অদ্ভুত শব্দ করছে। দেখে সেও মুগ্ধ হয়ে গেছিল।
সব কিছু বিবেচনা করে বার কাউন্সিল বুসেফেলাস-কে ওকালতির অনুমতি দিয়েছে। বলতেই হয়, সিদ্ধান্তটি অসামান্য বোধশক্তির পরিচায়ক। তারা বলাবলি করছিলেন, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বেচারা কঠিন অবস্থায় পড়ে গেছেন। এই কারণে, আর তার ঐতিহাসিক অবদানের জন্যেও, আমাদের উচিৎ তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। এখন তো আর আলেকজান্ডার বেঁচে নেই, তার সময় ফুরিয়ে গেছে। এটা ঠিক যে এখনও কেউ কেউ জানে কিভাবে মানুষ মারতে হয়; ভোজসভায় পাশে বসা বন্ধুকে বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করে রক্তাক্ত ভালবাসা জানানোর রীতি এখনও বিলুপ্ত হয় নি পুরোপুরি; অনেকের কাছে এখনও মেসিডোনিয়া খুব ছোট জায়গা বলে মনে হয়, তারা আলেকজান্ডারের বাপ ফিলিপকে তাই গালমন্দ করেন- কিন্তু নেতৃত্ব দিয়ে পৃথিবীর অপরপ্রান্তে নিয়ে যাবার মতো মানুষ এখন আর একটিও নেই। তখনকার দিনেও ভারত উপমহাদেশে ঢোকার উপায় ছিল না, কিন্তু রাজার তলোয়ার পথ খুঁজে নিয়েছিল। এখন অনেকের হাতে তলোয়ার আছে, কিন্তু কেউ নেই যে পথ দেখাবে, তারা সেই তলোয়ার কেবল শূন্যে তুলে নাচায়; সেই তলোয়ার দেখে এগোতে গেলে দেখবেন আপনার সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে।
এজন্যে, বুসেফেলাস-কে অনুসরণ করাটাই বোধহয় একমাত্র ভাল কাজ- আর সেটি হল আইনের বইয়ের মাঝে পুরো ডুবে যাওয়া। বুসেফেলাস এখন মুক্ত, পিঠে ভারি জিন চড়িয়ে কোন মহান পাপী সওয়ারি আর তাঁকে আঁকড়ে ধরে নেই; আলেকজান্ডারের যুদ্ধগুলো থেকে অনেক দূরে, বাতির স্থির আলোয় তিনি চোখ মেলে পড়ছেন, আর ক্রমশ উল্টে যাচ্ছেন মানুষের প্রাচীন বইগুলোর পাতা।
৩. তিতে প্রত্যাখ্যান
যখন কোন সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়, আমি তাঁকে মিনতি করে বলি- 'চলো না আমার সাথে', আর সে নিঃশব্দে জবাব না দিয়ে দূরে সরে যায়, তখন আসলে এই নিরবতার মাধ্যমে সে বলে-
'আপনি কোন নামকরা ডিউক নন, সুপুরুষ আমেরিকান নন যার চোখে নিষ্ঠুরতা আর মায়া খেলা করে, যার দেহে আছে প্রেইরির খোলা হাওয়া আর তার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলের ছাপ; আপনার রেড ইন্ডিয়ানদের মতো চওড়া বলিষ্ঠ গড়ন নেই, সাহস নেই, কখনো সমুদ্রের জলে যাত্রা করেও দেখেননি। আপনিই বরং বলুন- আমার মতো একটা সুন্দরী মেয়ে কেন আপনার সাথে যাবে?'
'ভুলে যাচ্ছ নিজের কথা? কই, কোন লিমুজিন তো দেখছি না এত সুন্দরী একটা মেয়েকে দোল খাইয়ে খাইয়ে ঘুরিয়ে বেড়ানোর জন্যে? সুট-বুট পড়া কঠিন মুখের দেহরক্ষীর দল তোমার চারপাশে থাকার কথা সবসময়, তারা কোথায়? বুঝলাম টাইট বডিসের ভেতরে স্তন দুটো সুন্দর চাপিয়ে রেখে ঘুরছ, লাগছে বেশ- কিন্তু তোমার দুই উরু আর নিতম্বের যে অবস্থা, তাতে তো পুরো বারোটা বেজে যাচ্ছে কাপড়ের। গায়ে কি লাগিয়েছ, কড়কড়ে বিচ্ছিরি রেশমি পোশাক, স্কার্টটা ভাঁজ ভাঁজ, এসব কতদিনের পুরনো; সেই গেল শরতে এসবের চল ছিল, আমরা দেখে হইচই করেছিলাম, ঐটা- ওই ভয়ানক পুরনো জিনিসটা পরেও- তুমি ডিউকের সাথে চাইছো প্রেম, ফিক ফিক করে সময়ে সময়ে হাসছো।'
'হ্যাঁ, দুজনেই ঠিক বলেছি, কিন্তু এই অপ্রীতিকর সত্যটা মাথার ভেতর গেড়ে বসার আগেই কি আপনার মনে হয় না- এখন ভালমতো আমাদের যার যার রাস্তায় কেটে পড়া উচিৎ? '
৪. পাশ কাটিয়ে দৌড়ে যায় যারা
যখন রাতের বেলা, রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি, আর তাকিয়ে অনেক দূরেও দেখতে পাচ্ছি [কারণ সামনের রাস্তাটা উপরে উঠে গেছে অনেকটা, আর চাঁদ জ্বলছে আকাশে], এবং দেখছি এক লোক দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে- তখন মোটেই ঠিক হবে না তাঁকে ধরে থামানো- যদি তার গায়ে ছেঁড়া পোশাক থাকে, নিতান্ত দুর্বল মনে হয় তবুও; এমনকি যদি দেখি তার পিছু পিছু চিৎকার করতে করতে ধাওয়া করছে আরেকজন, তাও; বরঞ্চ উচিৎ হবে তাদের না থামিয়ে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে যেতে দেওয়া।
কারণ এখন রাত, আর যদি বৃত্তাকার চাঁদের নিচে রাস্তাটা কোনোভাবে উঠে যেতে থাকে ক্রমশ উপরের দিকে, সেটা তো আমাদের দোষ না। আর তাছাড়া এমনও হতে পারে যে এই দুজন মজা করেই দৌড়াদৌড়ি করছে, হতে পারে এই দুজন তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে ধাওয়া করছে, হতে পারে প্রথম লোকটাকে অন্যায়ভাবে তাড়া করা হচ্ছে, হয়তো দ্বিতীয়জন তাঁকে মেরে ফেলতে চায়, তাহলে? তাহলে তো আমরা সেই খুনের মধ্যে জড়িয়ে যাব। হতে পারে এরা কেউ কাউকে চেনে না, হয়তো দুজনেই যার যার মতো দৌড়ে বাড়িতে যাচ্ছে, কিংবা দুটো লোক-ই ঘুমের ঘোরে এরকম দৌড়াচ্ছে, অনেকের তো এরকম হয়; কিংবা সম্ভবত প্রথমজনের কাছে অস্ত্র আছে।
আসল কথাটা হোল, আমরাও তো ক্লান্ত হয়েছি, নাকি? সবাই মিলে এত্তগুলো ওয়াইন কি খাইনি? ক্রমশ আমরা খুশি হলাম, কারণ দ্বিতীয় লোকটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
৫. হৈ-হট্টগোল
বসে আছি আমার ঘরে, আমি চুপচাপ। কিন্তু এই ঘরটাই পুরো বাড়ির হইচইয়ের কেন্দ্রস্থল। সবগুলো দরজা দড়াম-দড়াম করে বন্ধ করা হচ্ছে-সেই বিশ্রী শব্দটা ঢেকে দিচ্ছে এই ঘর থেকে ওই ঘরে সবার হুড়োহুড়ি করে দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ; রান্নাঘরের ওভেন এই ঠকাস করে বন্ধ করল একজন। বাবা ধুম করে আমার ঘরে উদয় হলেন, আর ড্রেসিং গাউন মাটিতে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে খসখস শব্দ তুলে হাঁটতে লাগলেন মেঝে কাঁপিয়ে, পাশের ঘরের উনুন থেকে চেঁছে ছাই তুলছে কেউ, আওয়াজ পাচ্ছি; ভাস্তি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করছে বাবার টুপিতে ব্রাশ মারা হয়েছে কিনা, প্রতিটা শব্দ সে দম নিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করে বলল যাতে পরে কেউ বলতে না পারে যে শুনিনি - আর উত্তরে সাপের মতন হিসহিসিয়ে উঠল আরেকজন। এপার্টমেন্টের সামনের দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ করে খোলা হল, যেন সশব্দে গলা খাকারি দিয়ে সর্দি-শ্লেষ্মাভরা গলা সাফ করল কেউ, আরেকটু ফাঁক করা হল মেয়েলি গলার দানা দানা গুনগুনানির মত করে, তারপর এমন একটা পুরুষালি ভোঁতা দুম শব্দ তুলে বন্ধ করা হল যে, মনে হল এটাই এতক্ষণের সবচেয়ে নির্মম শব্দ ছিল। বাবা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে, আর শুরু হল বিক্ষিপ্ত, নরম, বিচ্ছিন্ন, আজব সব শব্দ- যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে পোষা ক্যানারি পাখি দুটোর গলার খ্যারখ্যারে আর্তনাদ।
এই ক্যানারির ডাক মনে করিয়ে দিল, আজই প্রথম নয়, এর আগেও আমি ভেবেছি, ঘরের দরজা ফাঁক করে সাপের মত বুকে ভর দিয়ে পাশের ঘরে যাব, তারপর কুঁজো হয়ে মাথা হেঁট করে আমার বোন আর ওর কাজের মেয়ের কাছে ভিক্ষা চাইব যে দোহাই লাগে, তোমরা একটু চুপ করো।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন