|
রাইসুল আবিদ
|
|
আজ নাহিদের ভাল্লাগছেনা (গল্প)
08 May 2015, Friday
মাঝে মাঝে প্রায় প্রতিটি মানুষ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অদ্ভুত একটি রোগে ভূগে।রোগের নাম ভাল্লাগেনা।এই রোগ হলে সকালে বিছানা ছাড়তে যেমন ভালো লাগেনা ঠিক তেমনি শুয়ে থাকতেও অস্বস্তি লাগে।দেহের সাথে সংযোগহীন অথচ অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ ফেসবুকটাও ভাল্লাগেনা তখন।অকারনে ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভ করে দিতে ইচ্ছে হয়। আবার ফেসবুক ছেড়ে থাকতেও ভাল্লাগেনা।এমনকি যেই মানুষটার উপর অভিমান করে হাত কাটা হয় তাকেও ভাল্লাগেনা। ভাল্লাগেনা কিছুই।
এই রোগে সবচেয়ে বেশি ভূগে বেকার মানুষ এবং স্টুডেন্টরা।ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র থেকে শুরু করে সবচেয়ে বখাটে ছেলেটিও এই রোগ থেকে রেহায় পায়না। চাকরিজীবি এবং গৃহিনীরাও যে এরোগে ভূগেনা তা নয়, তারা এই রোগটা নির্নয় করতে পারেননা।আসলে তাদের রোগ নির্নয়ের সময় হয়ে উঠেনা।
আজ দুপুর থেকে নাহিদ ভাল্লাগেনা রোগে ভূগছে। বুয়ার রান্না করা চাল সদৃশ ভাত আর বিস্বাদ তরকারির বিরুদ্ধে তার জিভের বিদ্রোহ পেট কর্তৃক জারিকৃত জরুরী অবস্থার কারনে দানা বেধে উঠতে না পারার পর থেকেই এই রোগটি সে অনুভব করতে শুরু করেছে।কিন্তু এই দুপুরের খাবারই নাহিদের ভাল্লাগেনা রোগের একমাত্র কারন ্কিনা সে ব্যাপারে নাহিদ নিশ্চিত নয়।
নাহিদ ভাবছে এই ভাল্লাগেনা রোগকে মন থেকে তাড়ানোর জন্য সিগারেট ধরানো যায় কিনা।প্রতিবার সিগারেট ধরানোর আগে নাহিদের তার মা এবং প্রেমিকার কথা মনে পড়ে - যে দুটি মানুষ তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।তারা দুজনেই কয়েকদিন পরপর নাহিদের কাছে জিজ্ঞেস করে,"আর সিগারেট খাইছিলা?"। নাহিদ উত্তরে "না" বলে।নাহিদের মতে,যারা তাকে ভালোবাসে তাদের কস্ট দেয়া ঠিক না। নাহিদ সিগারেট খায় এটা জানলে তারা কস্ট পাবে।তাই নাহিদ তাদেরকে সিগারেট খাওয়ার কথা স্বীকার করেনা।
সিগারেটে কয়েকটা টান দেওয়ার পর নাহিদ বুঝতে পারল তার সিগারেট খেতে ভালো লাগছেনা।নাহিদ আগে ভাবতো,তার সবকিছুতে বিরক্তি চলে আসলেও সিগারেটে কখনো বিরক্তি আসবেনা।কিন্তু তার এখন সিগারেট খেতে অসহ্য লাগছে।পৃথিবীর সব কিছুই আমাদের কাছে কোন না কোন সময় বিরক্তিকর মনে হয়। এমনকি নিজেকেও।নাহিদের এখন নিজের উপর বিরক্ত।কেন বিরক্ত সে তা জানেনা।
নাহিদ ফেসবুকে এসে দেখল,কোন এক ছেলের ইনবক্স কেলেঙ্কারির ঘটনায় ফেসবুক গরম।ছেলেটা বেশ নাজুক অবস্থায় আছে।তার স্ট্যাটাস দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে।ছেলেটি উদ্দেশ্যহীনভাবে কয়েকটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলেছে সাময়িক উত্তেজনায়। সে তখন হয়তো ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনি।পাশের সিটের হারুনের টেবিলের পাশে দেয়ালে একটা কাগজ দেখা যাচ্ছে।কাগজে লেখা আছে,"ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিওনা"।
নাহিদের ছেলেটির জন্য আফসোস হতে লাগলো।ছেলেটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক স্ট্যাটাস লিখেছে।গুন্ডে মুভির প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। মেয়েদের শ্লীলতাহানির প্রতিবাদে ভারী ভারী কথা লিখেছে। কিন্তু সে ওয়ালে নারীর ইজ্জত নিয়ে কথা বলে ইনবক্সে একটা অপরিচিত নারীর বুক দেখতে চাইল কেন? ছেলেটা বিরাট মাপের ভন্ড।নাহিদের আর ঐ ভন্ডকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছিলোনা।নিউজফিডে শুধু ছায়া আর ছায়া! বিরক্তিকর!
নাহিদ ফেসবুক একাউন্ট ডিএক্টিভ করে আবিস্কার করলো, সে ঘামছে। লোডিশেডিং শুরু হয়েছে।লোডশেডিং শুরু হলে নাহিদের গ্রামের কথা মনে পড়ে। গ্রামে লোডশেডিং হলেও অত গরম লাগেনা। গরম লাগলেও উঠানে বেরুলেই ফুরফুরে শীতল বাতাসে শরীরে শিরশির সুখের প্রবাহ হয়।গ্রামের মানুষগুলোর সাথে কথা বললেও মন ভালো হয়ে যায়।গ্রামের চোরটির চোখে যতটা মায়া আছে শহরের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির চোখেও ততটা মায়া নেই।নাহিদের মনে পড়লো,রোজিনা আপার কথা। রোজিনা আপার চোখ খুব মায়াবী ছিল।স্কুলে থাকতে নাহিদের মনে হতো, রোজিনা আপার চোখের দিকে তাকিয়ে মশার কামড় এবং স্যারের মার খেতেও তার খারাপ লাগবেনা।
রোজিনা আপার সাথে নাহিদের দেখা হয়েছিল আজ থেকে ৮ বছর আগে। সেদিন রোজিনা আপা নাহিদকে দেখে চোখ মুছে একটা মিথ্যে হাসি হেসেছিলো। আপা মনে করেছিল নাহিদ তার অভিনয় টের পাবেনা। আপা জানতোনা, এক স্যার যে আপুর দিকে প্রায় ই পশুর চোখে তাকাত তা নাহিদ খেয়াল করেছিল।সেদিন আপু নাহিদকেকে খেয়াল করার অনেক আগেই যে নাহিদ স্যার এবং আপুকে একসাথে খেয়াল করে ফেলেছিল তা আপু কিংবা স্যার কেউ টের পায়নি।
নাহিদ এসব ভাবতে ভাবতে মেস ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। নাহিদ মুখ বিড়বিড় করে বললো,"আচ্ছা আপা কি ঐ দিনের ঘটনার স্ক্রিনশট কাওকে দেখাতে পেরেছিল?"। হয়তো দেখায়নি। এসব ঘটনার স্ক্রিনশট বা প্রমান রাখার তো উপায় নেই। আপা হয়তো কাওকে বলে ও নি ঐদিনের ঘটনা।গত রাত থেকে কয়েকটা মেয়ে যেভাবে নাফির মুখোশ খুলে দিচ্ছে সেভাবে স্যারের মুখোশ খুলে দেয়া দরকার ছিলো।ফেসবুকের ছেলেটি এখন হয়তো অপরাধবোধে ভূগছে।সে হয়তো এখন অনুতপ্ত। মানুষ তার একটা রুপ চিনে ফেলেছে।
কিন্তু স্যারের কিছুই হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তিনি এখনো হয়তো নীতিবাক্য বলছেন। রোজিনাদেরকে লালসার চোখে দেখছেন।সুযোগ পেলে .... ।
রাস্তায় একটি ৬-৭ বছরের মেয়েকে লাফিয়ে লাফিয়ে হাটতে দেখা যাচ্ছে।তার সাথে একটি ছেড়া ফ্রক পরা ৯-১০ বছরের শ্যামলা মেয়ে।দুজনেই লাফিয়ে লাফিয়ে হাটছে।তারা হয়তো খুব আনন্দে আছে,ভাল্লাগছে রোগে ভূগছে।। নাহিদ যেমন অকারনে ভাল্লাগেনা রোগে ভূগছে মেয়ে দুটিও তেমনি অকারনে ভাল্লাগছে রোগে ভূগছে। হঠাত পিচ্চি মেয়েটি একটা ৯-১০ বছরের ছেলের হাতে একটি চকলেট গুজে দিল। হয়তো ছেলেটি মেয়েটির বড় ভাই।চকলেট পেয়ে ছেলেটিও ভাল্লাগছে রোগে ভূগছে বলে মনে হচ্ছে।
সে বোনের গাল টিপে দিয়েছে।বোন হাসছে।নাহিদের মনে পড়ছে ১০-১২ বছর আগে তার ছোট ভাই নাভিদ ও এভাবে তার হাতে বাবার কিনে দেওয়া চিপ্স বা চকলেট দিত।
নাহিদের ভাল্লাগেনা রোগটা কেটে যাচ্ছে। তার এখন ভালো লাগছে।বাচ্চা মেয়েটিকে খুব কোলে নিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে কোলে নিতে পারছেনা।হয়তো পাশের কোন বিল্ডিং থেকে মেয়েটির মা মেয়েটিকে খেয়াল করছে।নাহিদ মেয়েটিকে কোলে নিলে মেয়েটির মা রাগ করতে পারে।নাহিদের এক মাস ধরে গোফ, দাড়ি,চুল কাটা হচ্ছেনা। মহিলাটি নাহিদকে ছেলেধরা ভাবতে পারেন।শহুরে মহিলারা অচেনা আনস্মার্ট মানুষকে চোর বা ছেলেধরা ভাবতে পছন্দ করেন।
মেয়েটি নাহিদকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় নাহিদকে ভেংচি কেটে হিহিহি করে হেসে উঠল।হাসার সময় নাহিদ খেয়াল করল,মেয়েটির সামনের দুটি দাত ইদুরে নিয়ে গেছে।মেয়েটিকে আগের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। মেয়েটি নাহিদের দিকে বারবার ফিরে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে।নাহিদ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাইওয়ের দিকে হাটছে।তার চোখ দুটো ভিজে আসছে।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন